বীরবর, পুত্রের এতাদৃশ পরমাদ্ভূত বাক্য শ্রবণে বিস্ময়াপন্ন হইয়া, অশ্রুপূর্ণ নয়নে, সহধর্মিণীকে কহিল, যদি তুমি সচ্ছন্দ মনে পুত্রপ্রদান কর, তবেই আমি দেবীর নিকটে বলিদান দিয়া, রাজকাৰ্য নিম্পন্ন করি। স্বামিবাক্য শ্রবণগোচর করিয়া, বীরবরের পত্নী নিবেদন করিল, নাথ! ধৰ্মশাস্ত্ৰে নির্দ্দিষ্ট আছে, স্বামী মূক, বধির, পঙ্গু, অন্ধ, কুব্জ, কুষ্ঠ, যেরূপ হউন, তাঁহাকে সন্তুষ্ট রাখিতে পারিলে, যেরূপ চরিতার্থতা লাভ হয়, শাস্ত্ৰবিহিত দান, ধ্যান, ব্রত, তপস্যা দ্বারা তদ্রুপ হয় না; আর যদি স্বামীর প্রতি অযত্ন ও অবজ্ঞা প্রদর্শন করিয়া, পারলৌকিক সুখসম্ভোগের লোভে, নিরন্তর শাস্ত্ৰবিহিত ধর্মকর্মের অনুষ্ঠান করে, সে সকল সর্বতোভাবে বিফল ও অন্তে অবধারিত অধোগতির কারণ হয়। অতএব, আমার পুত্র-পৌত্রে প্রয়োজন কি; তোমার চিত্তরঞ্জন ও চরণশুশ্রুষা করিলেই, উভয় লোকে নিস্তার পাইব। তাহার পুত্ৰ কহিল, পিতঃ! যে ব্যক্তি স্বামিকাৰ্যসম্পাদনে সমৰ্থ, তাহারই জন্ম সার্থক, এবং সেই স্বৰ্গলোকে অনন্ত কাল সুখসম্ভোগ করে। অতএব, আর কি জন্যে, সংশয়ে কালহরণ করিতেছেন, কাৰ্যসাধনে তৎপর হউন। বিলম্বে কাৰ্যহানির সম্ভাবনা৷
ইত্যাকার নানাপ্রকার কথোপকথনের পর, বীরবর সপরিবারে, দেবীর মন্দিরাভিমুখে প্রস্থান করিল। রাজা, এইরূপে, বীরবরের সপরিবারের প্রভূভক্তির প্রবলতা ও অচলতা দেখিয়া, যৎপরোনাস্তি চমৎকৃত ও আহ্লাদিত হইলেন, এবং মনে মনে অগণ্য ধন্যবাদ প্রদানপূর্বক, গুপ্ত ভাবে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, বীরবর দেবীর মন্দিরে উপস্থিত হইল, এবং গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য আদি নানা উপচারে, যথাবিধি পূজা করিয়া, সাষ্টাঙ্গপ্ৰণিপাতপূর্বক, দেবীর সম্মুখে কৃতাঞ্জলি হইয়া কহিল, জগদীশ্বরি! তোমাকে প্ৰসন্ন করিবার নিমিত্ত, আমি প্ৰাণাধিকপ্রিয় পুত্রকে স্বহন্তে বলিদান দিতেছি। কৃপা কর, যেন প্রভুর দীর্ঘ আয়ুঃ ও অচল রাজ্য হয়।
এই বলিয়া, খড়্গ লইয়া, বীরবর, অকাতরে, পুত্রের মস্তকচ্ছেদন করিল। বীরবরের কন্যা, এইরূপে জীবিতাধিক সহোদরের প্রাণবিনাশ দেখিয়া, খড়্গপ্রহার দ্বারা প্রাণত্যাগ করিল। তাহার পত্নীও, শোকে একান্ত বিকলচিত্তা হইয়া, তৎক্ষণাৎ তনয়-তনয়ার অনুগামিনী হইল। তখন বীরবর বিবেচনা করিল, প্রভুকাৰ্য সম্পন্ন করিলাম; এক্ষণে আর কি নিমিত্তে, দাসত্বশৃঙ্খলে বদ্ধ থাকি; আর কি সুখেই বা জীবনধারণ করি; এই বলিয়া, সেই বিষম খড়্গ দ্বারা স্বীয় শিরচ্ছেদন করিল।
এইরূপে, অল্পক্ষণ মধ্যে, চারিজনের অদ্ভুত মরণ প্রত্যক্ষ করিয়া, রাজার অন্তঃকরণে নিরতিশয় নিৰ্বেদ উপস্থিত হইল। তখন তিনি কহিতে লাগিলেন, যে রাজ্যের নিমিত্ত এতাদৃশ প্রভূভক্ত সেবকের সর্বনাশ হইল, আর আমি সেই বিষম রাজ্যের ভোগে প্রবৃত্ত হইব না। আমি, অতিশয় স্বার্থপর ও নিরতিশয় নির্বিবেক; নতুবা, কি নিমিত্তে, বীরবরকে পুত্রহত্যা হইতে নিবৃত্ত করিলাম না; কি নিমিত্তেই বা, তাহাকে আত্মঘাতী হইতে দিলাম; উপক্ৰমেই, এই ঘোরতর অধ্যবসায় হইতে, বীরবারকে বিরত করা, সর্বতোভাবে, আমার উচিত ছিল। সৰ্বথা আমি অতি অসৎ কর্ম করিয়াছি। এক্ষণে, আত্মহত্যারূপ প্ৰায়শ্চিত্ত ব্যতীত, চিত্তসন্তোষ জন্মিবেক না।
এই বলিয়া, খড়্গ লইয়া, রাজা আত্মশিরচ্ছেদনে উদ্যত হইবামাত্র, ভগবতী কাত্যায়নী, তৎক্ষণাৎ আবির্ভূতা হইয়া, হস্তধারণপূর্বক, রাজাকে মরণব্যবসায় হইতে নিবৃত্ত করিলেন; কহিলেন, বৎস! তোমার সাহস ও সদ্বিবেচনা দর্শনে, যার পর নাই, প্রীত হইয়াছি; অভিপ্রেত বর প্রার্থনা কর। রাজা কহিলেন, মাতঃ! যদি প্ৰসন্ন হইয়া থাক, এই চারি জনের জীবনদান কর; এক্ষণে, ইহা অপেক্ষা আমার আর গুরুতর প্রার্থয়িতব্য নাই। দেবী, তথাস্তু বলিয়া, অবিলম্বে পাতাল হইতে অমৃত আনয়নপূর্বক, তাহাদের গাত্রে সেচন করিবামাত্র, চারিজনেই তৎক্ষণাৎ, সুপ্তোত্থিতের ন্যায়, গাত্ৰোখান করিল। রাজা, যথার্থ প্ৰভুভক্ত বীরবরকে, অপত্য কলত্র সহিত, পুনর্জীবিত দেখিয়া, অপরিসীম হর্ষ প্রাপ্ত হইলেন, এবং, নিরতিশয় ভক্তিযোগ সহকারে, দেবীর চরণারবিন্দে সাষ্টাঙ্গ প্ৰণিপাত করিয়া কৃতাঞ্জলি হইয়া, গদগদ বাক্যে স্তব করিতে লাগিলেন। রাজার ভক্তিদর্শনে ও স্তবশ্রবেণ পরম প্রীতি প্ৰাপ্ত হইয়া, দেবী, প্রার্থনাধিক বরপ্রদান দ্বারা, রাজাকে চরিতার্থ করিয়া, অন্তর্হিতা হইলেন।
পর দিন, প্ৰভাত হইবামাত্র, রাজা রূপসেন, সভাভবনে সিংহাসনে আসীন হইয়া, রাত্রিবৃত্তান্তকীর্তনপূর্বক, সৰ্ব সভাজন সমক্ষে, ধর্ম সাক্ষী করিয়া, অদ্ভূত প্রভূপরায়ণ বীরবরকে অর্ধরাজ্যেশ্বৱ করিলেন।
এইরূপে কথা সমাপ্ত করিয়া বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! পূর্বাপর সমন্ত শ্রবণ করিলে; এক্ষণে জিজ্ঞাসা করি, কাহার ঔদার্য অধিক হইল। বিক্ৰমাদিত্য উত্তর দিলেন, আমার বোধে রাজার ঔদার্য অধিক। বেতাল কহিল, কেন। রাজা বলিলেন, স্বামীর নিমিত্ত সর্বনাশস্বীকার ও প্ৰাণদান করা সেবকের কর্তব্য কৰ্ম। বীরবর, রাজকাৰ্যার্থে, ঈদৃশ ঔদার্য প্ৰকাশ করিয়া, আত্মধর্মপ্রতিপালন করিয়াছে। কিন্তু, রাজা যে, সেবকের নিমিত্ত, রাজ্যাধিকার তৃণতুল্য বোধ করিয়া, অনায়াসে প্ৰাণত্যাগে উদ্যত হইলেন, এতাদৃশ ঔদার্যের কার্য, কস্মিন কালেও, কাহারও কর্ণগোচর হয় নাই।