এই সময়ে, সেই সৰ্বাঙ্গসুন্দরী রমণী, রাজার সম্মুখে আসিয়া, দণ্ডায়মান হইল, এবং, তদীয় সৌন্দৰ্য দর্শনে মোহিত হইয়া কহিল, মহারাজ! আমার প্রতি যে আজ্ঞা করিবেন, তাহাই শিরোধাৰ্য করিব। রাজা কহিলেন, যদি তুমি, আমার বাক্য অনুসারে, কাৰ্য করিতে চাও, আমার প্রিয়পাত্র চিরঞ্জীবের সহধর্মিণী হও। সে কহিল, আমি তোমার রূপের ও গুণের বশীভূত হইয়াছি; এমন স্থলে, কেমন করিয়া, উহার সহধর্মিণী হইব। রাজা কহিলেন, তুমি এইমাত্র অঙ্গীকার করিয়াছ, আমার আদেশ অনুসারে কর্ম করিবে। সজ্জনেরা, প্রাণ পৰ্যন্ত পণ করিয়া, প্রতিজ্ঞাপালন করেন। অতএব, আপনি বাক্যরক্ষা কর, চিরঞ্জীবের সহধর্মিণী হও। পরিশেষে, সেই কামিনী সম্মতিপ্রদর্শন করিলে, রাজা, গান্ধৰ্ব বিধান দ্বারা, উভয়কে পরস্পর সহচর করিয়া দিয়া, আপনি সমভিব্যাহারে, রাজধানীতে লইয়া গেলেন, এবং তাহাদের সচ্ছন্দরূপ জীবিকানিৰ্বাহের যথোচিত ব্যবস্থা করিয়া দিলেন।
বেতাল জিজ্ঞাসিল, মহারাজ! রাজা ও চিরঞ্জীবের মধ্যে, কোন ব্যক্তির অধিক সৌজন্য ও ঔদার্য প্ৰকাশ হইল। রাজা কহিলেন, চিরঞ্জীবের। বেতাল কহিল, কি প্রকারে। বিক্ৰমাদিত্য কহিলেন, রাজা পরিশেষে চিরঞ্জীবের নানা মহোপকার করিলেন, যথাৰ্থ বটে; কিন্তু চিরঞ্জীব, মৃগয়াদিবসে, ফল, জল, ও আশ্রয়দান দ্বারা, রাজার যে উপকার করিয়াছিল, তাহার সহিত ও সকলের তুলনা হইতে পারে না।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।
০৯. নবম উপাখ্যান
বেতাল কহিল, মহারাজ!
মগধপুর নামে এক নগর আছে। তথায় বীরবর নামে রাজা ছিলেন। তাঁহার অধিকারে, হিরণ্যদত্ত নামে, এক ঐশ্বর্যশালী বণিক বাস করিত। ঐ বণিকের, মদনসেনা নামে, এক পরম সুন্দরী কন্যা ছিল। ঋতুরাজ বসন্ত সমাগত হইলে, মদনসেনা, স্বীয় সহচরীবর্গ সমভিব্যাহারে, উপবনবিহারে গমন করিল। দৈবযোগে, ধৰ্মদত্ত বণিকের পুত্র সোমদত্তও, পরিভ্রমণবাসনায়, সেই সময়ে, ঐ উপবনে উপস্থিত হইল। সে, কিয়ৎ ক্ষণ, ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিয়া, দূর হইতে দর্শন করিল, এক পরমা সুন্দরী, পূর্ণযৌবনা কামিনী, সখীগণ সহিত, ভ্রমণ করিতেছে। ক্ৰমে ক্রমে নিকটবর্তী হইয়া, সোমদত্ত, মদনসেনার অসামান্যরূপলাবণ্য নয়নগোচর করিয়া, মোহিত হইল; এবং, নিতান্ত অধৈৰ্য হইয়া, তাহার নিকটে গিয়া কহিল, সুন্দরি! তুমি আমার প্রতি প্ৰসন্ন হও; আমি, তোমার অলৌকিক রূপলাবণ্য দর্শনে, নিতান্ত বিচেতন হইয়াছি। অধিক আর কি বলিব, যদি আমার প্রতি অনুকুল না হও, তোমার সমক্ষে আত্মঘাতী হইব। মদনসেনা শুনিয়া, সাতিশয় ব্যাকুল হইয়া, সোমদত্তকে, অশেষ প্রকারে, সদুপদেশ প্ৰদান করিল; কিন্তু; কোনও প্রকারে তাহাকে প্রকৃতিস্থ করিতে পারিল না। সোমদত্ত, অধিকতর অধৈর্য ও ব্যাকুল হইয়া, অঞ্জলি বদ্ধ করিয়া, অশ্রুমুখে, সম্মুখে দণ্ডায়মান রহিল। তখন মদনসেনা, উদারস্বভাবতাবশতঃ, পরের প্রাণরক্ষা করা প্রধান ধর্ম বোধ করিয়া, কহিল, আগামী পঞ্চম দিবসে, আমার বিবাহ হইবেক; তৎপরে শ্বশুরালয়ে যাইব। প্ৰতিজ্ঞা করিতেছি, অগ্ৰে তোমার সহিত সাক্ষাৎ না করিয়া, স্বামিসেবায় প্রবৃত্ত হইব না। তুমি এক্ষণে ক্ষান্ত হও, গৃহে গমন কর। সোমদত্ত, মদনসেনার বাক্যে আশ্বাসিত হইয়া, বিশ্বসিত মনে, গৃহে গমন করিল।
তৎপরে, পঞ্চম দিবসে পরিণীতা হইয়া, মদনসেনা শ্বশুরালয়ে গেল। রজনী উপস্থিত হইলে, গৃহজনেরা তাহারে শয়নাগারে প্রবেশিত করিল। সে, সর্বাঙ্গ বস্ত্রাবৃত করিয়া, মৌন অবলম্বনপূর্বক, শয্যার এক পার্শ্বে উপবিষ্ট রহিল। তাহার স্বামী, পরম সমাদরে করগ্রহণপূর্বক, প্রিয় সম্ভাষণ করিতে লাগিল। কিন্তু মদনসেনা, তৎকালোচিত নবোঢ়াচেষ্টিতসমূদয়ের বৈপরীত্যে, সোমদত্তের বৃত্তান্ত বর্ণনা করিয়া কহিল, যদি তুমি আমায় তাহার নিকটে যাইতে অনুমতি না দাও, আমি আত্মঘাতিনী হইব। তাহার স্বামী প্রথমতঃ বিস্তর নিষেধ করিল; পরে তাহার আগ্রহের আতিশয্য দেখিয়া কহিল, যদি তুমি নিতান্তই তাহার নিকটে যাইতে চাও, যাও, আমি নিষেধ করিতে পারি না; প্ৰতিজ্ঞাপ্রতিপালন অবশ্যকর্তব্য বটে।
মদনসেনা, এইরূপে স্বামীর সন্মতিলাভ করিয়া, অর্ধরাত্র সময়ে, একাকিনী সোমদত্তের আলয়ে চলিল। রাজপথে উপস্থিত হইলে, এক তস্কর তাহার সম্মুখে আসিয়া জিজ্ঞাসিল, সুন্দরি। তুমি কে; এবং, সর্বাঙ্গে সর্বপ্রকার অলঙ্কার পরিয়া, এ ঘোর রজনীতে, কি অভিপ্ৰায়ে, কোথায় যাইতেছ। তোমায় একাকিনী দেখিতেছি; অথচ, তোমার অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চার লক্ষিত হইতেছে না। মদনসেনা কহিল, আমি হিরণ্যদত্ত শ্রেষ্ঠীর কন্যা। আমার নাম মদনসেনা; প্রতিজ্ঞাপ্রতিপালনের জন্য, সোমদত্তের নিকট যাইতেছি।
চোর শুনিয়া, ঈষৎ হাসিয়া, তাহার গাত্ৰ হইতে অলঙ্কার গ্রহণের উদ্যম করিলে, মদনসেনা ব্যাকুল হইয়া, কৃতাঞ্জলিপুট, পূর্বাপর সমস্ত বৃত্তান্তের নির্দেশ করিয়া কহিল, ভ্রাতঃ! আমি, অনেক যত্নে, স্বামীকে সম্মত করিয়া, তাঁহার অনুমতি লইয়া, প্রতিজ্ঞাভার হইতে মুক্ত হইবার উপায় করিয়াছি; তুমি, আমার বেশভঙ্গ করিয়া, প্ৰতিবন্ধকতাচরণ করিও না। এই স্থানে অবস্থিতি কর; প্রতিজ্ঞা করিতেছি, প্রত্যাগমনকালে সমস্ত অলঙ্কার তোমার হস্তে সমৰ্পণ করিয়া যাইব। চোর, মদনসেনার বাক্যে বিশ্বাস করিয়া, তাহাকে ছাড়িয়া দিল; এবং, সেই স্থানে উপবিষ্ট হইয়া, অলঙ্কারের প্রত্যাশায় তদীয় প্রত্যাগমনের প্রতীক্ষা করিতে লাগিল।