ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।
০৩. দ্বিতীয় উপাখ্যান
বেতাল কহিল, মহারাজ!
বর্ধমান নগরে, রূপসেন নামে, অতি বিজ্ঞ, গুণগ্ৰাহী, দয়াশীল, পরম ধার্মিক রাজা ছিলেন। এক দিন, দক্ষিণদেশনিবাসী বীরবর নামে রজঃপূত, কর্মপ্ৰাপ্তির বাসনায়, রাজদ্বারে উপস্থিত হইল। দ্বারবান, তাহার প্রমুখাৎ সবিশেষ সমস্ত অবগত হইয়া, রাজসমীপে বিজ্ঞাপন করিল, মহারাজ! বীরবর নামে এক অস্ত্ৰধারী পুরুষ, কর্মের প্রার্থনায় আসিয়া, দ্বারদেশে দণ্ডায়মান আছে; সাক্ষাৎকারে আসিয়া স্বীয় অভিপ্ৰায় আপনকার গোচর করিতে চায়; কি আজ্ঞা হয়। রাজা আজ্ঞা করিলেন, অবিলম্বে উহারে লইয়া আইস।
অনন্তর, দ্বারী বীরবরকে নরপতিগোচরে উপস্থিত করিলে, রাজা, তদীয় আকার প্রকার দর্শনে, তাহাকে বিলক্ষণ কাৰ্যদক্ষ স্থির করিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, বীরবর! কত বেতন পাইলে, তোমার সচ্ছন্দে দিনপাত হইতে পারে। বীরবর নিবেদন করিল, মহারাজ! প্রত্যহ সহস্ৰ স্বর্ণমুদ্রার আদেশ হইলে, আমার চলিতে পারে। রাজা জিজ্ঞাসিলেন, তোমার পরিবার কত। সে কহিল, মহারাজ! এক স্ত্রী, এক পুত্র, এক কন্যা, আর স্বয়ং, এই চারি; এতদ্ব্যাতিরিক্ত আর আমার পরিবার নাই। রাজা শুনিয়া মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিলেন, ইহার পরিবার এত অল্প, তথাপি কি নিমিত্ত এত অধিক প্রার্থনা করে। যাহা হউক, এক ভৃত্যের নিমিত্ত, নিত্য নিত্য, এবংবিধ ব্যয় যুক্তিসঙ্গত নহে। অথবা, এ অর্থব্যয় ব্যর্থ হইবেক না; অবশ্যই ইহার অসাধারণ গুণ ও ক্ষমতা থাকিবেক। অতএব, কিছুদিনের নিমিত্তে রাখিয়া, ইহার গুণের ও ক্ষমতার পরীক্ষা করা উচিত। অনন্তর, কোষাধ্যক্ষকে ডাকাইয়া, রাজা আজ্ঞা দিলেন, তুমি প্রতিদিন, প্রাতঃকালে, বীরবরকে সহস্ৰ সুবৰ্ণ দিবে; কোনও মতে অন্যথা না হয়।
বীরবর, রাজকীয় আজ্ঞা শ্রবণে পরম পরিতোষ প্ৰাপ্ত হইয়া, ধন্যবাদ প্ৰদান করিতে লাগিল এবং কোষাধ্যক্ষের নিকট হইতে, সে দিবসের প্রাপ্য নির্ধারিত সুবর্ণগ্রহণপূর্বক, নৃপনির্দ্দিষ্ট বাসস্থানে গমন করিল। তথায় উপস্থিত হইয়া, সে, প্রথমতঃ, সেই সুবৰ্ণকে ভাগদ্বয়ে বিভক্ত করিয়া, একভাগ বিপ্রসাৎ করিল; অবশিষ্ট ভাগ পুনর্বার দ্বিভাগ করিয়া, একভাগ বৈষ্ণব, বৈরাগী, সন্ন্যাসী প্ৰভৃতিকে দিল; অপর ভাগ দ্বারা নানাবিধ খাদ্যসামগ্রীর আয়োজন করিয়া, শত শত দীন, দুঃখী, অনাথ প্রভৃতিকে পৰ্যাপ্ত ভোজন করাইল; অবশিষ্ট যৎকিঞ্চিৎ স্বয়ং, পুত্র, কলত্র, ও দুহিতার সহিত, আহার করিল।
প্রতিদিন, এইরূপে দিনপাত করিয়া, সায়ংকালে বর্ম, খড়গ ও চর্ম ধারণপূর্বক, বীরবর সমস্ত রজনী, রাজদ্বারে উপস্থিত থাকে। রাজা, তাহার শক্তির ও প্রভুভক্তির পরীক্ষার্থে, কি দ্বিতীয় প্রহর, কি তৃতীয় প্রহর, যখন যে আদেশ করেন, অতি দুঃসাধ্য হইলেও, সে তৎক্ষণাৎ তাহা সম্পন্ন করিয়া আইসে।
এক দিন, নিশীথ সময়ে, অকস্মাৎ স্ত্রীলোকের ক্ৰন্দনধ্বনি শ্রবণগোচর করিয়া, রাজা বীরবরকে আহবান করিলে, সে তৎক্ষণাৎ সম্মুখবর্তী হইয়া কহিল, মহারাজ! কি আজ্ঞা হয়। রাজা কহিলেন, দক্ষিণ দিকে স্ত্রীলোকের ক্ৰন্দনশব্দ শুনা যাইতেছে; ত্বরায়, ইহার তথ্যানুসন্ধান করিয়া, আমায় সংবাদ দাও। বীরবর যে আজ্ঞা মহারাজ বলিয়া, তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করিল। রাজা বীরবরকে, এক মুহুর্তের নিমিত্তেও, আজ্ঞা প্রতিপালনে পরাঙ্মুখ না দেখিয়া, সাতিশয় সন্তুষ্ট ছিলেন; এক্ষণে তাহার সাহস ও ক্ষমতা প্ৰত্যক্ষ করিবার নিমিত্ত, স্বয়ং গুপ্ত ভাবে পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন।
বীরবর, সেই ক্ৰন্দনশব্দ লক্ষ্য করিয়া, অতি প্ৰসিদ্ধ এক ভয়ঙ্কর শ্মশানে উপস্থিত হইল; দেখিল, এক সর্বালঙ্কারভূষিতা সর্বাঙ্গসুন্দরী রমণী শিরে করাঘাত ও হাহাকার করিয়া, উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতেছে। বীরবর দেখিয়া অতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইল, এবং তাহার সম্মুখবর্তী হইয়া জিজ্ঞাসিল, তুমি কে, কি দুঃখে, এই ঘোর রজনীতে, একাকিনী শ্মশানবাসিনী হইয়া, বিলাপ ও পরিতাপ করিতেছি। সে কোনও উত্তর দিল না; বরং পূর্ব অপেক্ষায়, অধিকতর রোদন করিতে, লাগিল। অনন্তর, বীরবর, সবিশেষ ব্যগ্রতা প্রদর্শনপূর্বক, বারংবার জিজ্ঞাসা করাতে, সে কহিল, আমি রাজলক্ষ্মী; রাজা রূপসেনের গৃহে নানা অন্যায়াচরণ হইতেছে; তৎপ্রযুক্ত, তদীয় আবাসে, অচিরাৎ অলক্ষ্মীর প্রবেশ হইবেক; সুতরাং, আমি রাজার অধিকার পরিত্যাগ করিয়া যাইব। আমি প্রস্থান করিলে, অল্প দিনের মধ্যেই, রাজার প্ৰাণাত্যয় ঘটিবেক; সেই দুঃখে দুঃখিত হইয়া, রোদন করিতেছি।
প্রভুর এবম্ভূত অসম্ভাবিত ভাবি অমঙ্গল শ্রবণে বিষাদসাগরে মগ্ন হইয়া, বীরবর কহিল, দেবি! আপনি যে আজ্ঞা করিলেন, তাহাতে, কোনও মতে, সন্দেহ করিতে পারি না। কিন্তু, যদি এই হৃদয়বিদারণ অমঙ্গলঘটনার নিবারণের কোনও উপায় থাকে, বলুন; আমি, রাজার মঙ্গলের নিমিত্ত, প্রাণান্ত পর্যন্ত স্বীকার করিতে প্রস্তুত আছি। রাজলক্ষ্মী কহিলেন, পূর্বদিকে, অর্ধযোজনান্তে, এক দেবী আছেন। যদি কেহ ঐ দেবীর নিকটে, আপন পুত্রকে স্বহস্তে বলিদান দেয়, তবে তিনি, প্রসন্ন হইয়া, রাজার সমস্ত অমঙ্গলের সম্পূর্ণ নিবারণ করিতে পারেন। রাজলক্ষ্মীর এই বাক্য শুনিয়া, বীরবর, অতি সত্বর, ভবনাভিমুখে ধাবমান হইল। রাজাও, কৌতুকাবিষ্ট হইয়া, পশ্চাৎ পশ্চাং চলিলেন। বীরবর, গৃহে উপস্থিত হইয়া, আপন পত্নীকে জাগরিত করিয়া, সবিশেষ সমস্ত জ্ঞাত করিলে, সে তৎক্ষণাৎ পুত্রের নিদ্ৰাভঙ্গ করিয়া কহিল, বৎস! তোমার মন্তক দিলে, রাজার দীর্ঘ আয়ুঃ ও অচল রাজ্য হয়। তখন পুত্ৰ কহিল, মাতঃ! প্রথমতঃ, আপনকার আজ্ঞা; দ্বিতীয়তঃ, স্বামিকাৰ্য; তৃতীয়তঃ, ক্ষণবিনশ্বর পাঞ্চভৌতিক দেহ দেবসেবায় নিয়োজিত হইবেক; ইহা অপেক্ষা, আমার পক্ষে প্রাণত্যাগের উত্তম সময় আর ঘটিবেক না। অতএব, শুভ কর্মে বিলম্ব করা কর্তব্য নহে। আপনারা, সত্বর হইয়া, কাৰ্যসম্পাদন করুন।