উভয়ের এইরূপ বচনবৈদগ্ধী শ্ৰবণগোচর করিয়া, পার্শ্ববর্তিনী সহচরী, পদ্মাবতীর হস্ত হইতে তালবৃন্ত গ্রহণপূর্বক, বায়ুসঞ্চারণ করিতে লাগিল। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, রাজকুমার ও রাজকুমারী সহচরীদিগকে সাক্ষী করিয়া, গান্ধৰ্ব বিধানে, দাম্পত্যবন্ধনে আবদ্ধ হইলেন। অনন্তর, উভয়ের সাত্ত্বিক ভাবের আবির্ভাব দেখিয়া, সহচরীগণ, কার্যান্তরব্যপদেশে, বিলাসভবন হইতে বহির্গত হইলে, কান্ত ও কামিনী কৌতুকে যামিনী যাপন করিলেন।
রজনী অবসন্না হইল। রাজকুমার অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইবার অভিপ্ৰায় প্রকাশ করিলেন। তখন রাজকুমারী কহিলেন, নাথ! আমার এ অন্তঃপুরে, সখীগণ ব্যতিরেকে, অন্যের প্রবেশ করিবার অধিকার নাই; তুমি নিৰ্ভয়ে অবস্থিতি কর। আমি, তোমায় বিদায় দিয়া, ক্ষণমাত্রও প্রাণধারণ করিতে পারিব না। রাজকুমার, প্রিয়তমার ঈদৃশ প্রণয়রসাভিষিক্ত মৃদু মধুর বচন পরম্পরা শ্রবণে শ্রবণেন্দ্রিয়ের চরিতার্থতা লাভ করিয়া, তদীয় প্ৰস্তাবে সম্মত হইলেন, এবং তাঁহার সহচর হইয়া, পরম সুখে, কালব্যাপন করিতে লাগিলেন।
এইরূপে কতিপয় দিবস অতিবাহিত হইলে, রাজকুমার রাজধানীপ্ৰতিগমনের অভিপ্রায়প্ৰকাশ করিলেন। রাজকন্যা, কোনও মতে, সম্মত হইলেন না। ক্রমে ক্রমে, প্রায় মাস অতীত হইয়া গেল; রাজকুমার তথাপি প্ৰস্থানের অনুমতিলাভ করিতে পারিলেন না। এইরূপে, স্বদেশপ্ৰতিগমনবিষয়ে নিতান্ত নিরুপায় হইয়া, তিনি একদিন, নির্জনে বসিয়া মনে মনে এই আলোচনা করিতে লাগিলেন, আমি নিতান্ত নরাধম; অকিঞ্চিৎকর ইন্দ্ৰিয়সুখের পরতন্ত্র হইয়া, পিতা মাতা জন্মভূমি প্রভৃতি সকল পরিত্যাগ করিলাম; আর, যে জীবিতাধিক বান্ধবের বুদ্ধিকৌশলে ও উপদেশবলে, ঈদৃশ অসুলভ সুখসম্ভোগে কালাহরণ করিতেছি, মাসাবধি তাহারও কোনও সংবাদ লইলাম না; বোধ করি, বন্ধু আমায় নিতান্ত স্বার্থপর ও যার পর নাই অকৃতজ্ঞ ভাবিতেছেন।
রাজকুমার একাকী এইরূপ চিন্তা করিতেছেন, এমন সময়ে রাজকন্যা তথায় উপস্থিত হইয়া, তাঁহাকে সাতিশয় বিষন্ন দেখিয়া জিজ্ঞাসিলেন, নাথ! আজি কি জন্যে তুমি এমন উন্মনা হইয়াছ। তোমার চন্দ্ৰবদন বিষন্ন দেখিলে, আমি দশ দিক শূন্য দেখি। অসুখের কারণ কি, বল; ত্বরায় তাহার প্রতিবিধান করিতেছি। বজ্রমুকুট কহিলেন, পিতার সর্বাধিকারীর পুত্র আমার সমভিব্যাহারে আসিয়াছেন। তিনি আমার পরম সুহৃৎ; মাসাবধি তাঁহার কোনও সংবাদ পাই নাই; জানি না, তিনি কেমন আছেন। তিনি অতি চতুর, সর্বশাস্ত্ৰে পণ্ডিত, ও নানা গুণরত্নে মণ্ডিত। তাঁহারই বুদ্ধিকৌশলে ও মন্ত্রণাবলে, তোমার সমাগম লাভ করিয়াছি। তিনিই তোমার সমস্ত সঙ্কেতের মর্মোদ্ভেদ করিয়াছিলেন।
পদ্মাবতী কহিলেন, অয়ি নাথ! ঈদৃশ বন্ধুর অদর্শনে, চিত্ত অবশ্যই উৎকণ্ঠিত হইতে পারে। এত দিন তাহার কোনও সংবাদ না লওয়ায়, যৎপরোনাস্তি অভদ্রতা প্ৰকাশ হইয়াছে। রহস্যবিদ বন্ধু প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয়তর। বিবেচনা করিয়া দেখিলে, তুমি তাঁহার নিকট সম্পূর্ণ অপরাধী হইয়াছ, এবং, যার পর নাই, অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করিয়াছ। এক্ষণকার কর্তব্য এই, তাহার পরিতোষার্থে, আমি স্বহস্তে নানাবিধ মিষ্টান্ন প্রস্তুত করিয়া পাঠাই; এবং তুমিও, একবার, কিয়ৎ ক্ষণের নিমিত্ত, তথায় গিয়া, সমুচিত সদ্ভাবপ্রদর্শন করিয়া আইস। রাজপুত্র, তৎক্ষণাৎ, সেই খড়কী দিয়া, অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইয়া, বৃদ্ধার ভবনে উপস্থিত হইলেন, এবং, বহু দিবসের পর, অকপটপ্রণয় পবিত্র মিত্র সহ সাক্ষাৎকারলাভে অশ্রুপূর্ণলোচনা হইয়া, তাঁহার নিকট পূর্বাপর সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণন করিলেন।
রাজপুত্রকে বন্ধুদর্শনে প্রেরণ করিয়া, রাজকন্যা মনে মনে এই আলোচনা করিতে লাগিলেন, এ কেবল বন্ধুর বুদ্ধিকৌশলেই কৃতকাৰ্য হইয়াছে; অতএব অবশ্যই সকল কথা তাঁহার নিকট ব্যক্ত করিবেক; আর, সে ব্যক্তিও আপনি বান্ধবগণের নিকট, সমস্ত প্ৰকাশ করিবেক, সন্দেহ নাই। এইরূপে আমার কলঙ্কঘোষণা, ক্রমে ক্রমে, জগদ্ব্যাপিনী হইবার সম্ভাবনা। অতএব, এতাদৃশ ব্যক্তিকে জীবিত রাখা, কোনও ক্ৰমে, শ্রেয়স্কর নহে। এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া, পদ্মাবতী, অবিলম্বে নানাবিধ বিষমিশ্ৰিত মিষ্টান্ন প্ৰস্তুত করিয়া সখী দ্বারা রাজকুমারের নিকট পাঠাইয়া দিলেন।
মিষ্টান্ন উপনীত হইলে, সর্বাধিকারিপুত্র জিজ্ঞাসা করিলেন, বয়স্য। এ সকল কি। রাজপুত্ৰ কহিলেন, মিত্র। আজ আমি তোমার জন্য অতিশয় উৎকণ্ঠিত হইয়াছিলাম। রাজকন্যা, আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া, কারণজিজ্ঞাসু হইলে, আমি তোমার সবিশেষ পরিচয় দিয়া ও অশেষবিধ প্ৰশংসা করিয়া বলিলাম, প্রিয়ে! আমি এই বন্ধুর অদর্শনে বিষন্ন হইতেছি। রাজকন্যা, তোমার সবিশেষ পরিচয় পাইয়া, সাতিশয় সন্তষ্ট হইয়াছেন, এবং আমায় অগ্ৰে পাঠাইয়া দিয়া, স্বহস্তে এই সমস্ত প্ৰস্তুত করিয়া, তোমার জন্য প্রেরণ করিয়াছেন। আমায় বলিয়া দিয়াছেন, তুমি আপন সমক্ষে তাঁহাকে মিষ্টান্ন ভোজন করাইয়া আসিবে। অতএব বয়স্য! কিছু ভক্ষণ কর, তাহা হইলে পরম পরিতোষ পাই, এবং যাইয়া তাঁহার নিকটে বলিতে চাই, আমার বন্ধু, মিষ্টান্ন আহার করিয়া, তোমার শিল্পনৈপুণ্যের অশেষপ্রকার প্রশংসা করিয়াছেন।