- বইয়ের নামঃ পরকীয়া প্রেম
- লেখকের নামঃ উজ্জ্বল কুমার দাস
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
পরকীয়া প্রেম – উজ্জ্বল কুমার দাস
অনেক অভিধান ঘেঁটে, আমার স্ত্রী-এর নাম রেখেছিল, আমার শ্বশুরমশাই ‘মধুমতী’। তখন অবশ্য সবই জড়পিণ্ড। অয়েল ক্লথের উপর এক টুকরো ছোট কথা আর তার উপর আমার প্রাণের বউ। কিন্তু তিনি যেই ধেড়ে হলেন, ব্যস্!
যখন আমি বিয়ে করবার জন্য আমার স্ত্রীকে প্রথম দেখতে গেলাম তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি নাম আপনার? তখন লাজুক লাজুক মুখে বেশ মিহি সুর টেনে বলল মধুমতী সাহা।
আমার কানে তখন এমন সুর বেজে উঠল, যে মনে মনে বললাম আহা আহা..। কিন্তু বিয়ের তেরাত্তির পেরোতে না পেরোতেই মধুমতীর খোলস ছেড়ে সংসারের সার্কাসে ভানুমতীর খেলা দেখাতে শুরু করে দিল। তখন মধুমতীর কোথায় সেই মধু, আর কোথায় সেই মতি। সব গুবলেট।
তারপর তো কিছুদিন যেতে না যেতেই আমার স্ত্রী-এর শরীরে যাবতীয় রোগের আড্ডা বাসা বাধতে শুরু করল। দিনে দিনে গায়ে গতরে ফুলতে শুরু করল যেন ঠিক বম্বের টুনটুনের দ্বিতীয় সংস্করণ। তারপর এসে উপস্থিত হলো বাত, দন্তশূল, অম্বল ইত্যাদি। সব যেন হাত ধরাধরি করে লাইন ধরে আসছ আর যাচ্ছে। এ যেন এক নিরন্তর গতি। জীবনটা একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে ভাবি বিয়ে করে কিই না ভুল করেছি। কিন্তু এ ভুল সংশোধন করবার কোন উপায় নেই। ভুল সংশোধন কেবলমাত্র পরীক্ষার খাতায় চলে, কিন্তু জীবন খাতায় একদম চলে না।
কিছুদিন হলো আমাদের পাশের দোতালায় হরিহর বাবুর একখানা ঘরে একজন আটাশ-তিরিশ বছরের অবিবাহিতা মহিলা ভাড়া এসেছেন, একলাই থাকেন। ঘরটা আবার আমার শোবার ঘর থেকে বেশ পরিষ্কার দেখা যায়। দেখতে খুব একটা মন্দ নয়। ছুটির দিনে প্রায়ই আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি। একদিন আমার শ্যামলী ও ঘরের মধ্যে হাল্কা সুরে রবীন্দ্রনাথের সেই গানটা গেয়ে চলেছে। আর আমি ওর দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছি। হঠাৎ দেখি আমার পিছনে আমার স্ত্রী মধুমতী কর্কশ সুরে চেঁচিয়ে বলল, কি গো কখন থেকে যে ডাকছি বাজারে কখন যাবে, তা কানে কোন কথাই ঢুকছে না, ঐ দিকে কি অতো মন দিয়ে দেখছ দেখি, বলে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখে শ্যামলী নেচে সেই গানটা গাইছে, ব্যাস–
‘হ্যাঁ, তাইতো’ বলে চোখগুলো বড় বড় করে বলল, আমার কথা শুনবে কি করে, আমি গগাব্যাচারার মতো বললাম কেন কেন কি হয়েছে?
—কি আর হবে, ভাগ্যিস আমি দেখলাম। আরো পরে দেখলে কি সর্বনাশই না হয়ে যেত।
-কেন কি সর্বনাশ?
—দেখো অত ন্যাকামো কোর না তো। সকাল বেলা ঐ জানলা দিয়ে ঐ ছুঁড়িটার নাচ দেখছিলে না? ভাবো আমি কিছু বুঝি না? ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না।
সব বৌ-এরই এই একই রোগ, নিজের শাড়ীর মতো নিজের স্বামীটিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করে অন্য কেউ তা গায়ে জড়াক তা তারা মোটেই পছন্দ করেন না।
থাক্ স্ত্রীর ধাতানী খেয়ে লুঙ্গির উপর পাঞ্জাবীটা গলিয়ে বাজারের থলিটা নিয়ে বাজারের দিকে রওনা দিচ্ছি। ঠিক এমন সময় রান্না ঘর থেকে সাতবাড়ী শুনিয়ে মধুমতী বলল রুই মাছের মাথা এনো কিন্তু।
মাসের শেষ, রুই মাছের মাথা, মনে মনে গালাগাল দিয়ে বললাম, রুই মাছের মাথা না এনে তোমার মাথা আনবে। বলে বেরিয়ে এলাম।
রাস্তায় নেমেই আবার চোখটা চলে গেল সেই হরিহরবাবুর দোতলার বারান্দায়। তাকিয়ে দেখি শ্যামলী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। পিঠে ছড়িয়ে আছে একরাশ কালো চুল। যেন কোন তেল কোম্পানীর বিজ্ঞাপনের মডেল। আমার দিকেই চোখ পড়তেই শ্যামলীর ঠোঁটে একটু হাসি খেলে গেল। হঠাৎ আবার মধুমতীর কথা মনে পড়তেই, পেছনের দিকে আমার বাড়ীর বারান্দায় তাকিয়ে দেখলাম মধুমতী দাঁড়িয়ে আছে কিনা। না নেই। তাই আমিও শ্যামলীর দিকে একটু মুচকী হেসে বাজারের দিকে রওনা হলাম।
প্রতি রবিবারই বাজার সেরে আবার সময় শম্ভুর দোকানে কাঁচাপাকা দাড়িগুলো একটু কমিয়ে আসি। সেদিনও শম্ভুর দোকানে গিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে বসলাম। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে কিরকম বুড়ো বুড়ো বলে মনে হলো। সারা। মাথায় কাঁচাপাকা চুলে ভর্তি। গালে এক গাল পাকা দাড়ি। পাকা চুল নিয়ে আর যা কিছু করা যায় কোন সুন্দরী যুবতীর হৃদয় কখনই জয় করা যায় না। স্বামীর চুল পেকে গেল, বৌরাই ম্যানম্যান করে আর প্রেমিকা! ওরা তো পাত্তাই দেবে না। যাই হোক শম্ভুকে বাকীতে চুলটা ভালো করে কলপ করিয়ে নিয়ে, মুখের দাড়ি কেটে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজকে দেখে নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না। বয়স যেন অনেক কমে গেছে। যাই হোক খোশ মেজাজ নিয়ে বাড়ীর দিকে রওনা দিলাম।
বাড়ীতে গিয়ে পৌঁছলাম বেলা এগারোটা। আমার পায়ের শব্দ শুনেই মধুমতী মধু বর্জন করে চীৎকার করে বলল, কি হলো বাজারে গিয়ে কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?
—তোমার মাথা আনতে গিয়ে সরি; রুই মাছের মাথা আনতে গিয়ে দেরী হয়ে গেল।
মধুমতী কথা বলতে বলতে আমার দিকে তাকিয়ে একবারে ‘থ’। তারপর বলল একি পাকা চুল কালো, হলো কি করে? কলপ করেছ নাকি?
আমি তাড়াতাড়ি খুশি হয়ে বললাম, আমায় বেশ যুবক যুবক মনে হচ্ছে না?
–যুবক! তোমায় ঠিক দাঁড়কাকের মতো দেখাচ্ছে। ময়ূরের পুচ্ছ লাগালে যেমন দাঁড়কাক ময়ূর হয় না, তেমন আধবুড়ো পাকা চুলে কলপ দিলে যুবক হয় না।