প্রপিতামহদেব ভুবনেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের পাঁচ সন্তান; জ্যেষ্ঠ নৃসিংহরাম, মধ্যম গঙ্গাধর, তৃতীয় রামজয়, চতুর্থ পঞ্চানন, পঞ্চম রামচরণ। তৃতীয় রামজয় তর্কভূষণ অামার পিতামহ। বিদ্যালঙ্কার মহাশয়ের দেহাত্যয়ের পর, জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম, সংসারে কর্ত্তৃত্ব করিতে লাগিলেন। সামান্য বিষয় উপলক্ষে, তাঁহাদের সহিত কথান্তর উপস্থিত হইয়া, ক্রমে বিলক্ষণ মনান্তর ঘটিয়া উঠিল। জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম সহোদরের অবমাননাব্যঞ্জক বাক্যপ্রয়োগে, তদীয় অন্তঃকরণ নিরতিশয় ব্যথিত হইল। কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া, তিনি কতিপয় দিবস অতিবাহিত করিলেন; অবশেষে, আর এস্থানে অবস্থিতি করা, কোনও ক্রমে, বিধেয় নহে, এই সিদ্ধান্ত করিয়া, কাহাকেও কিছু না বলিয়া, এককালে, দেশত্যাগী হইলেন।
বীরসিংহগ্রামে, উমাপতি তর্কসিদ্ধান্ত নামে অতি প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ছিলেন। ব্যাকরণে সবিশেষ পারদর্শিতা বশতঃ, তর্কসিদ্ধান্ত মহাশয়, রাঢ়দেশে অদ্বিতীয় বৈয়াকরণ বলিয়া, পরিগণিত হইয়াছিলেন। এরূপ কিংবদন্তী আছে, মেদিনীপুরের প্রসিদ্ধ ধনী চন্দ্রশেখর ঘোষ, মহাসমারোহে, মাতৃশ্রাদ্ধ করিয়াছিলেন। শ্রাদ্ধসভায়, নবদ্বীপের প্রধান নৈয়ায়িক প্রসিদ্ধ শঙ্কর তর্কবাগীশ পর্য্যন্ত উপস্থিত হইয়াছিলেন। তর্কসিদ্ধান্ত মহাশয়, স্বীয় ব্যাকরণবিদ্যার বিশিষ্টরূপ পরিচয় দিয়া, তর্কবাগীশ মহাশয়কে সাতিশয় সন্তুষ্ট করেন। তর্কবাগীশ মহাশয়, মুক্তকণ্ঠে, সাধুবাদপ্রদান, ও সবিশেষ আদর সহকারে, আলিঙ্গনদান, করিয়াছিলেন। এই ঘটনা দ্বারা, তর্কসিন্ধান্ত মহাশয়, সর্ব্বত্র, যারপর নাই, মাননীয় ও প্রশংসনীয় হইয়াছিলেন। রামজয় তর্কভূষণ এই উমাপতি তর্কসিদ্ধান্তের তৃতীয় কন্যা দুর্গাদেবীর পাণিগ্রহণ করেন। দুর্গাদেবীর গর্ভে, তর্কভূষণ মহাশয়ের, দুই পুত্র ও চারি কন্যা জন্মে। জ্যেষ্ঠ ঠাকুরদাস, কনিষ্ঠ কালিদাস; জ্যেষ্ঠা মঙ্গলা, মধ্যমা কমলা, তৃতীয়া গোবিন্দমণি, চতুর্থী অন্নপূর্ণা। জ্যেষ্ঠ ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আমার জনক।
রামজয় তর্কভূষণ দেশত্যাগী হইলেন; দুর্গাদেবী, পুত্র কন্যা লইয়া, বনমালিপুরের বাটীতে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। অল্প দিনের মধ্যেই, দুর্গাদেবীর লাঞ্ছনাভোগ, ও তদীয় পুত্র কন্যাদের উপর কর্ত্তৃপক্ষের অযত্ন ও অনাদর, এত দূর পৰ্য্যন্ত হইয়া উঠিল, যে দুর্গাদেবীকে, পুত্রদ্বয় ও কন্যাচতুষ্টয় লইয়া, পিত্রালয় যাইতে হইল। তদীয় ভ্রাতৃশ্বশুর প্রভৃতির আচরণের পরিচয় পাইয়া, তাঁহার পিতা, মাতা, ভ্রাতা প্রভৃতি সাতিশয় দুঃখিত হইলেন, এবং তাঁহার ও তাঁহার পুত্রকন্যাদের উপর যথোচিত স্নেহপ্রদর্শন করিতে লাগিলে। কতিপয় দিবস অতি সমাদরে অতিবাহিত হইল। দুর্গাদেবীর পিতা, তর্কসিদ্ধান্ত মহাশয়, অতিশয় বৃদ্ধ হইয়াছিলেন; এজন্য, সংসারের কর্ত্তৃত্ব তদীয় পুত্র রামসুন্দর বিদ্যাভূষণের হস্তে ছিল। সুতরাং, তিনিই বাটীর প্রকৃত কর্ত্তা, ও তাঁহার গৃহিণীই বাটীর প্রকৃত কর্ত্রী। দেশাচার অনুসারে, তর্কসিন্ধান্ত মহাশয় ও তাঁহার সহধর্ম্মিণী, তৎকালে, সাক্ষিগোপাল স্বরূপ ছিলেন; কোনও বিষয়ে তাঁহাদের কর্ত্তৃত্ব খাটত না; সাংসারিক সমস্ত ব্যাপার, রামসুন্দর ও তাঁহার গৃহিণীর অভিপ্রায় অনুসারেই, সম্পাদিত হইত।
কিছু দিনের মধ্যেই, পুত্র কন্যা লইয়া, পিত্রালয়ে কালযাপন করা দুর্গাদেবীর পক্ষে বিলক্ষণ অসুখের কারণ হইয়া উঠিল। তিনি ত্বরায় বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার ভ্রাতা ও ভ্রাতৃভার্য্যা তাঁহার উপর অতিশয় বিরূপ; অনিয়ত কালের জন্যে, সাতজনের ভরণপোষণের ভারবহনে, তাঁহারা, কোনও মতে, সম্মত নহেন। তাঁহারা দুর্গাদেবী ও তদীয় পুত্রকন্যাদিগকে গলগ্রহবোধ করিতে লাগিলেন। রামসুন্দরের বনিতা, কথায় কথায়, দুর্গাদেবীর অবমাননা করিতে আরম্ভ করিলেন। যখন নিতান্ত অসহ্য বোধ হইত, দুর্গাদেবী স্বীয় পিতা তর্কসিদ্ধান্ত মহাশয়ের গোচর করিতেন। তিনি, সাংসারিক বিষয়ে, বার্দ্ধক্য নিবন্ধন ঔদাসীন্য অথবা কর্ত্তৃত্ববিরহ বশতঃ, কোনও প্রতিবিধান করিতে পারিতেন না। অবশেষে, দুর্গাদেবীকে, পুত্রকন্যা লইয়া, পিত্রালয় হইতে বহির্গত হইতে হইল। তর্কসিদ্ধান্ত মহাশয় সাতিশয় ক্ষুব্ধ ও দুঃখিত হইলেন, এবং স্বীয় বাটীর অনতিদূরে, এক কুটীর নির্ম্মিত করিয়া দিলেন। দুর্গাদেবী, পুত্রকন্যা লইয়া, সেই কুটীরে অবস্থিতি ও অতি কষ্টে দিনপাত করিতে লাগিলেন।
ঐ সময়ে, টেকুয়া ও চরখায় সুত কাটিয়া, সেই সুত বেচিয়া, অনেক নিঃসহায় নিরুপায় স্ত্রীলোক আপনাদের গুজরান করিতেন। দুর্গাদেবী সেই বৃত্তি অবলম্বন করিলেন। তিনি, একাকিনী হইলে, অবলম্বিত বৃত্তি দ্বারা, অবলীলাক্রমে, দিনপাত করিতে পারিতেন। কিন্তু, তাদৃশ স্বল্প আয় দ্বারা, নিজের, দুই পুত্রের, ও চারি কন্যার ভরণপোষণ সম্পন্ন হওয়া সম্ভব নহে। তাঁহার পিতা, সময়ে সময়ে, যথাসম্ভব, সাহায্য করিতেন; তথাপি তাঁহাদের, আহারাদি সর্ববিষয়ে, ক্লেশের পরিসীমা ছিল না। এই সময়ে, জ্যেষ্ঠ পুত্র ঠাকুরদাসের বয়ঃক্রম ১৪।১৫ বৎসর। তিনি, মাতৃদেবীর অনুমতি লইয়া, উপার্জনের চেষ্টায়, কলিকাতা প্রস্থান করিলেন।
সভারাম বাচস্পতি নামে আমাদের এক সন্নিহিত জ্ঞাতি কলিকাতায় বাস করিয়াছিলেন। তাঁহার পুত্র, জগন্মোহন ন্যায়ালঙ্কার, সুপ্রসিদ্ধ চতুর্ভুজ ন্যায়রত্নের নিকট অধ্যয়ন করেন। ন্যায়ালঙ্কার মহাশয়, ন্যায়রত্ন মহাশয়ের প্রিয়শিষ্য ছিলেন; তাঁহার অনুগ্রহে ও সহায়তায়, কলিকাতায় বিলক্ষণ প্রতিপন্ন হয়েন। ঠাকুরদাস, এই সন্নিহিত জ্ঞাতির আবাসে উপস্থিত হইয়া, আত্মপরিচয় দিলেন, এবং কি জন্যে আসিয়াছেন, অশ্রুপূর্ণলোচনে তাহা ব্যক্ত করিয়া, আশ্রয়প্রার্থনা করিলেন। ন্যায়ালঙ্কার মহাশয়ের সময় ভাল, অকাতরে অন্নব্যয় করিতেন; এমন স্থলে, দুর্দ্দশাপন্ন আসন্ন জ্ঞাতিসন্তানকে অন্ন দেওয়া দুরূহ ব্যাপার নহে। তিনি, সাতিশয় দয়া ও সবিশেষ সৌজন্য প্রদর্শন পূর্ব্বক, ঠাকুরদাসকে অাশ্রয়প্রদান করিলেন।