ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।
০৪. চতুর্থ উপাখ্যান
বেতাল কহিল, মহারাজ!
ভোগবতী নগরীতে, অনঙ্গসেন নামে, অতি প্ৰসিদ্ধ মহীপাল ছিলেন। চূড়ামণি নামে সৰ্বগুণাকর শুকপক্ষী, সর্ব কাল, তাঁহার সন্নিহিত থাকিত। এক দিন, রাজা কথাপ্রসঙ্গে চূড়ামণিকে জিজ্ঞাসিলেন, শুক! তুমি কি কি জান। সে কহিল, মহারাজ! আমি ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান, কালক্রয়ের বৃত্তান্ত জানি। তখন রাজা কহিলেন, যদি তুমি ত্রিকালজ্ঞ হও, বল, কোন স্থানে আমার উপযুক্ত রমণী আছে। চূড়ামণি নিবেদন করিল, মহারাজ! মগধদেশের অধিপতি রাজা বীরসেনের চন্দ্রাবতী নামে এক কন্যা আছে; সে পরম সুন্দরী ও সাতিশয় গুণশালিনী; তাহার সহিত মহারাজের বিবাহ হইবেক।
রাজা অনঙ্গসেন, শুকের সর্বজ্ঞতা পরীক্ষার্থে, চন্দ্ৰকান্ত নামক সুপ্ৰসিদ্ধ দৈবজ্ঞকে ডাকাইয়া জিজ্ঞাসিলেন, মহাশয়! আপনি গণনা দ্বারা নির্ধারিত করিয়া বলুন, কোন কামিনীর সহিত আমার বিবাহ হইবেক। তিনি জ্যোতির্বিদ্যাপ্রভাবে অবগত হইয়া কহিলেন, মহারাজ! চন্দ্রাবতী নামে এক অতি রূপবতী রমণী আছে; গণনা দ্বারা দৃষ্ট হইতেছে, তাহার সহিত আপনকার পরিণয় হইবেক। রাজা শুনিয়া শুকের প্রতি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন; পরে এক সদ্বক্তা, চতুর, বুদ্ধিমান, কাৰ্যদক্ষ ব্ৰাহ্মণকে আনাইয়া, নানা উপদেশ দিয়া, সম্বন্ধস্থিরীকরণার্থে, মগধেশ্বরের নিকট পাঠাইলেন।
চন্দ্রাবতীর নিকটেও মদনমঞ্জরী নামে এক শারিকা থাকিত। তাহারও সর্বজ্ঞতাখ্যাতি ছিল। তিনি, এক দিবস, তাহাকে জিজ্ঞাসিলেন, শারিকে! যদি তুমি ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান সমুদায় বলিতে পার, আমার যোগ্য পতি কোথায় আছেন, বল। শারিকা কহিল, রাজনন্দিনী। আমি দেখিতেছি, ভোগবতী নগরীর অধিপতি রাজা অনঙ্গসেন তোমার পতি হইবেন। ফলতঃ, অনঙ্গসেন ও চন্দ্রাবতী, উভয়েরই, এইরূপে শ্রবণ দ্বারা অন্তরে অনুরাগসঞ্চার হইল, এবং, সমাগমের অভাব নিবন্ধন, উভয়েরই, ক্রমে ক্রমে, পূর্বরাগ সংক্রান্ত স্মরদশার আবির্ভাব হইতে লাগিল।
কিয়ৎ দিন পরে, অনঙ্গসেনের প্ৰেরিত ব্ৰাহ্মণ, মগধেশ্বরের নিকট উপস্থিত হইয়া, স্বীয় রাজার অভিপ্ৰায় ব্যক্ত করিলে, তিনি তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন এবং, বাগদানের দ্রব্যসামগ্ৰী সমভিব্যাহারে দিয়া, এক ব্ৰাহ্মণকে ঐ ব্ৰাহ্মণের সহিত পাঠাইলেন; কহিয়া দিলেন, তুমি তথা হইতে প্রত্যাগমন না করিলে, আমি কোনও উদ্যোগ করিতে পারিব না। বাগদানের দ্রব্যসামগ্ৰী লইয়া ব্ৰাহ্মণেরা, অনঙ্গসেনের নিকট উপস্থিত হইয়া, সবিশেষ সমস্ত বিজ্ঞাপন করিলে, তিনি আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইলেন, এবং সুবিজ্ঞ দৈবজ্ঞ দ্বারা, বিবাহের দিন নির্ধারিত করিয়া, মগধেশ্বরের প্রেরিত ব্ৰাহ্মণ দ্বারা, তাঁহার নিকট সংবাদ পাঠাইয়া দিলেন। অনন্তর, নির্ধারিত দিবসে, যথাসময়ে মগধেশ্বরের আলয়ে উপস্থিত হইয়া, অনঙ্গসেন, চন্দ্রাবতীর পাণিগ্রহণপূর্বক, নিজ রাজধানী প্ৰত্যাগমন করিয়া, পরম সুখে কালক্ষেপণ করিতে লাগিলেন।
চন্দ্রাবতী, শ্বশুরালয়ে আগমনকালে, মদনমঞ্জরী শারিকারে সমভিব্যাহারে আনিয়াছিলেন। তিনি তাহাকে সর্বদা আপন সমীপে রাখিতেন। রাজাও, ক্ষণ কালের নিমিত্ত, চূড়ামণিকে দৃষ্টিপথের বহিস্কৃত করিতেন না। এক দিবস, রাজা ও রাজমহিষী অন্তঃপুরে একাসনে উপবিষ্ট আছেন, এবং পিঞ্জীরস্থ শুক-শারিকাও তাঁহাদের সম্মুখে আছে; সেই সময়ে রাজা রাজ্ঞীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, দেখ, একাকী থাকিলে অতি কষ্টে কালব্যাপন হয়; অতএব আমার অভিলাষ, শুকের সহিত তোমার শারিকার বিবাহ দিয়া, উভয়কে এক পিঞ্জরে রাখি; তাহা হইলে, উহারা আনন্দে কালাহরণ করিতে পরিবেক। রাজ্ঞী, ঈষৎ হাসিয়া, অনুমোদনপ্রদর্শন করিলে, রাজা, শুকের সহিত শারিকার বিবাহ দিয়া, উভয়কে এক পিঞ্জরে রাখিয়া দিলেন।
এক দিন, রাজা নির্জনে, রাজমহিষীর সহিত, রসপ্রসঙ্গে কালব্যাপন করিতেছেন, সেই সময়ে শুক শারিকাকে সম্ভাষণ করিয়া কহিতে লাগিল, দেখ, এই অসার সংসারে ভোগ অতি সার পদার্থ। যে ব্যক্তি, এই জগতে জন্মগ্রহণ করিয়া, ভৌগসুখে পরাঙ্মুখ থাকে, তাহার বৃথা জন্ম। অতএব, কি নিমিত্ত, তুমি ভোগবিষয়ে নিরুৎসাহিনী হইতেছ। শারিক কহিল, পুরুষজাতি আতিশয় শঠ, অধৰ্মী, স্বার্থপর ও স্ত্রীহত্যাকারী; এজন্য, পুরুষসহবাসে আমার রুচি হয় না। শুক কহিল, নারীও অতিশয় চপলা, কুটিলা, মিথ্যাবাদিনী, ও পুরুষঘাতিনী। উভয়ের এইরূপ বিবাদারম্ভ দেখিয়া, রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, হে শুক! হে শারিকে! কেন তোমরা অকারণে কলহ করিতেছি। তখন শারিক কহিল, মহারাজ! পুরুষ বড় অধৰ্মী, এই নিমিত্তে পুরুষজাতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও অনুরাগ নাই। আমি পুরুষের ব্যবহার ও চরিত্র বিষয়ে এক উপাখ্যান কহিতেছি, শ্রবণ করুন।
ইলাপুরে, মহাধন নামে, অতি ঐশ্বর্যশালী এক শ্রেষ্ঠী ছিলেন। বহুকাল অতীত হইয়া গেল, তথাপি তাঁহার পুত্ৰ হইল না; এজন্য, তিনি সর্বদাই মনোদুঃখে কালাহরণ করেন। কিয়ৎ দিন পরে, জগদীশ্বরের কৃপায়, তাহার সহধর্মিণী এক কুমার প্রসব করিলেন। শ্রেষ্ঠী, অধিক বয়সে পুত্ৰমুখনিরীক্ষণ করিয়া, আপনাকে কৃতাৰ্থ বোধ করিলেন, এবং পুত্রের নাম নয়নানন্দ রাখিয়া, পরম যত্নে তাহার লালন পালন করিতে লাগিলেন। বালক পঞ্চমবর্ষীয় হইলে, তিনি তাহাকে, বিদ্যাভ্যাসের নিমিত্ত, উপযুক্ত শিক্ষকের হস্তে সমর্পণ করিলেন। সে, স্বভাবদোষবশতঃ, কেবল দুঃশীল, দুশ্চরিত্র বালকগণের সহিত কুৎসিত ক্রীড়ায় আসক্ত হইয়া, সতত কালব্যাপন করে, ক্ষণমাত্ৰও অধ্যয়নে মনোনিবেশ করে না। ক্রমে ক্রমে যত বয়োবৃদ্ধি হইতে লাগিল, তদীয় কুপ্রবৃত্তি সকল, উত্তরোত্তর, ততই উত্তেজিত হইতে লাগিল।