রত্নাবতী, অন্তঃকরণে, এই সকল আলোচনা করিয়া, ত্বরায় তাহার সন্মুখবর্তিনী হইয়া কহিল, নাথ! তুমি অন্তঃকরণে কোনও আশঙ্কা করিও না। আমি পিতা মাতার নিকট কহিয়াছি, চোরেরা, অলঙ্কারগ্রহণপূর্বক, আমায় কুপে নিক্ষিপ্ত করিয়া, তোমায় বাঁধিয়া লইয়া গিয়াছে। অতএব, সে সকল কথা মনে করিয়া, ভীত হইবার আবশ্যকতা নাই। আমার পিতা মাতা তোমার নিমিত্ত অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত আছেন; তোমায় দেখিলে, যার পর নাই, আহ্লাদিত হইবেন। আর তোমার স্থানান্তরে যাইবার প্রয়োজন নাই; এই স্থানেই অবস্থিতি করা; আমি যাবজ্জীবন তোমার চরণসেবা করিব। এইরূপে তাহার ভয়ভঞ্জন করিয়া, পরিশেষে রত্নাবতী কহিল, আমি পিতা-মাতার নিকট যেরূপ বলিয়াছি, তোমায় জিজ্ঞাসা করিলে, তুমিও সেইরূপ বলিবে।
এইরূপ উপদেশ দিয়া, রত্নাবতী প্রস্থান করিলে পর, সেই ধূর্ত তৎক্ষণাৎ শ্বশুরের নিকটে গিয়া প্ৰণাম করিল। শ্রেষ্ঠী, আলিঙ্গনপূর্বক আশীৰ্বাদ করিয়া, অশ্রুপূর্ণ লোচনে গদগদ বচনে, জামাতাকে সবিশেষ সমস্ত জিজ্ঞাসিতে লাগিলেন। নয়নানন্দ, স্বীয় সহধর্মিণীর উপদেশানুরূপ সমস্ত বৰ্ণনা করিয়া, পরিশেষে কহিল, মহাশয়। যেরূপ বিপদে পড়িয়ছিলাম, তাহাতে প্রাণরক্ষার কোনও সম্ভাবনা ছিল না; কেবল জগদীশ্বরের কৃপায়, ও আপনাদের চরণারবিন্দের অকৃত্ৰিমস্নেহসম্বলিত আশীৰ্বাদের প্রভাবে, এ যাত্ৰা কথঞ্চিৎ পরিত্রাণ পাইয়াছি। যন্ত্রণার পরিসীমা ছিল না। অধিক আর কি বলিব, শত্রুও যেন কখনও এরূপ বিপদে না পড়ে। ইহা কহিয়া, যেন যথার্থই পূরব অবস্থার স্মরণ হইল, এরূপ ভান করিয়া, সে রোদন করিতে লাগিল। সবিশেষ সমস্ত শুনিয়া ও তাহার ভাব দেখিয়া, হেমগুপ্তের অন্তঃকরণে অতিশয় অনুকম্পা জন্মিল।
রজনী উপস্থিত হইল। পতিপ্ৰাণ রত্নাবতী, স্বামিসমাগমসৌভাগ্যমদে মত্ত হইয়া, তদীয় পূর্বতন নৃশংস আচরণ বিস্মরণপূর্বক, তৎসহবাসসুখসম্ভোগের অভিলাষে, মনের উল্লাসে, সর্বাঙ্গে সর্বপ্রকার অলঙ্কার পরিধান করিয়া, শয়নাগারে প্রবেশ করিল। নয়নানন্দ, কিয়ৎ ক্ষণ কৃত্রিম কৌতুকের পর, নিদ্রাবেশ প্রকাশ করিতে লাগিল। তখন রত্নাবতী কহিল, আজ তুমি পথশ্ৰান্ত আছ, আর অধিক ক্ষণ জাগরণক্লেশ সহ্য করিবার প্রয়োজন নাই। শয়ন কর, আমি চরণসেবা করি। সে কহিল, তুমিও শয়ন কর, চরণসেবা করিতে হইবেক না।
অনন্তর উভয়ে শয়ন করিলে, ধূর্তশিরোমণি নয়নানন্দ, অবিলম্বে, কপট নিদ্রার আশ্রয়গ্ৰহণপূর্বক, নাসিক্যধ্বনি করিতে আরম্ভ করিল। রত্নাবতীও, পতিকে নিদ্রাগত দেখিয়া, অনতিবিলম্বে নিদ্রায় অচেতন হইল। তখন, সেই অদ্ভুত দুরাত্মা, অবসর বুঝিয়া, গাত্ৰোখানপূর্বক, আপন কটিদেশ হইতে তীক্ষ্নধার ছুরি বহিস্কৃত করিল, এবং, নিরুপম স্ত্রীরত্ন রত্নাবতীর কণ্ঠনালীচ্ছেদনপূর্বক, সমস্ত আভরণ লইয়া পলায়ন করিল।
ইহা কহিয়া, শারিকা বলিল, মহারাজ! যাহা বর্ণিত হইল, সমস্ত স্বচক্ষে প্ৰত্যক্ষ করিয়াছি। তদবধি, আমার পুরুষজাতির উপর অত্যন্ত অশ্রদ্ধা ও অবিশ্বাস জন্মিয়াছে। প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, পুরুষের সহিত বাক্যালাপ করিব না, এবং সাধ্যানুসারে পুরুষের সংসর্গপরিত্যাগে যত্নবতী থাকিব। পুরুষেরা অতি ধূর্ত, অতি নৃশংস, অতি স্বার্থপর। মহারাজ! অধিক আর কি বলিব, পুরুষসহবাস সসৰ্প গৃহে বাস অপেক্ষাও ভয়ানক। এই সমস্ত কারণে, আর আমার পুরুষের মুখাবলোকন করিতে ইচ্ছা নাই।
রাজা শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া, শুককে কহিলেন, আহে। চূড়ামণি! তুমি, শ্ৰীজাতির উপর কি নিমিত্তে এত বিরক্ত, তাহার সবিশেষ বর্ণন কর।
তখন শুক কহিল, মহারাজ! শ্ৰবণ করুন,
কাঞ্চনপুর নগরে সাগরদত্ত নামে এক শ্রেষ্ঠী ছিলেন। তাঁহার শ্ৰীদত্ত নামে সুরূপ, সুশীল, শান্তস্বভাব এক পুত্র ছিল। অনঙ্গপুরনিবাসী সোমদত্ত শ্ৰেষ্ঠীর কন্যা জয়শ্ৰীর সহিত তাহার বিবাহ হয়। কিয়ৎ দিন পরে, শ্ৰীদত্ত বাণিজ্যার্থে দেশান্তরে প্রস্থান করিল; জয়শ্ৰী আপনি পিত্ৰালয়ে বাস করিতে লাগিল। দীর্ঘ কাল অতীত হইল, তথাপি শ্ৰীদত্ত প্ৰত্যাগমন করিল না।
একদিন, জয়শ্ৰী আপন প্রিয়বয়স্যার নিকট কহিল, দেখ সখি! আমার যৌবন বৃথা হইল। আজ পর্যন্ত সংসারের সুখ কিছুমাত্র জানিতে পারিলাম না। বলিতে কি, এরূপে একাকিনী কালাহরণ করা কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। তুমি কোনও উপায় স্থির কর। তখন সখী কহিল, প্ৰিয়সখি! ধৈৰ্য ধর, ভগবানের ইচ্ছা হয় ত, অবিলম্বে তোমার প্রিয়সমাগম হইবেক। জয়শ্ৰী, ইচ্ছানুরূপ উত্তর না পাইয়া, অসন্তোষ প্ৰকাশ করিল, এবং তৎক্ষণাৎ তথা হইতে অপসৃত হইয়া, গবাক্ষদ্বার দিয়া রাজপথ নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। দৈবযোগে, ঐ সময়ে, এক পরম সুন্দর যুবা পুরুষ, অতিমনোহর বেশে, ঐ পথে গমন করিতেছিল। ঘটনাক্রমে, তাহার ও জয়শ্ৰীর চারিচক্ষুঃ একত্রে হইবাতে, উভয়েই উভয়ের মন হরণ করিল। জয়শ্ৰী তৎক্ষণাৎ, আপনি সখীকে কহিল, দেখ, যে রূপে পার, ঐ হৃদয়চোর ব্যক্তির সহিত সংঘটন করিয়া দাও। জয়শ্ৰীর সখী, তাহার নিকটে গিয়া, কথাচ্ছলে তাহার অভিপ্ৰায় বুঝিয়া কহিল, সোমদত্তের কন্যা জয়শ্ৰী তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চান; সন্ধ্যার পর, তুমি আমার আলয়ে আসিবে। এই বলিয়া, সে তাহাকে আপন আলয় দেখাইয়া দিল। তখন সে কহিল, তোমার সখীকে বলিবে, আমি অতিশয় অনুগৃহীত হইলাম; সায়ংকালে, তোমার আবাসে আসিয়া নিঃসন্দেহ তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিব।