রত্নাবতী, তৎক্ষণাৎ, অঙ্গ হইতে উন্মোচিত করিয়া, সমস্ত আভরণ স্বামিহন্তে ন্যস্ত করিল, এবং দাস দাসী ও বাহকদিগকে বিদায় করিয়া দিয়া, একাকিনী সেই শঠের সমভিব্যাহারিণী হইয়া চলিল। নয়নানন্দ, এইরূপে মহামূল্য অলঙ্কারসমূহ হস্তগত করিয়া, ক্ৰমে ক্রমে, অরণ্যের অতি নিবিড় প্রদেশে প্রবেশ করিল, এবং তাদৃশ পতিপরায়ণা হিতৈষিণী প্রণয়িনীকে অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত করিয়া, পলায়নপূর্বক, স্বদেশে উপস্থিত হইল। রত্নাবতী, কুপে পতিত হইয়া, হা তাত! হা মাতঃ! বলিয়া, উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিল। দৈবযোগে, এক পথিক, তথায় উপস্থিত হইয়া, তাদৃশ্য নিবিড় অরণ্যমধ্যে অসম্ভাবিত রোদনশব্দ শ্রবণ করিয়া, অতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইল, এবং শব্দ অনুসারে গমন করিয়া, কূপের সমীপবর্তী হইয়া, তন্মধ্যে দৃষ্টিনিক্ষেপপূর্বক, অবলোকন করিল, এক পরম সুন্দরী নারী, উচ্চৈঃস্বরে রোদন ও পরিবেদন করিতেছে। পথিক দর্শনমাত্র, অতিমাত্র ব্যাকুল হইয়া, পরম যত্নে সেই স্ত্রীরত্নকে কূপ হইতে উদ্ধৃত করিয়া, জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কে, কি নিমিত্তে, একাকিনী এই ভয়ঙ্কর কাননে আসিয়াছিলে; কি প্রকারেই বা তোমার এতাদৃশী দুর্দশা ঘটিল, বল।
রত্নাবতী, পতিনিন্দা অতি গৰ্হিত বুঝিয়া, প্রকৃত ব্যাপার গোপনে রাখিয়া কহিল, আমি চন্দ্রপুরনিবাসী হেমগুপ্ত শেঠের কন্যা; আমার নাম রত্নাবতী; আপন পতির সহিত শ্বশুরালয়ে যাইতেছিলাম; এই স্থানে উপস্থিত হইবামাত্র, সহসা কতিপয় দুর্দান্ত দস্যু আসিয়া, প্রথমতঃ, অঙ্গ হইতে সমস্ত অলঙ্কার লইয়া, আমায় এই কূপে ফেলিয়া দিল, এবং আমার পতিকে নিতান্ত নির্দয়ারূপে প্ৰহার করিতে করিতে, লইয়া গেল। তাঁহার কি দশা ঘটিয়াছে, কিছুই জানি না। পান্থ শুনিয়া অতিশয় আক্ষেপ করিতে লাগিল, এবং অশেষবিধ আশ্বাসদান ও অভয়প্ৰদান পূর্বক, অতি যত্নে রত্নাবতীকে সঙ্গে লইয়া, তাহার পিত্ৰালয়ে পঁহুছাইয়া দিল।
রত্নাবতী পিতা-মাতার নিরতিশয় স্নেহপাত্র ছিল। তাঁহারা, তাহার তাদৃশ্য অসম্ভাবিত দুরবস্থা দর্শনে নিতান্ত বিস্ময়াপন্ন ও একান্ত শোকাক্রান্ত হইয়া, গলদশ্রু লোচনে, আকুল বচনে জিজ্ঞাসিলেন, বৎসে! কিরূপে তোমার এরূপ দুৰ্দশা ঘটিল, বল। সে কহিল, এক অরণ্যে, অকস্মাৎ চারিদিক হইতে, অস্ত্ৰধারী পুরুষেরা আসিয়া, বলপূর্বক আমার অঙ্গ হইতে সমুদায় অলঙ্কার খুলিয়া লইল, এবং তাঁহাকে যত সম্পত্তি দিয়া বিদায় করিয়াছিলে, সে সমুদায়ও কাড়িয়া লইল; অনন্তর, আমাকে এক অন্ধকূপে ফেলিয়া দিয়া, তাহার পৃষ্ঠে, নিতান্ত নিষ্ঠুর রূপে, যষ্টিপ্রহার করিতে করিতে, কহিতে লাগিল, আর কোথায় কি লুকাইয়া রাখিয়াছিস, বাহির করিয়া দে। তখন তিনি, নিতান্ত কাতর স্বরে অনেক বিনয় করিয়া বলিলেন, আমাদের নিকট যাহা ছিল, সমস্ত তোমাদের হস্তগত হইয়াছে; আর কিছুমাত্ৰ নাই। তোমাদের প্রহারে প্রাণ ওষ্ঠাগত হইতেছে; চরণে ধরিতেছি ও কৃতাঞ্জলি হইয়া ভিক্ষা করিতেছি, আমায় ছাড়িয়া দাও। তিনি বারংবার এইপ্ৰকার কাতরোক্তিপ্রয়োগ করিতে লাগিলেন; নির্দয় দস্যুরা তথাপি তাঁহাকে রজ্জুবদ্ধ করিয়া লইয়া গেল; তৎপরে ছাড়িয়া দিল, কি মারিয়া ফেলিল, কিছুই জানিতে পারি নাই। তখন তাহার পিতা কহিলেন, বৎসে! তুমি উৎকণ্ঠিত হইও না। আমার অন্তঃকরণে লইতেছে, তোমার পতি জীবিত আছেন। চোরেরা অর্থাপিশাচ, অর্থ হস্তগত হইলে, আর অকারণে প্ৰাণ নষ্ট করে না। এইরূপে অশেষবিধ আশ্বাস ও প্ৰবোধ দিয়া, তাহার পিতা, অবিলম্বে, আর এক প্ৰস্থ অলঙ্কার প্রস্তুত করিয়া দিলেন।
এদিকে, নয়নানন্দ, আপনি আলয়ে উপস্থিত হইয়া, অলঙ্কারবিক্রয় দ্বারা অর্থসংগ্ৰহ করিয়া, দিবারাত্র দূত্যক্রীড়া, সুরাপান প্রভৃতি দ্বারা কালক্ষেপ করিতে লাগিল, এবং কিয়ৎ দিনের মধ্যেই, পুনরায় নিঃস্বভাবাপন্ন ও অন্নবস্ত্রবিহীন হইয়া, মনে মনে বিবেচনা করিল, আমি যে কুব্যবহার করিয়াছি, তাহা শ্বশুরালয়ে, কোনও প্রকারেই, প্ৰকাশ পায় নাই। অতএব, একটা ছল করিয়া, তথায় উপস্থিত হই; পরে, দুই চারি দিন অবস্থিতি করিয়া, সুযোগক্রমে কিছু হস্তগত করিয়া, পলাইয়া আসিব। মনে মনে এই দুষ্ট অভিসন্ধি করিয়া, সে শ্বশুরালয়ে গমন করিল, এবং বাটীতে প্ৰবেশ করিরামাত্র, সর্বাগ্রে স্বীয় পত্নী রত্নাবতীর দৃষ্টিপথে পতিত হইল।
পতিপ্ৰাণ রত্নাবতী, পতিকে সমাগত দেখিয়া, অন্তঃকরণে চিন্তা করিল, পতি, অতি দুরাচার হইলেও, নারীর পরম গুরু। তাঁহাকে সন্তুষ্ট রাখিতে পারিলেই, নারী ইহলোকে ও পরলোকে চরিতার্থতা প্ৰাপ্ত হয়। আর, যে নারী, কুমতিপরতন্ত্র হইয়া, পরম গুরু স্বামীর কাদাচিৎক কুব্যবহারকে অপরাধ গণ্য করিয়া, তাহার প্রতি কোনও প্রকারে অশ্রদ্ধা বা অনাদর প্রদর্শন করে, সে আপন ঐহিক ও পারলৌকিক সকল সুখে জলাঞ্জলি দেয়। আর, উনি, কেবল ভ্ৰান্তিক্ৰমেই, সেরূপ ব্যবহার করিয়াছিলেন, সন্দেহ নাই। অতএব, আমি, সেই সামান্য দোষ ধরিয়া, উহার চরণে অপরাধিনী হইব না। যাহা হউক, উনি সবিশেষ না জানিয়াই এখানে আসিয়াছেন; আমায় দেখিতে পাইলেই, নিঃসন্দেহ, পলায়ন করিবেন। অতএব, অগ্ৰে উহার ভয়ভঞ্জন করিয়া দেওয়া উচিত।