মদনসেনা, সোমদত্তের শয়নাগারে প্রবেশ করিয়া, তাহাকে সুপ্ত দেখিয়া জাগরিত করিল। সোমদত্ত, মদনসেনার অসম্ভাবিত সমাগমে বিস্ময়াপন্ন হইয়া, জিজ্ঞাসা করিল, তুমি, এই ঘোর রজনীতে, একাকিনী কি প্রকারে কোথা হইতে উপস্থিত হইলে। মদনসেনা কহিল, বিবাহের পর শ্বশুরালয়ে গিয়াছি; তথা হইতে আসিতেছি। কয়েক দিবস হইল, উপবনবিহারকালে, তোমার নিকট যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম, সেই প্ৰতিজ্ঞার প্রতিপালনার্থে উপস্থিত হইয়াছি; এক্ষণে তোমার ইচ্ছা বলবতী। সোমদত্ত জিজ্ঞাসিল, তোমার পতির নিকটে এই বৃত্তান্ত ব্যক্ত করিয়াছ কি না। সে উত্তর দিল, তাঁহার নিকটে সকল বিষয়ের অবিকল বর্ণন করিলাম; তিনি, শুনিয়া ও বিবেচনা করিয়া, কিঞ্চিৎ কাল পরে, অনুমতি প্রদান করিলেন; তৎপরে তোমার নিকট আসিয়াছি।
সোমদত্ত কিয়ৎ ক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিল, আমি পরকীয় মহিলার অঙ্গস্পর্শ করিব না। শাস্ত্রে সে বিষয়ে সবিশেষ দোষনির্দেশ আছে। যাহা হউক, তোমার বাক্যনিষ্ঠায় ও তোমার পতির ভদ্রতায়, অতিশয় প্রীত হইলাম। অকপট হৃদয়ে বলিতেছি, তুমি প্রতিজ্ঞাভার হইতে মুক্ত হইলে; এক্ষণে যাও, প্রকৃত প্রস্তাবে পতিশুশ্রূষায় প্রবৃত্ত হও।
তদনন্তর, মদনসেনা, প্রত্যাবর্তনকালে, মলিম্লুচের নিকটে উপস্থিত হইল। সে, তাহাকে ত্বরায় প্রত্যাগত দেখিয়া, কারণ জিজ্ঞাসিলে, মদনসেনা সবিশেষ সমস্ত বর্ণন করিল। চোর শুনিয়া, যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত হইয়া, অকপট হৃদয়ে কহিল, আমার অলঙ্কারের প্রয়োজন নাই। তুমি অতি সুশীলা ও সত্যবাদিনী। ধর্মে ধর্মে, তোমার যে সতীত্বরক্ষা হইল, তাহাই আমার পরম লাভ। তুমি নির্বিঘ্নে শ্বশুরালয়ে গমন কর। এই বলিয়া চোর চলিয়া গেল। অনন্তর, মদনসেনা স্বামীর সন্নিধানে উপস্থিত হইলে, সে, আর তাহার সহিত পূর্ববৎ সম্ভাষণ না করিয়া, অপ্রসন্ন মনে শয়ান রহিল।
ইহা কহিয়া, বেতাল বিক্রমাদিত্যকে জিজ্ঞাসিল, মহারাজ! এই চারি জনের মধ্যে কাহার। ভদ্রতা অধিক। রাজা উত্তর দিলেন, চোরের। বেতাল কহিল, কি প্রকারে। রাজা কহিলেন, মদনসেনার স্বামী, তাহাকে অন্যসংক্রান্তহৃদয়া দেখিয়া, পরিত্যাগ করিয়াছিল; প্রশস্ত মনে সোমদত্তের নিকট গমনে অনুমতি দেয় নাই; তাহা হইলে উহার মন এখন অপ্ৰসন্ন হইত না। আর, সোমদত্ত, উপবনে তাদৃশ অধৈৰ্যপ্রদর্শন করিয়া, এক্ষণে, কেবল রাজদণ্ডভয়ে, মদনসেনার সতীত্বভঙ্গে পরাঙ্মুখ হইল, আন্তরিক ধর্মভীরুতা প্রযুক্ত নহে। আর, মদনসেনা, সোমদত্তের নিকট প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, এবং প্ৰতিজ্ঞাপ্ৰতিপালন করা উচিত কর্ম বটে; কিন্তু স্ত্রীলোকের পক্ষে, সতীত্বপ্রতিপালন করাই সর্বাপেক্ষা প্রধান ধর্ম। সুতরাং, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গভয়ে, সতীত্বভঙ্গে প্ৰবৃত্ত হওয়া, অসতীর কর্ম বলিতে হইবেক; অতএব, তাহার এই সত্যনিষ্ঠা সাধুবাদযোগ্য নহে। কিন্তু, চোর স্বভাবতঃ অর্থগৃধু; সে যে মহামূল্য অলঙ্কার সমস্ত হস্তে পাইয়া, মদনসেনার সতীত্বরক্ষা শ্রবণে সন্তুষ্ট হইয়া, লোভসংবরণপূর্বক, তাহাকে অক্ষত বেশে গমন করিতে দিল, ইহা অকৃত্রিম ঔদার্যের কার্য, তাহার সন্দেহ নাই।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।
১০. দশম উপাখ্যান
বেতাল কহিল, মহারাজ।
গৌড়দেশে বর্ধমান নামে এক নগর আছে। তথায়, গুণশেখর নামে, অশেষগুণসম্পন্ন নরপতি ছিলেন। তাঁহার প্রধান অমাত্য অভয়চন্দ্ৰ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। নরপতিও, তদীয় উপদেশের বশবর্তী হইয়া, বৌদ্ধধর্ম অবলম্বন করিলেন; এবং, স্বয়ং শিবপূজা, বিষ্ণুপূজা, গোদান, ভূমিদান, পিতৃকৃত্য প্রভৃতি শাস্ত্ৰবিহিত অবশ্যকর্তব্য ক্রিয়াকলাপে এক কালে জলাঞ্জলি দিয়া, মন্ত্রিপ্রধান অভয়চন্দ্রের প্রতি আদেশ দিলেন, আমার রাজ্যমধ্যে, যেন এই সমস্ত অবৈধ ব্যাপার। আর প্রচলিত না থাকে।
সর্বাধিকারী, রাজকীয় আজ্ঞা অনুসারে, রাজ্যমধ্যে এই ঘোষণাপ্রদান করিলেন, যদি, অতঃপর, কোনও ব্যক্তি এই সকল রাজনিষিদ্ধ অবৈধ কর্মের অনুষ্ঠান করে, রাজা তাহার সর্বস্বহরণ ও নির্বাসনারূপ দণ্ডবিধান করিবেন। প্রজারা, কুলক্ৰমাগত আচার ও অনুষ্ঠানের পরিত্যাগে নিতান্ত অনিচ্ছা ও রাজার প্রতি মনে মনে নিরতিশয় অসন্তুষ্ট হইয়াও, দণ্ডভয়ে, প্রকাশ্য রূপে তদনুষ্ঠানে বিরত হইল।
এক দিবস, অভয়চন্দ্র রাজার নিকট নিবেদন করিলেন, মহারাজ! সংক্ষেপে ধর্মশাস্ত্রের মর্মপ্রকাশ করিতেছি, শ্রবণ করুন। এ জন্মে, কোনও ব্যক্তি কাহারও প্ৰাণহিংসা করিলে, হতপ্রাণ ব্যক্তি, জন্মান্তরে, ঐ প্রাণঘাতকের প্রাণহন্তা হয়। এই উৎকট হিংসাপাপের প্রবলতাপ্রযুক্তই, মানবজাতি, সংসারে আসিয়া, জন্মমৃত্যুপরম্পরারূপ দুর্ভেদ্য শৃঙ্খলে বদ্ধ থাকে। এই নিমিত্তই, শাস্ত্রকারেরা নিরূপণ করিয়াছেন, অহিংসা, মনুষ্যের পক্ষে, সর্বপ্রধান ধৰ্ম। মহারাজ! দেখুন, হরি, হর, বিরিঞ্চি প্ৰভৃতি প্ৰধান দেবতারাও, কেবল কর্মদোষে, সংসারে আসিয়া, বারংবার অবতার হইতেছেন। অতএব, অতি প্রবল জন্তু হস্তী অবধি, অতি ক্ষুদ্র জন্তু কীট পর্যন্ত, প্রত্যেক জীবের প্রাণরক্ষা করা সর্বপ্রধান কর্ম ও পরম পবিত্র ধর্ম। আর, বিবেচনা করিয়া দেখিলে, মনুষ্যেরা যে পরমাংস দ্বারা আপন মাংসবৃদ্ধি করে, ইহা অপেক্ষা গুরুতর অধর্ম ও যার পর নাই অসৎ কর্ম আর নাই। এবংবিধ ব্যক্তিরা, দেহান্তে নরকগামী হইয়া, অশেষ প্রকারে যাতনাভোগ করে। বিশেষতঃ, যে ব্যক্তি, স্বদৃষ্টান্ত অনুসারে, অন্যের দুঃখ বিবেচনা না করিয়া, প্ৰাণহিংসাপূর্বক, মাংসভক্ষণ দ্বারা, স্বীয় রসনা পরিতৃপ্ত করে, সে রাক্ষস; তাহার আয়ু, বিদ্যা, বল, বিত্ত, যশ প্রভৃতি হ্রাস প্রাপ্ত হয়; এবং সে কাণ, খঞ্জ, কুব্জ, মূক, অন্ধ, পঙ্গু, বধির রূপে পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করে। আর, সুরাপান অপেক্ষা গুরুতর পাপ আর নাই। অতএব, জীবহিংসা ও সুরাপান, সর্ব প্রযত্নে, পরিত্যাগ করা উচিত।