অনন্তর, সে, ঐ রথে আরোহণপূর্বক, বিন্ধাচলে উপস্থিত হইল; এবং, শব্দবেধী শর দ্বারা ক্ৰব্যাদের প্রাণসংহার করিয়া, মহাদেবী সমভিব্যাহারে, অবিলম্বে ধারানগরে প্রত্যাগমন করিল। অনন্তর, তিন বর, পরস্পর বিবাদ করিয়া, কহিতে লাগিল, আমিই ইহার পাণিগ্রহণে অধিকারী; আমি না হইলে, ইহার উদ্ধার হইবার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। হরিদাস, তদীয় বাদানুবাদ শ্রবণে কর্তব্যাবধারণে বিমূঢ় ও যৎপরোনাস্তি ব্যাকুল হইল।
এইরূপে উপাখ্যানের সমাপন করিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! এই তিনের মধ্যে কোন ব্যক্তি মহাদেবীর পাণিগ্রহণে অধিকারী হইতে পারে। বিক্ৰমাদিত্য কহিলেন, যে ব্যক্তি রাক্ষসের প্ৰাণসংহার করিয়া, মহাদেবীর প্রত্যানয়ন করিয়াছে। বেতাল কহিল, তিন জনেই সমান বিদ্বান; এবং, তিন জনই, প্ৰত্যানয়নবিষয়ে, সমান সাহায্য করিয়াছে; তবে কি জন্য, অন্য কাহারও না হইয়া, এই কন্যা প্ৰত্যাহতাঁরই প্ৰণয়িনী হইবেক। রাজা কহিলেন, তিন জনই অসাধারণ গুণপ্রকাশ করিয়াছে, যথার্থ বটে; কিন্তু সূক্ষ্ম বিবেচনা করিলে, প্রত্যাহতাঁর গুণেই, প্রকৃত কার্য নিম্পন্ন হইয়াছে; অতএব, তাহারই প্রাধান্য যুক্তিযুক্ত বোধ হইতেছে।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।
০৬. ষষ্ঠ উপাখ্যান
বেতাল কহিল, মহারাজ!
ধৰ্মপুর নামে অতি প্ৰসিদ্ধ নগর আছে। তথায় ধর্মশীল নামে অতি সুশীল রাজা ছিলেন। তাঁহার মন্ত্রীর নাম অন্ধক। মন্ত্রী, এক দিন, রাজাকে পরামর্শ দিলেন, মহারাজ। মন্দিরনির্মাণপূর্বক, কাত্যায়নীর প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করিয়া, প্রতিদিন, যথাবিধানে, পূজা করিতে আরম্ভ করুন; শাস্ত্রে এ বিষয়ে বিলক্ষণ ফলশ্রুতি আছে। রাজা, মন্ত্রীর পরামর্শে, পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইলেন; এবং, নূতন মন্দির নির্মিত করাইয়া, ভগবতী কাত্যায়নীর কাঞ্চনময়ী প্রতিমূর্তি সংস্থাপনপূর্বক, প্রত্যহ, মহাসমারোহে যথোপযুক্ত ভক্তিযোগ সহকারে, দেবীর পূজা করিতে লাগিলেন।
রাজা, এইরূপে, দেবতার আরাধানে নিয়ত যত্নবান ও গো-ব্ৰাহ্মণে সাতিশয় ভক্তিমান ছিলেন; তথাপি সংসারাশ্রমের সারভূত তনয়ের মুখচন্দ্ৰনিরীক্ষণে অধিকারী হইলেন না। সর্বদাই তিনি মনে মনে চিন্তা করেন, শাস্ত্রে ও লোকাচারে প্রসিদ্ধ আছে, অপুত্র ব্যক্তির সংসারাশ্রম, ধনে জনে পরিপূর্ণ হইলেও, শূন্যপ্রায়; এবং, পরকালেও, তাহার সদ্গতিলাভ হয় না। অতএব কি কর্তব্য।
এক দিন, রাজা, মন্ত্রিপ্রবর অন্ধকের পরামর্শ অনুসারে, কাত্যায়নীর মন্দিরে প্রবেশপূর্বক, সাষ্টাঙ্গ প্ৰণিপাত করিয়া, কৃতাঞ্জলিপুটে স্তব করিতে লাগিলেন, দেবি! তুমি ত্ৰিলোকজননী; ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর প্রভৃতি দেবগণ নিয়ত তোমার আরাধনা করেন; তুমি, কালে কালে, ত্ৰিভুবনের মহানর্থহেতু উৎপাতধূমকেতুপ্রায় মহিষাসুর, রক্তবীজ প্রভৃতি দূর্বৃত্ত দৈত্য-দানবগণের প্রাণসংহার করিয়া, ভূমির ভার হরিয়াছ; আর, যখন যে স্থানে তোমার ভক্তেরা বিপদগ্ৰস্ত হইয়াছে, তুমি তৎক্ষণাৎ, তথায় আবির্ভূত হইয়া, তাহাদের পরিত্রাণ করিয়াছ; তুমি শরণাগত ভক্তগণের মনোবাঞ্ছা পূৰ্ণ করিয়া থাক; এই নিমিত্ত, আমি তোমার শরণাপন্ন হইয়াছি; আমার মনস্কামনা পরিপূর্ণ কর। স্তবাবসানে রাজা, পুনর্বার সাষ্টাঙ্গ প্ৰণিপাত করিয়া, কৃতাঞ্জলি হইয়া, দণ্ডায়মান রহিলেন।
অনন্তর আকাশবাণী হইল, রাজন! আমি তোমার প্রতি আতিশয় প্রসন্ন হইয়াছি; অভিপ্রেতি বর প্রার্থনা কর। রাজা শুনিয়া, কৃতাৰ্থম্মন্য হইয়া, আনন্দগদ্গদ স্বরে কহিলেন, জননি! যদি প্ৰসন্ন হইয়া থাক, কৃপা করিয়া এই বর দাও, যেন আমি অবিলম্বে পুত্রের মুখ নিরীক্ষণ করি। দেবী কহিলেন, বৎস। অবিলম্বে তোমার পুত্ৰ জন্মিবেক, এবং ঐ পুত্ৰ সুশীল, শান্তস্বভাব, সর্বগুণসম্পন্ন, ও সর্ব বিষয়ে পারদর্শী হইবেক।
কিয়ৎ দিন অতীত হইলে, রাজার এক পুত্র জন্মিল। রাজা, মহাসমারোহে, সপরিবারে, দেবীর মন্দিরে উপস্থিত হইয়া, স্বহস্তে পূজাকাৰ্য সম্পন্ন করিলেন, এবং, সমাগত দীন, দরিদ্র, অনাথ প্রভৃতিকে প্রার্থনাধিক ধন দিয়া, পরিতুষ্ট করিয়া বিদায় করিলেন।
এক দিন, দীনদাস নামে তন্তুবায়, কোনও কার্য উপলক্ষে, নিজ বন্ধুর সহিত, রাজধানীতে গমন করিতেছিল। দৈবযোগে, তাহার সজাতীয়া, রাজধানীবাসিনী, এক পরম সুন্দরী কন্যা নয়নগোচর হওয়াতে, দীনদাস তদীয় অসামান্য রূপলাবণ্য দর্শনে মোহিত হইল। অনন্তর, সে দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইলে, তন্তুবায় মনে মনে চিন্তা করিল, আমাদের মহারাজ, পুত্ৰবিষয়ে নিতান্ত নিরাশ হইয়াও, ভগবতী কাত্যায়নীর প্ৰসাদে, বৃদ্ধ বয়সে, পুত্রের মুখনিরীক্ষণ করিয়াছেন। দেবীর কৃপাদৃষ্টি হইলে, আমারও স্ত্রীরত্নলাভ সম্পন্ন হইতে পারে।
এই চিন্তা করিয়া, দেবীর মন্দিরে প্রবেশপূর্বক, দৃঢ়তর ভক্তিযোগ সহকারে, সাষ্টাঙ্গ প্ৰণিপাত করিয়া, তন্তুবায় কৃতাঞ্জলিপুটে মানসিক করিল, ভগবতি! যদি এই কামিনীর সহিত আমার বিবাহ হয়, স্বহস্তে মস্তকচ্ছেদন করিয়া, তোমায় পূজা দিব। এইরূপ মানসিক করিয়া, প্ৰণামপূর্বক, সে, আপন বন্ধুর সহিত, নির্দ্দিষ্ট স্থানে প্ৰস্থান করিল; পরে, নিজালয়ে প্রতিগমন করিয়া, সেই সৰ্বাঙ্গসুন্দরী রমণীর দুঃসহ বিরহানলে দগ্ধহৃদয় হইয়া, আহার, বিহার প্রভৃতি সমস্ত বিষয়ে প্রবৃত্তিশূন্য হইল; এবং, অষ্ট প্রহর, অনন্যমন ও অনন্যকর্ম হইয়া, কেবল সেই কামিনীর বিভ্ৰম বিলাস আদি ধ্যান করিতে লাগিল।