তদনন্তর সখী, জয়শ্ৰীর নিকটে গিয়া, সবিশেষ সমুদায় তাহার গোচর করিলে, সে অত্যন্ত আহ্লাদিত হইল, এবং তাহাকে পারিতোষিক দিয়া, অশেষ প্রকার প্রশংসা করিয়া কহিল, যদি তুমি তাহার সহিত মিলন করিয়া দিতে পার, আমায় চিরকালের মত কিনিয়া রাখিবে; আমি, কোনও কালে, তোমার এ ধারা শুধিতে পারিব না। এক্ষণে তুমি আপন আলয়ে গিয়া অবস্থিতি কর; সে আসিবামাত্র আমায় সংবাদ দিবে। এই বলিয়া, সখীকে বিদায় করিয়া, জয়শ্ৰী, উল্লাসিত মনে, ইচ্ছানুরূপ বেশভূষা করিতে বসিল।
শুভ সন্ধ্যাকাল উপস্থিত হইলে, সেই যুব, রতিপতির আদেশানুরূপ বেশপরিগ্রহ করিয়া, সখীর আলয়ে উপস্থিত হইল। সে, পরম সমাদরে বসিতে আসন দিয়া, জয়শ্ৰীর নিকটে গিয়া, প্ৰিয়তমের উপস্থিতিসংবাদ দিল। জয়শ্ৰী শুনিয়া, আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইয়া, কহিল, সখি! কিঞ্চিৎ কাল অপেক্ষা করি; গৃহজন নিদ্রিত হইলেই, তোমার সঙ্গে গিয়া, প্ৰাণনাথের হস্তে আত্মসমৰ্পণ করিয়া, জন্ম সাৰ্থক করিব। অনন্তর, পরিবারস্থ সমস্ত লোক নিদ্রাগত হইলে, জয়শ্ৰী, সখীর সহিত তদীয় আবাসে উপস্থিত হইয়া, অননুভূতপূর্ব, চিরাকাঙ্ক্ষিত মদনরসের আস্বাদন দ্বারা, যৌবনের চরিতার্থতা সম্পাদনা করিয়া, নিশাবসান সময়ে, স্বীয় আবাসে প্ৰতি গমন করিল। সে, এইরূপে, প্রত্যহ, প্রিয়সমাগমসুখে কালযাপন করিতে লাগিল।
কিয়ৎ দিন পরে, তাহার স্বামী, বিদেশ হইতে প্ৰত্যাগত হইয়া, শ্বশুরালয়ে উপস্থিত হইল। জয়শ্ৰী, শ্ৰীদত্তের সমাগমনে, মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিল, এ আপদ আবার, এত দিনের পর, কোথা হইতে উপস্থিত হইল। এখন কি করি, প্ৰাণনাথের নিকটে যাইবার ব্যাঘাত জন্মিল। কতদিন থাকিবেক, কত জ্বালাইবেক, তাহাও জানি না। এই চিন্তায় মগ্ন, ও স্নান, ভোজন প্রভৃতি সমস্ত বিষয়ে বিমুখ হইয়া, বিষন্ন মনে, সখীর সহিত, নানাপ্রকার মন্ত্রণা করিতে লাগিল।
রজনী উপস্থিত হইল। জয়শ্রীর মাতা, জামাতাকে, পরম সমাদর ও যত্নপূর্বক ভোজন করাইয়া, দাসী দ্বারা, শয়নাগারে গিয়া বিশ্রাম করিতে বলিলেন এবং আপন কন্যাকেও পতিশুশ্রূষার্থে গমন করিতে আদেশ দিলেন। জয়শ্ৰী প্রথমতঃ অসম্মত হওয়াতে, তাহার মাতা, নানাবিধ প্রবোধবাক্য ও ভর্ৎসনা দ্বারা তাহাকে নিরুত্তরা করিয়া বলপূর্বক গৃহপ্রবেশ করাইলেন। তখন সে বিবাশা হইয়া, শয়নাগারে প্রবেশপূর্বক, পল্যাঙ্কে আরোহণ করিয়া, বিবৃত্ত মুখে শয়ন করিয়া রহিল। শ্ৰীদত্ত, স্নিগ্ধ সম্ভাষণ করিয়া, প্ৰণয়িনীর প্রতি নানাপ্রকার প্রীতিবাক্য প্রয়োগ করিতে লাগিল। সে, তাহাতে সাতিশয় বিরক্তি প্ৰকাশ করিয়া, মৌন অবলম্বন করিয়া রহিল। শ্ৰীদত্ত, তাহার সন্তোষ জন্মাইবার নিমিত্ত, নিজানীত নানাবিধ বহুমূল্য অলঙ্কার ও পট্টশাটী প্রভৃতি কামিনীজনকমনীয় দ্রব্য প্রদান করিলে, জয়শ্ৰী, সাতিশয় কোপপ্রদর্শনপূর্বক, তদত্ত সমস্ত বস্তু দূরে নিক্ষিপ্ত করিল। তখন শ্ৰীদত্ত, নিতান্ত নিরুপায় ভাবিয়া, ক্ষান্ত রহিল, এবং একান্ত পথশ্ৰান্ত ছিল, তৎক্ষণাৎ নিদ্রাগত হইল।
জয়শ্ৰী, পতিকে নিদ্রায় অচেতন দেখিয়া, মনে মনে আহ্লাদিত হইল, এবং পতিদত্ত বস্ত্র ও অলঙ্কার পরিধান করিয়া, ঘোরতর অন্ধকারাবৃত রজনীতে, একাকিনী নিৰ্ভয়ে প্রিয়তমের উদ্দেশে চলিল। সেই সময়ে, এক তস্কর ঐ পথে দণ্ডায়মান ছিল। সে সর্বালঙ্কারভূষিত কামিনীকে, অর্ধারাত্র সময়ে, একাকিনী গমন করিতে দেখিয়া, বিবেচনা করিতে লাগিল, এই যুবতী, অসহায়িনী হইয়া, নিশীথ সময়ে, নিৰ্ভয়ে কোথায় যাইতেছে। যাহা হউক, সবিশেষ অনুসন্ধান করিতে হইল। এই বলিয়া, সে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল।
এদিকে, জয়শ্ৰীর প্রিয় সখা, সখীর আলয়ে একাকী শয়ন করিয়া, তাহার আগমনপ্ৰতীক্ষায় কালক্ষেপ করিতেছিল। অকস্মাৎ এক কালসৰ্প আসিয়া, দংশিয়া তাহার প্ৰাণসংহার করিয়া গেল। সে মৃত পতিত রহিল। জয়শ্ৰী, তথায় উপস্থিত হইয়া, মৃত প্রিয়তমকে কপটনিদ্রিত বোধ করিয়া, বারংবার আহবান করিতে লাগিল; কিন্তু উত্তর না পাইয়া, মনে মনে বিবেচনা করিল, আমার আসিতে বিলম্ব হওয়াতে, ইনি অভিমানে উত্তর দিতেছেন না; অনন্তর, তাহার পার্শ্বে শয়ন করিয়া, বিনয় ও প্রিয় সম্ভাষণপূর্বক, বিলম্বের হেতুনির্দেশ ও ক্ষমাপ্রার্থনা করিতে আরম্ভ করিল। চোর কিঞ্চিৎ দূরে দণ্ডায়মান হইয়া, সহাস্য আস্যে, এই রহস্য দেখিতে লাগিল।
নিকটস্থবটবৃক্ষবাসী এক পিশাচও এই কৌতুক দেখিতেছিল। সে, সাতিশয় কুপিত হইয়া, স্থির করিল, ঈদৃশী দুশ্চারিণীকে সমুচিত দণ্ড দেওয়া আবশ্যক; অনন্তর সে, তদীয় প্রিয়তমের মৃত কলেবরে আবিভূতি হইয়া, দন্ত দ্বারা জয়শ্ৰীর নাসিকাচ্ছেদনপূর্বক, আপন আবাসবৃক্ষে প্রতি গমন করিল। চোর, এই সমস্ত নয়নগোচর করিয়া, নিরতিশয় চমৎকৃত হইল।
জয়শ্ৰীর জ্ঞানোদয় হইল। তখন, সে, প্ৰিয়তমকে মৃত স্থির করিয়া, সখীর নিকটে গিয়া, পূর্বাপর সমস্ত ব্যাপার তাহার গোচর করিয়া কহিল, সখি! আমি এই বিষম বিপদে পড়িয়াছি; কি উপায় করি, বল। গৃহে গিয়া, কেমন করিয়া, পিতামাতার নিকট মুখ দেখাইব। তাঁহারা কারণ জিজ্ঞাসিলে, কি উত্তর দিব। বিশেষতঃ, আজি আবার সেই সৰ্বনাশিয়া আসিয়াছে; সেই বা, দেখিয়া শুনিয়া, কি মনে করিবেক। সখি! তুমি আমায় বিষ আনিয়া দাও, খাইয়া প্ৰাণত্যাগ করি; তাহা হইলেই সকল আপদ ঘুচিয়া যায়। এই বলিয়া, জয়শ্ৰী শিরে করাঘাত করিতে লাগিল। সখী শুনিয়া হতবুদ্ধি ও নিরুত্তরা হইয়া রহিল।