রাজা, এবম্প্রকার অঘটনঘটনা দর্শনে, হতবুদ্ধি ও লজ্জায় অধোবদন হইয়া, ভাবিতে লাগিলেন, এতাদৃশী দুশ্চারিণীকে গৃহে রাখা কদাচি উচিত নহে; ইহাতে অধৰ্ম আছে। অতএব, এখন কি কর্তব্য। অথবা, পণ্ডিতমণ্ডলী সমবেত করিয়া, সবিশেষ কহিয়া জিজ্ঞাসা করি; তাঁহারা, ধর্মশাস্ত্র অনুসারে, যেরূপ ব্যবস্থা দিবেন, তদনুরূপ কাৰ্য করিব। কিন্তু, শাস্ত্ৰে গৃহচ্ছিদ্র প্রকাশ করিতে নিষেধ আছে। পণ্ডিতমণ্ডলী সমবেত করিয়া ব্যবস্থা জিজ্ঞাসিলে, আমার এই কলঙ্ক, ক্রমে ক্ৰমে দেশে বিদেশে প্রচারিত হইবেক। তদপেক্ষা উত্তম কল্প এই, সেই সন্ন্যাসীকেই ইহার পরামর্শ জিজ্ঞাসা করি। সন্ন্যাসী সবিশেষ সমস্ত অবগত আছেন; ধর্মতঃ প্রশ্ন করিলে, অবশ্যই যথাশাস্ত্র ব্যবস্থা দিবেন। অনন্তর, রাজা সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মহাশয়! ধর্মশাস্ত্ৰে দুশ্চরিত্রা স্ত্রীর বিষয়ে কিরূপ দণ্ড নিরূপিত আছে। সন্ন্যাসী কহিলেন, মহারাজ! ধৰ্মশাস্ত্ৰে লিখিত আছে স্ত্রীলোক, বালক, ব্ৰাহ্মণ ইহারা অত্যন্ত অপরাধী হইলেও, বিধার্হ নহে; রাজা ইহাদের নির্বাসনারূপ দণ্ডবিধান করিবেন।
রাজা, এই সমস্ত শ্রবণ করিয়া, অন্তঃপুরে গিয়া, রাজ্ঞীকে কহিলেন, পদ্মাবতী অতি দুশ্চরিত্রা; এজন্য শাস্ত্রের বিধান অনুসারে, আমি উহারে দেশবহিস্কৃতা করিব। রাজ্ঞী কন্যার প্রতি নিরতিশয় স্নেহবতী ছিলেন; কিন্তু, পতিব্ৰতাত্বগুণের আতিশয্যবশতঃ রাজার মতেই সন্মতিপ্ৰদৰ্শন করিলেন। অনন্তর নরপতি, কন্যাকে শিবিকারোহণের আদেশ দিয়া, তাহার অগোচরে, বাহকদিগকে আজ্ঞা দিলেন, তোমরা, পদ্মাবর্তীকে কোনও অরণ্যানীতে পরিত্যাগ করিয়া, ত্বরায় আমায় সংবাদ দিবে। বাহকেরা রাজাজ্ঞাসম্পাদন করিল। অমাত্যপুত্রও, তৎক্ষণাৎ, রাজকুমারকে সঙ্গে লইয়া, রাজকুমারীর উদ্দেশে চলিলেন; এবং, ইতস্ততঃ অনেক অন্বেষণ করিয়া, পরিশেষে সেই অরণ্যানীতে প্রবেশিয়া দেখিলেন, পদ্মাবতী, একাকিনী বৃক্ষমূলে বসিয়া, যূথভ্রষ্টা হরিণীর ন্যায়, বিষন্নবদনে রোদন করিতেছেন। অশেষবিধ আশ্বাসপ্রদান দ্বারা তাঁহার শোকাবেগনিবারণ করিয়া, সঙ্গে লইয়া, উভয়ে স্বদেশ অভিমুখে প্ৰস্থান করিলেন। তাঁহার রাজধানীতে উপস্থিত হইলে, প্ৰজাগণ অতিশয় আনন্দিত হইল। রাজা প্রতাপমুকুট, বধূ সহিত পুত্ৰ পাইয়া, আনন্দপ্রবাহে মগ্ন হইয়া, নগরে মহোৎসবের আদেশ করিলেন।
এইরূপে আখ্যায়িকার সমাপন করিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ। রাজা ও মন্ত্রিপুত্র, এ উভয়ের মধ্যে কোন ব্যক্তি, নিরপরাধে রাজনন্দিনীর নির্বাসনজন্য দুরদৃষ্টভাগী হইবেন। বিক্ৰমাদিত্য কহিলেন, আমার মতে, রাজা। বেতাল কহিল, কি নিমিত্তে। রাজা কহিলেন, শাস্ত্রকারেরা আততায়ীর বধে ও বিদ্রোহাচরণে দোষাভাব লিখিয়াছেন। অতএব, বিষপ্রদায়িনী রাজতনয়ার প্রতি এরূপ প্রতিকূল আচরণের নিমিত্ত, মন্ত্রিপুত্রকে দোষী বলিতে পারা যায় না। কিন্তু, রাজা যে, অজ্ঞাতকুলশীল ব্যক্তির বাক্যে বিশ্বাস করিয়া, প্রমাণান্তরনিরপেক্ষ ও বিচারবহির্মুখ হইয়া, অপত্যস্নেহবিস্মরণপূর্বক, অকৃত অপরাধে, কন্যাকে নির্বাসিত করিলেন, ইহাতে তাঁহার, রাজধর্মের বিরুদ্ধ কর্মের অনুষ্ঠানজন্য, পাপম্পৰ্শ হইতে পারে।
ইহা শুনিয়া, বেতাল পূর্বকৃত প্রতিজ্ঞা অনুসারে, শ্মশানে গিয়া, পূর্ববৎ বৃক্ষে লম্বমান হইল; রাজাও, তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইয়া, তাহাকে, বৃক্ষ হইতে অবতারণপূর্বক, স্কন্ধে করিয়া, সন্ন্যাসীর আশ্রম অভিমুখে চলিলেন।
০২. দ্বিতীয় উপাখ্যান
বেতাল কহিল, মহারাজ! দ্বিতীয় উপাখ্যানের আরম্ভ করি, অবধান কর।
যমুনাতীরে, জয়স্থল নামে এক নগর আছে। তথায়, কেশব নামে এক পরম ধার্মিক ব্ৰাহ্মণ ছিলেন। ঐ ব্রাহ্মণের, মধুমালতী নামে, এক পরম সুন্দরী দুহিতা ছিল। কালক্রমে, মধুমালতী বিবাহযোগ্য হইলে, তাহার পিতা ও ভ্রাতা, উভয়ে উপযুক্ত পাত্রের অন্বেষণে তৎপর হইলেন।
কিয়ৎ দিন পরে, ব্ৰাহ্মণ, যজমানপুত্রের বিবাহ উপলক্ষে, গ্রামান্তরে গেলেন; ব্ৰাহ্মণের পুত্ৰও, অধ্যয়নের নিমিত্ত, গুরুগৃহে প্ৰস্থান করিলেন। উভয়ের অনুপস্থিতিসময়ে, এক সুকুমার ব্ৰাহ্মণকুমার কেশবের গৃহে অতিথি হইলেন। কেশবের ব্ৰাহ্মণী, তাহাকে রূপে রতিপতি ও বিদ্যায় বৃহস্পতি দেখিয়া, মনে মনে বাসনা করিলেন, যদি সৎকুলোদ্ভব হয় ও অঙ্গীকার করে, তবে ইহাকেই জামাত করিব; অনন্তর, যথোচিত অতিথিসৎকার করিয়া, তাহার কুলের পরিচয় লইলেন, এবং সৎকুলাজাত জানিয়া আনন্দিত হইয়া কহিলেন, বৎস! যদি তুমি স্বীকার কর, তোমার সহিত আমার মধুমালতীর বিবাহ দি। বিপ্রতনয়, মধুমালতীর লোকাতীত লাবণ্য দর্শনে মুগ্ধ হইয়া, কেশবপত্নীর প্রস্তাবে সম্মত হইলেন, এবং ব্ৰাহ্মণের প্রত্যাগমনপ্রতীক্ষায়, তদীয় আবাসে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন।
কতিপয় দিবস। অতীত হইলে, ব্ৰাহ্মণ ও তাঁহার পুত্র উভয়ে, মধুমালতীপ্রদানে প্ৰতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়া, এক এক পাত্ৰ লইয়া, প্ৰবাস হইতে প্ৰত্যাগমন করিলেন। তিন পাত্র একত্র হইল; একের নাম ত্ৰিবিক্ৰম, দ্বিতীয়ের নাম বামন, তৃতীয়ের নাম মধুসূদন। তিন জনই রূপ, গুণ, বিদ্যা, বয়ঃক্রমে তুল্য, কোনও ক্রমে ইতরবিশেষ করিতে পারা যায় না। তখন ব্ৰাহ্মণ, বিলক্ষণ বিপদগ্ৰস্ত হইয়া, এই চিন্তা করিতে লাগিলেন, এক কন্যা, তিন পাত্ৰ উপস্থিত; কি উপায় করি; তিন জনেই তিন জনের নিকট প্রতিশ্রুত হইয়াছি; এক্ষণকার কর্তব্য কি।