কিয়ৎ কাল পরে, শ্রেষ্ঠী পরলোক প্রাপ্ত হইলেন। নয়নানন্দ, সমস্ত পৈতৃক ধনের অধিকারী হইয়া, দ্যূতক্ৰীড়া, সুরাপান প্রভৃতি ব্যসনে আসক্ত হইল, এবং কতিপয় বৎসরের মধ্যে, দুষ্ক্রিয়া দ্বারা সমস্ত সম্পত্তি নষ্ট করিয়া, অত্যন্ত দুর্দশায় পড়িল। পরে সে, ইলাপুর পরিত্যাগপূর্বক, নানা স্থানে ভ্রমণ করিয়া, পরিশেষে, চন্দ্রপুরনিবাসী হেমগুপ্ত শেঠের নিকট উপস্থিত হইয়া, আত্মপরিচয়প্রদান করিল। হেমগুপ্ত তাহার পিতার পরম বন্ধু ছিলেন; উহাকে দেখিয়া, অতিশয় আহ্লাদিত হইলেন, এবং যথোচিত সমাদর ও সাতিশয় প্রীতিপ্ৰদৰ্শন-পূর্বক, জিজ্ঞাসা করিলেন, বৎস! তুমি, কি সংযোগে, অকস্মাৎ এস্থলে উপস্থিত হইলে।
নয়নানন্দ কহিল, আমি, কতিপয় অর্ণবপোত লইয়া, সিংহল দ্বীপে বাণিজ্য করিতে যাইতেছিলাম। দৈবের প্রতিকূলতা প্রযুক্ত, অকস্মাৎ প্রবল বাত্যা উত্থিত হওয়াতে, সমস্ত অর্ণবপোত জলমগ্ন হইল। আমি, ভাগ্যবলে, এক ফলকমাত্র অবলম্বন করিয়া, বহু কষ্টে প্রাণরক্ষা করিয়াছি। এ পর্যন্ত আসিয়া, আপনকার সহিত সাক্ষাৎ করিব, এমন আশা ছিল না। আমার সমভিব্যাহারের লোক সকল কে কোন দিকে গেল, বঁচিয়াছে, কি মরিয়াছে, কিছুই অনুসন্ধান করিতে পারি নাই। দ্রব্যসামগ্ৰী সমগ্র জলমগ্ন হইয়াছে। এ অবস্থায় দেশে প্ৰবেশ করিতে অতিশয় লজ্জা হইতেছে। কি করি, কোথায় যাই, কোনও উপায় ভাবিয়া পাইতেছি না। অবশেষে, আপনকার নিকট উপস্থিত হইয়াছি।
এই সমস্ত শ্ৰবণগোচর করিয়া, হেমগুপ্ত মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিলেন, আমি অনেক দিন অবধি, রত্নাবতীর নিমিত্ত, নানা স্থানে, পাত্রের অন্বেষণ করিতেছি; কোথাও মনোনীত হইতেছে না; বুঝি, ভগবান কৃপা করিয়া গৃহে উপস্থিত করিয়া দিলেন। এ অতি সদ্বংশজাত, পৈতৃক অতুল অর্থসম্পত্তির ন্যায়, পৈতৃক অতুল গুণসম্পত্তিরও উত্তরাধিকারী হইয়াছে, সন্দেহ নাই। অতএব, ত্বরায় দিন স্থির করিয়া, ইহার সহিত রত্নাবতীর বিবাহ দি। মনে মনে এইপ্ৰকার কল্পনা করিয়া, তিনি শ্রেষ্টিনীর নিকটে গিয়া কহিলেন, দেখ, এক শ্রেষ্ঠীর পুত্ৰ উপস্থিত হইয়াছে; সে সৎকুলোদ্ভব। তাহার পিতার সহিত আমার অতিশয় আত্মীয়তা ছিল। যদি তোমার মত হয়, তাহার সহিত রত্নাবতীর বিবাহ দি।
শ্রেষ্টিনী শুনিয়া সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, ভগবানের ইচ্ছা না হইলে, এরূপ ঘটে না। বিনা চেষ্টায় মনস্কাম সিদ্ধ হওয়া ভাগ্যের কথা। অতএব, বিলম্বের প্রয়োজন নাই; দিন স্থির করিয়া, ত্বরায় শুভ কর্ম সম্পন্ন কর। শ্রেষ্ঠী, স্বীয় সহধর্মিণীর অভিপ্ৰায় বুঝিয়া, মহাধননন্দনের নিকটে গিয়া, আপন অভিপ্ৰায় ব্যক্ত করিলেন। সে তৎক্ষণাৎ সম্মত হইল। তখন তিনি, শুভ দিন ও শুভ লগ্ন নির্ধারিত করিয়া, মহাসমারোহে কন্যার বিবাহ দিলেন। বর ও কন্যা, পরম কৌতুকে, কালব্যাপন করিতে লাগিল।
কিয়ৎ দিন পরে, নয়নানন্দ, মনোমধ্যে কোনও অসৎ অভিসন্ধি করিয়া, আপন পত্নীকে বলিল, দেখ, অনেক দিন হইল, আমি স্বদেশে যাই নাই, এবং বন্ধুবর্গেরও কোনও সংবাদ পাই নাই; তাহাতে অন্তঃকরণে কি পৰ্যন্ত উৎকণ্ঠা জন্মিয়াছে, বলিতে পারি না। অতএব, তোমার পিতা-মাতার মত করিয়া, আমায় বিদায় দাও; আর, যদি ইচ্ছা হয়, তুমিও সমভিব্যাহারে চল। পতিব্ৰতা রত্নাবতী, জননীর নিকটে গিয়া, স্বামীর অভিপ্ৰায় ব্যক্তি করিল।
শ্রেষ্টিনী স্বামীর সন্নিধানে গিয়া কহিলেন, তোমার জামাতা গৃহে যাইতে উদ্যত হইয়াছেন। শ্রেষ্ঠ শুনিয়া, ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, সে জন্যে ভাবনা কি; বিদায় করিয়া দিতেছি। তুমি কি জান না, জন, জামাই, ভাগিনেয়, এ তিন, কোনও কালে, আপন হয় না, ও তাহাদের উপর বলপ্ৰকাশ চলে না। জামাতা যাহাতে সন্তুষ্ট থাকেন, তাহাই সর্বাংশে কর্তব্য। তাঁহাকে বল, ভাল দিন দেখিয়া, বিদায় করিয়া দিতেছি। অনন্তর, শ্রেষ্ঠী আপন তনয়াকে হাস্যমুখে জিজ্ঞাসিলেন, বৎসে! তোমার অভিপ্ৰায় কি, শ্বশুরালয়ে যাইবে, না পিত্ৰালয়ে থাকিবে।
রত্নাবতী, কিয়ৎ ক্ষণ, লজ্জায় নম্রমুখী ও নিরুত্তর হইয়া রহিল; অনন্তর, কার্যান্তরব্যাপদেশে, তথা হইতে অপসৃত হইয়া, স্বামীর নিকটে গিয়া কহিল, দেখ, পিতা মাতা সম্মত হইয়াছেন; কহিলেন, তুমি যাহাতে সন্তুষ্ট হও, তাহাই করিবেন। অতএব, তোমায় এই অনুরোধ করিতেছি, কোনও কারণে, আমায় ছাড়িয়া যাইও না; আমি, তোমার অদর্শনে, প্ৰাণধারণ করিতে পারিব না।
পরিশেষে, শ্রেষ্ঠী জামাতাকে, অনেকবিধ দ্রব্যসামগ্রী ও প্রচুর অর্থ দিয়া, মহাসমাদরপূর্বক, বিদায় করিলেন, এবং কন্যাকেও, মহামূল্য অলঙ্কারসমূহে ভূষিতা করিয়া, তাহার সমভিব্যাহারিণী করিয়া দিলেন। নয়নানন্দ, নিরতিশয় আনন্দিত হইয়া, শ্বশ্রূ ও শ্বশুরের চরণবন্দনাপূর্বক, পত্নীর সহিত প্রস্থান করিল।
নয়নানন্দ, এক নিবিড় জঙ্গলে উপস্থিত হইয়া, শ্রেষ্ঠী কন্যাকে কহিল, দেখ, এই অরণ্যে অতিশয় দস্যুভয় আছে; শিবিকায় আরোহণ ও অঙ্গে অলঙ্কারধারণ করিয়া যাওয়া উচিত নহে; অলঙ্কারগুলি খুলিয়া আমার হস্তে দাও, আমি বস্ত্রাবৃত করিয়া রাখি; নগর নিকটবর্তী হইলে, পুনরায় পরিবে। আর, বাহকেরাও, শিবিকা লইয়া, এই স্থান হইতে ফিরিয়া যাউক, কেবল আমরা দুইজনে দরিদ্রবেশে গমন করি; তাহা হইলে, নিরুপদ্রবে যাইতে পারিব।