তাহার সহচর, স্বীয় প্রিয় বয়স্যের এবংবিধ অপ্ৰতিবিধেয় স্মরদশার প্রাদুর্ভাব দেখিয়া, নিরতিশয় বিষন্নমনা হইল, এবং অশেষবিধ চিন্তা করিয়াও, উপায়নিরূপণে অসমর্থ হইয়া, পরিশেষে তাহার পিতার নিকট সবিশেষ সমস্ত নিবেদন করিল। তাহার পিতা, সমস্ত শ্রবণ ও স্বচক্ষে সমস্ত অবলোকন করিয়া, বিবেচনা করিল, ইহার যেরূপ অবস্থা দেখিতেছি, তাহাতে, বোধ হয়, সেই কন্যার সহিত বিবাহ না হইলে, প্রাণত্যাগ করিতে পারে। অতএব, এ বিষয়ে উপেক্ষা করা বিধেয় নহে; যাহাতে ত্বরায় ইহার অভীষ্ট সিদ্ধ হয়, সে বিষয়ে যত্নবান হওয়া কর্তব্য।
এই স্থির করিয়া, দীনদাসের পিতা, পুত্রের মিত্রকে সমভিব্যাহারে লইয়া, সেই কন্যার পিত্ৰালয়ে উপস্থিত হইল; এবং, যথোচিত শিষ্টাচার ও মিষ্টালাপের পর, গৃহস্বামীকে কহিল, আমি তোমার নিকট কিছু প্রার্থনা করিতে আসিয়াছি; যদি তুমি, দয়া করিয়া, প্রার্থনা পূর্ণ করিতে সম্মত হও, ব্যক্ত করি। সে কহিল, যদি সাধ্যাতীত না হয়, অবশ্য করিব, তাহাতে কোনও সন্দেহ নাই। এইরূপে গৃহস্বামীকে বচনবদ্ধ করিয়া, দীনদাসের পিতা, তাহার নিকট, আপন প্রার্থনা ব্যক্ত করিলে, সে, তৎক্ষণাৎ সম্মত হইয়া, শুভ দিন ও শুভ লগ্ন নির্ধারিত করিয়া, কন্যাদান করিল। তন্তুবায়তনয়, অভিলাষিত নারীসমাগম দ্বারা, কৃতাৰ্থম্মন্য হইয়া, পরম সুখে কালাহরণ করিতে লাগিল।
কিয়ৎ দিন পরে, দীনদাস, শ্বশুরালয়ে কর্মবিশেষ উপস্থিত হওয়াতে, নিমন্ত্রিত হইয়া, পূর্ব বন্ধুকে সমভিব্যাহারে লইয়া, পত্নীর সহিত তথায় প্রস্থান করিল। রাজধানীর নিকটবর্তী হইলে, ভগবতী কাত্যায়নীর মন্দির দীনদাসের দৃষ্টিগোচর হইল। তখন, পূর্বকৃত মানসিক স্মৃতিপথে আরূঢ় হওয়াতে, সে মনোমধ্যে এই আলোচনা করিতে লাগিল, আমি অতিশয় অসত্যবাদী পামর; দেবীর নিকট মানসিক করিয়া, বিস্মৃত হইয়া রহিয়াছি; জন্মজন্মান্তরেও, আমি এই গুরুতর অপরাধ হইতে নিষ্কৃতি পাইব না। যাহা হউক, এক্ষণে, ক্ষণমাত্র বিলম্ব না করিয়া, দেবীর ধার পরিশোধ করা উচিত।
এইরূপ স্থির করিয়া, দীনদাস স্বীয় সহচরকে কহিল, মিত্ৰ! তুমি ক্ষণ কাল অপেক্ষা কর; আমি, দেবীদর্শন করিয়া, ত্বরায় প্রত্যাগমন করিতেছি। এই বলিয়া, তথায় উপস্থিত ও সন্নিহিত সরোবরে স্নাত হইয়া, সে প্রথমতঃ যথাবিধি পূজা করিল; অনন্তর, ভগবতি কাত্যায়নী! বহু কাল হইল, আমি তোমার নিকট মানসিক করিয়াছিলাম; আদ্য তাহার পরিশোধ করিতেছি। এই বলিয়া, মন্দিরস্থিত খড়গ লইয়া, স্কন্ধাদেশে আঘাত করিবামাত্র, তাহার মস্তক, দেহ হইতে পৃথগ্ভূত হইয়া ভূতলে পতিত হইল।
দীনদাসের আসিতে অনেক বিলম্ব দেখিয়া, তাহার বন্ধু তাহার স্ত্রীকে কহিল, তুমি এই খানে থাক, আমি বন্ধুকে ডাকিয়া আনি। এই বলিয়া, তথায় গমন করিয়া, মন্দিরমধ্যে প্রবেশপূর্বক, সে দেখিল, দীনদাসের মস্তক ও কলেবর পৃথক পৃথক পতিত আছে। তখন সে, হতবুদ্ধি হইয়া, মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিল, সংসার অতি বিরুদ্ধ স্থান; কোনও ব্যক্তিই বোধ করিবেক না, এ স্বয়ং প্ৰাণত্যাগ করিয়াছে; সকলেই বলিবেক, আমি ইহার স্ত্রীর সৌন্দর্যে মোহিত হইয়া, নির্বিঘ্নে আপন অসৎ অভিপ্ৰায় সিদ্ধ করিবার নিমিত্ত, ইহার প্রাণবধ করিয়াছি। অকারণে, এরূপ বিরূপ লোকাপবাদে দূষিত হওয়া অপেক্ষা, প্রাণত্যাগ করাই বিধেয়। এই ভাবিয়া, সে ব্যক্তিও, তৎক্ষণাৎ, সেই খড়্গ দ্বারা, আপনার মস্তকাচ্ছেদন করিল।
তন্তুবায়তনয়া, বহুক্ষণ একাকিনী দণ্ডায়মান থাকিয়া, তাহদের অন্বেষণার্থে, দেবীর মন্দিরে উপস্থিত হইল; এবং উভয়কেই মৃত পতিত দেখিয়া, বিবেচনা করিল, দৈবদুৰ্বিপাকে আমার যে দুরবস্থা ঘটিল, তাহাতে বোধ করি, পূর্বজন্মে অনেক মহাপাতক করিয়াছিলাম। যাহা হউক, যাবজ্জীবন বৈধব্যযন্ত্রণা ভোগ করিয়া, অসার দেহভার বহন করা বিড়ম্বনামাত্র। আর, লোকেও বিশেষ না জানিয়া বলিবেক, এই স্ত্রী দুশ্চরিত্রা, আপনি অভীষ্ট সিদ্ধির নিমিত্ত, স্বামীর ও স্বামীর বন্ধুর প্রাণবধ করিয়াছে। অতএব, সর্ব প্রকারেই, আমার প্রাণত্যাগ করা উপযুক্ত।
এই বলিয়া, সেই শোণিতলিপ্ত খড়্গ লইয়া, তন্তুবায়তনয়া আত্মশিরশ্ছেদনে উদ্যত হইবামাত্র, দেবী, তৎক্ষণাৎ আবির্ভূতা হইয়া, তাহার হন্ত ধরিলেন এবং কহিলেন, বৎসে! আমি তোমার সাহস ও সদ্বিবেচনা দর্শনে প্ৰসন্ন হইয়াছি, বর প্রার্থনা কর। সে কহিল, জননি! যদি প্ৰসন্ন হইয়া থাক, ইহাদের দুইজনের প্রাণদান কর। দেবী, তথাস্তু বলিয়া, উভয়ের কলেবরের সহিত মস্তকের যোগ করিতে আদেশ দিয়া, অন্তর্হিতা হইলেন। তন্তুবায়তনয়া, কাত্যায়নীর বচন শ্রবণে আহ্লাদে অন্ধপ্রায়া হইয়া, একের মস্তক অন্যের শরীরে যোজিত করিয়া দিল। উভয়েই, তৎক্ষণাৎ প্ৰাণদান পাইয়া, গাত্ৰোত্থান করিল।
এইরূপে উপাখ্যান শেষ করিয়া, বেতাল বিক্রমাদিত্যকে জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! এক্ষণে কোন ব্যক্তি ঐ কন্যার স্বামী হইবেক বল। রাজা কহিলেন, শুন বেতাল! যেমন নদীর মধ্যে গঙ্গা উত্তম, পৰ্বতের মধ্যে সুমেরু উত্তম, বৃক্ষের মধ্যে কল্পতরু উত্তম; সেইরূপ, সমুদয় অঙ্গের মধ্যে মন্তক উত্তম; এই নিমিত্তে, শাস্ত্রকারেরা মস্তকের নাম উত্তমাঙ্গ রাখিয়াছেন। অতএব, যে ব্যক্তির কলেবরে পূর্বস্বামীর উত্তমাঙ্গ যোজিত হইয়াছে, সেই তাহার স্বামী হইবেক।