কিয়ৎ ক্ষণ পরে, জয়শ্ৰী, উৎপন্নমতিত্ববলে, এক উপায় স্থির করিয়া কহিল, সখি! আর চিন্তা নাই, উত্তম উপায় স্থির করিয়াছি; শুন দেখি, সঙ্গত হয় কিনা। আমি, এই অবস্থায় গৃহে গিয়া, শয়নমন্দিরে প্রবেশপূর্বক, চীৎকার করিয়া রোদন করিতে আরম্ভ করি। গৃহজন, রোদনশব্দে জাগরিত হইয়া, কারণ জিজ্ঞাসার্থে উপস্থিত হইলে, বলিব, আমার স্বামী, অকারণে, ক্ৰোধে অন্ধ হইয়া, নিতান্ত নির্দয়ারূপে বারংবার প্রহার করিয়া, পরিশেষে নাসিকাচ্ছেদন করিয়া দিলেন। সখী কহিল, উত্তম যুক্তি হইয়াছে; ইহাতে সকল দিক রক্ষা হইবেক। অতএব, অবিলম্বে গৃহে গিয়া, এইরূপ কর।
জয়শ্ৰী, সত্বর গৃহে গিয়া, শয়নাগারে প্রবেশপূর্বক, উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিল। গৃহজন, ক্ৰন্দনধ্বনি শ্রবণে ব্যকুল হইয়া, জয়শ্ৰীর শয়নগৃহে প্রবেশ করিয়া দেখিল, তাহার নাসিকা নাই; সমস্ত গাত্র ও বস্ত্ৰ শোণিতে অভিষিক্ত হইয়াছে; এবং, সে নিজে, ভূতলে পতিত হইয়া, রোদন করিতেছে। অনন্তর, তাহারা, ব্যগ্ৰতাপ্রদর্শন পুরঃসর, বারংবার হেতু জিজ্ঞাসা করাতে, জয়শ্ৰী আপনি স্বামীর দিকে অঙ্গুলিপ্রয়োগ করিয়া কহিল, ঐ দুর্বৃত্ত দস্যু আমার এই দুর্দশা করিয়াছে। তখন সমস্ত পরিবার, একবাক্য হইয়া, শ্ৰীদত্তের অশেষপ্রকার তিরস্কার আরম্ভ করিল।
সুশীল শ্ৰীদত্ত, পূর্বাপর কিছুই জানে না; অকস্মাৎ এতাদৃশি ভয়ঙ্কর কাণ্ড দর্শনে ও নানাপ্রকার তিরস্কারবাক্য শ্রবণে, বিস্ময়াপন্ন হইয়া, মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিল, আমি, সবিশেষ না জানিয়া, শ্বশুরালয়ে আসিয়া, যার পর নাই অবিবেচনার কর্ম করিয়াছি। ইহাকে অতি দুশ্চরিত্রা দেখিতেছি। প্রথমতঃ, শত শত চাটুবচনেও, যে ব্যক্তি আলাপ করে নাই; সেই এক্ষণে অনায়াসে, মুক্তকণ্ঠে, মিথ্যাপবাদ দিতেছে। এই নিমিত্তই নীতিজ্ঞেরা কহিয়াছেন, মনুষ্যের কথা দূরে থাকুক, দেবতারাও স্ত্রীলোকের চরিত্র ও পুরুষের ভাগ্যের কথা বুঝিতে পারেন না। জানি না, পরিশেষে কি বিপদ ঘটিবেক। এইরূপ নানাবিধ চিন্তায় মগ্ন হইয়া, মৌন অবলম্বনপূর্বক, সে অধোবদন হইয়া রহিল।
পর দিন, প্ৰভাত হইবামাত্র, জয়শ্ৰীর পিতা, রাজদ্বারে সংবাদ দিয়া, জামাতাকে বিচারালয়ে নীত করিল। প্রাড়্বিবাক, বাদী ও প্রতিবাদী উভয় পক্ষকে পরস্পর সম্মুখবর্তী করিয়া প্রথমতঃ জয়শ্ৰীকে জিজ্ঞাসিলেন, কে তোমার এ দুর্দশা করিয়াছে, বল; আমি সেই দুরাচারের যথোচিত দণ্ডবিধান করিতেছি। জয়শ্ৰী পতি প্ৰতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, ধর্মাবতার। ইনি আমার স্বামী; ইঁহা হইতে আমার এই দুৰ্দশা ঘটিয়াছে। অনন্তর, প্রাড়্বিবাক শ্ৰীদত্তকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কি নিমিত্ত এমন দুষ্কৰ্ম করিলে। সে কহিল, ধর্মাবতার। আমি এ বিষয়ের ভালমন্দ কিছুই জানি না; ইহাতে, আপনকার বিচারে, যেরূপ ব্যবস্থা হয়, করুন; এই বলিয়া, কৃতাঞ্জলি হইয়া, বিষন্ন বদনে দণ্ডায়মান রহিল।
প্রাড়্বিবাক, বাদী ও প্ৰতিবাদীর বাক্যশ্রবণান্তে, সকল বিষয়ের সবিশেষ পর্যালোচনা করিয়া, ঘাতকাদিগকে ডাকাইয়া, শ্ৰীদত্তকে শূলে দিতে আদেশ করিলেন। চোর, কিঞ্চিৎ দূরে দণ্ডায়মান হইয়া, পূর্বাপর সমস্ত ব্যাপার, সবিশেষ সতর্কতাপূর্বক, দেখিতেছিল। সে, অকারণে এক ব্যক্তির প্রাণবিনাশের উপক্রম দেখিয়া, প্রাড়্বিবাকের সম্মুখবর্তী হইয়া নিবেদন করিল, মহাশয়! সবিশেষ অনুসন্ধান না করিয়া, বিনা অপরাধে, আপনি এ ব্যক্তির প্রাণদণ্ড করিতেছেন। আপনি ধর্মাবতার, যথার্থ বিচার করুন; ব্যভিচারিণীর বাক্যে বিশ্বাস করিবেন না।
প্রাড়্বিবাক চকিত হইয়া উঠিলেন, এবং চোরের বাক্য শুনিয়া, বারংবার জিজ্ঞাসা ও তথ্যানুসন্ধানপূর্বক, সবিশেষ সমস্ত অবগত হইলেন। তদীয় আদেশ অনুসারে, জয়শ্ৰীর মৃত পতিত উপপতির বক্ত্রমধ্য হইতে, তদীয় ছিন্ন নাসিকা আনীত হইল। তখন তিনি; নিরতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইয়া, চোরকে যথার্থবাদী ও শ্ৰীদত্তকে নিরপরাধ স্থির করিয়া, যথোচিত পারিতোষিক প্রদানপূর্বক, উভয়কে বিদায় দিলেন; এবং জয়শ্ৰীীর মস্তকমুণ্ডন ও তাহাতে তক্রসেচন, তৎপরে তাহাকে গর্দভে আরোহণ ও নগরে পরিভ্রমণ করাইয়া, দেশ হইতে বহিস্কৃত করিলেন।
এইরূপে আখ্যায়িকার সমাপন করিয়া, চূড়ামণি কহিল, মহারাজ। নারী ঈদৃশ প্রশংসনীয় গুণে পরিপূর্ণা হয়।
উপক্রান্ত উপাখ্যান সমাপ্ত করিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসিল, মহারাজ! জয়শ্ৰী ও নয়নানন্দ, এ উভয়ের মধ্যে কোন ব্যক্তি অধিক দুরাচার। রাজা কহিলেন, আমার মতে, দুই সমান।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।
০৫. পঞ্চম উপাখ্যান
বেতাল কহিল, মহারাজ!
ধারা নগরে, মহাবল নামে, মহাবল পরাক্রান্ত নরপতি ছিলেন। তাঁহার দূতের নাম হরিদাস। ঐ দূতের, মহাদেবী নামে, এক পরম সুন্দরী কন্যা ছিল। কালক্রমে, কন্যা যৌবনসীমায় উপনীত হইলে, হরিদাস মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিল, কন্যা বিবাহযোগ্য হইল; অতঃপর, বর অন্বেষণ করিয়া, উহার বিবাহ সংস্কার সম্পন্ন করা উচিত। অনন্তর, পরিবারের মধ্যে, মহাদেবীর বিবাহের কথার আন্দোলন হইতে আরম্ভ হইলে, সে, এক দিন, আপনি পিতার নিকট নিবেদন করিল, পিতঃ! যে ব্যক্তির সহিত আমার বিবাহ দিবেন, তিনি যেন সৰ্বগুণে অলঙ্কত হন। হরিদাস, কন্যার এই প্রশংসনীয় প্রার্থনা শ্রবণে সন্তুষ্ট হইয়া, উপযুক্ত পাত্রের অনুসন্ধান করিতে লাগিল।