- বইয়ের নামঃ পরকীয়া প্রেম
- লেখকের নামঃ উজ্জ্বল কুমার দাস
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
পরকীয়া প্রেম – উজ্জ্বল কুমার দাস
অনেক অভিধান ঘেঁটে, আমার স্ত্রী-এর নাম রেখেছিল, আমার শ্বশুরমশাই ‘মধুমতী’। তখন অবশ্য সবই জড়পিণ্ড। অয়েল ক্লথের উপর এক টুকরো ছোট কথা আর তার উপর আমার প্রাণের বউ। কিন্তু তিনি যেই ধেড়ে হলেন, ব্যস্!
যখন আমি বিয়ে করবার জন্য আমার স্ত্রীকে প্রথম দেখতে গেলাম তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি নাম আপনার? তখন লাজুক লাজুক মুখে বেশ মিহি সুর টেনে বলল মধুমতী সাহা।
আমার কানে তখন এমন সুর বেজে উঠল, যে মনে মনে বললাম আহা আহা..। কিন্তু বিয়ের তেরাত্তির পেরোতে না পেরোতেই মধুমতীর খোলস ছেড়ে সংসারের সার্কাসে ভানুমতীর খেলা দেখাতে শুরু করে দিল। তখন মধুমতীর কোথায় সেই মধু, আর কোথায় সেই মতি। সব গুবলেট।
তারপর তো কিছুদিন যেতে না যেতেই আমার স্ত্রী-এর শরীরে যাবতীয় রোগের আড্ডা বাসা বাধতে শুরু করল। দিনে দিনে গায়ে গতরে ফুলতে শুরু করল যেন ঠিক বম্বের টুনটুনের দ্বিতীয় সংস্করণ। তারপর এসে উপস্থিত হলো বাত, দন্তশূল, অম্বল ইত্যাদি। সব যেন হাত ধরাধরি করে লাইন ধরে আসছ আর যাচ্ছে। এ যেন এক নিরন্তর গতি। জীবনটা একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে ভাবি বিয়ে করে কিই না ভুল করেছি। কিন্তু এ ভুল সংশোধন করবার কোন উপায় নেই। ভুল সংশোধন কেবলমাত্র পরীক্ষার খাতায় চলে, কিন্তু জীবন খাতায় একদম চলে না।
কিছুদিন হলো আমাদের পাশের দোতালায় হরিহর বাবুর একখানা ঘরে একজন আটাশ-তিরিশ বছরের অবিবাহিতা মহিলা ভাড়া এসেছেন, একলাই থাকেন। ঘরটা আবার আমার শোবার ঘর থেকে বেশ পরিষ্কার দেখা যায়। দেখতে খুব একটা মন্দ নয়। ছুটির দিনে প্রায়ই আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি। একদিন আমার শ্যামলী ও ঘরের মধ্যে হাল্কা সুরে রবীন্দ্রনাথের সেই গানটা গেয়ে চলেছে। আর আমি ওর দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছি। হঠাৎ দেখি আমার পিছনে আমার স্ত্রী মধুমতী কর্কশ সুরে চেঁচিয়ে বলল, কি গো কখন থেকে যে ডাকছি বাজারে কখন যাবে, তা কানে কোন কথাই ঢুকছে না, ঐ দিকে কি অতো মন দিয়ে দেখছ দেখি, বলে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখে শ্যামলী নেচে সেই গানটা গাইছে, ব্যাস–
‘হ্যাঁ, তাইতো’ বলে চোখগুলো বড় বড় করে বলল, আমার কথা শুনবে কি করে, আমি গগাব্যাচারার মতো বললাম কেন কেন কি হয়েছে?
—কি আর হবে, ভাগ্যিস আমি দেখলাম। আরো পরে দেখলে কি সর্বনাশই না হয়ে যেত।
-কেন কি সর্বনাশ?
—দেখো অত ন্যাকামো কোর না তো। সকাল বেলা ঐ জানলা দিয়ে ঐ ছুঁড়িটার নাচ দেখছিলে না? ভাবো আমি কিছু বুঝি না? ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না।
সব বৌ-এরই এই একই রোগ, নিজের শাড়ীর মতো নিজের স্বামীটিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করে অন্য কেউ তা গায়ে জড়াক তা তারা মোটেই পছন্দ করেন না।
থাক্ স্ত্রীর ধাতানী খেয়ে লুঙ্গির উপর পাঞ্জাবীটা গলিয়ে বাজারের থলিটা নিয়ে বাজারের দিকে রওনা দিচ্ছি। ঠিক এমন সময় রান্না ঘর থেকে সাতবাড়ী শুনিয়ে মধুমতী বলল রুই মাছের মাথা এনো কিন্তু।
মাসের শেষ, রুই মাছের মাথা, মনে মনে গালাগাল দিয়ে বললাম, রুই মাছের মাথা না এনে তোমার মাথা আনবে। বলে বেরিয়ে এলাম।
রাস্তায় নেমেই আবার চোখটা চলে গেল সেই হরিহরবাবুর দোতলার বারান্দায়। তাকিয়ে দেখি শ্যামলী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। পিঠে ছড়িয়ে আছে একরাশ কালো চুল। যেন কোন তেল কোম্পানীর বিজ্ঞাপনের মডেল। আমার দিকেই চোখ পড়তেই শ্যামলীর ঠোঁটে একটু হাসি খেলে গেল। হঠাৎ আবার মধুমতীর কথা মনে পড়তেই, পেছনের দিকে আমার বাড়ীর বারান্দায় তাকিয়ে দেখলাম মধুমতী দাঁড়িয়ে আছে কিনা। না নেই। তাই আমিও শ্যামলীর দিকে একটু মুচকী হেসে বাজারের দিকে রওনা হলাম।
প্রতি রবিবারই বাজার সেরে আবার সময় শম্ভুর দোকানে কাঁচাপাকা দাড়িগুলো একটু কমিয়ে আসি। সেদিনও শম্ভুর দোকানে গিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে বসলাম। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে কিরকম বুড়ো বুড়ো বলে মনে হলো। সারা। মাথায় কাঁচাপাকা চুলে ভর্তি। গালে এক গাল পাকা দাড়ি। পাকা চুল নিয়ে আর যা কিছু করা যায় কোন সুন্দরী যুবতীর হৃদয় কখনই জয় করা যায় না। স্বামীর চুল পেকে গেল, বৌরাই ম্যানম্যান করে আর প্রেমিকা! ওরা তো পাত্তাই দেবে না। যাই হোক শম্ভুকে বাকীতে চুলটা ভালো করে কলপ করিয়ে নিয়ে, মুখের দাড়ি কেটে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজকে দেখে নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না। বয়স যেন অনেক কমে গেছে। যাই হোক খোশ মেজাজ নিয়ে বাড়ীর দিকে রওনা দিলাম।
বাড়ীতে গিয়ে পৌঁছলাম বেলা এগারোটা। আমার পায়ের শব্দ শুনেই মধুমতী মধু বর্জন করে চীৎকার করে বলল, কি হলো বাজারে গিয়ে কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?
—তোমার মাথা আনতে গিয়ে সরি; রুই মাছের মাথা আনতে গিয়ে দেরী হয়ে গেল।
মধুমতী কথা বলতে বলতে আমার দিকে তাকিয়ে একবারে ‘থ’। তারপর বলল একি পাকা চুল কালো, হলো কি করে? কলপ করেছ নাকি?
আমি তাড়াতাড়ি খুশি হয়ে বললাম, আমায় বেশ যুবক যুবক মনে হচ্ছে না?
–যুবক! তোমায় ঠিক দাঁড়কাকের মতো দেখাচ্ছে। ময়ূরের পুচ্ছ লাগালে যেমন দাঁড়কাক ময়ূর হয় না, তেমন আধবুড়ো পাকা চুলে কলপ দিলে যুবক হয় না।
শুনলেন তো, আমার স্ত্রীর কথা। সব সময়ই বাঁকা বাঁকা কথা। কোথায় একটু আমায় যুবক বলে প্রেরণা দেবে, তা না, শুধু ব সময় খোঁচা মেরে কথা।
আজকাল একটু স্মার্ট হয়ে চলতে চেষ্টা করি। মেয়েরা আবার একেবারে ল্যালাক্যাবলা ছেলে একেবারেই পছন্দ করে না। তাই ধুতির বদলে একটু প্যান্ট সার্ট সঙ্গে বুট পরে অফিসে বেরই। এই দেখেও স্ত্রী-এর মনে জ্বালা। হঠাৎ একদিন বলল, কি হয়েছে বলতো। তোমায় আজকাল প্রায়ই লক্ষ্য করি বুড়ো বয়সে ছোঁড়া সাজবার সখ হয়েছে। প্রেমে টেমে পড়লে নাকি।
আমি একগাল হেসে বললাম, ঘরে এমন সুন্দরী থাকতে, অন্যদিকে কি করে তাকাই। আর তাছাড়া এখন কি আর প্রেমের বয়স আছে। অমনি গিন্নী মুখ বেঁকিয়ে উত্তর দেয়, ছ্যা প্রেমের আবার বয়স। তোমাদের পুরুষ জাতটাকে একদম বিশ্বাস করি না। যত বুড়ো হয় তত বেশী বজ্জাত হয়।
অমনি আমার মাথাটা টগবগিয়ে ফুটে উঠল। দেখ জাতটাত তুলে কথা বলবে না। আর তাছাড়া তোমার মতো এরকম খিটির-মিটির করা বউ ঘরে থাকলে, স্বামীরা তো বিগড়ে যাবেই।
আমার কথা শেষ হতে না হতেই আমার মধুমতী গর্জে উঠে এমন বলল, কি আমি তোমার সাথে খিটির মিটির করি। এই আওয়াজে পাড়ায় যেন একটা ছোটখাটো ভূমিকম্প হয়ে গেল।
থাক পরদিন অফিসে বেরোচ্ছি, ঠিক এই সময় আমার গিন্নী আবার গ্যাসের চোতাটা ধরিয়ে দিল, যাওয়ার সময় একটু বুক করে যেতে। ব্যাস্! অফিসের বারোটা, ভাগ্যিস সরকারী অফিরে কেরানী।
তারপর নাচতে নাচতে গিয়ে হাজির হলাম গ্যাস দাদার কাছে। পাড়ার কাছে একটা বাড়ির গ্যারেজ ঘরে গ্যাস ঘর। ঐ ঘরে একটা টেবিল চেয়ারে নিয়ে বসে আছেন। আমাদের গ্যাস দাদা, আর তার সামনে এক বিশাল লাইন। গ্যাসের লাইনে বাই প্রশ্ন কর্তা আর সব প্রশ্নেরই উত্তর দিয়ে চলেছে গ্যাস দাদা। সব প্রশ্ন কর্তারই একই প্রশ্ন দাদা কবে পাঠাচ্ছেন? বাচ্চারা কাদলে যেমন বড়রা টফি নিয়ে বলে আর কেঁদো না সোনা! আর কেঁদো না।চ ঠিক তেমনি গ্যাস দাদা বাইকে বলে চলেছেন এই দু-চার দিনের মধ্যেই পেয়ে যাবেন। ছেলেদের লাইনের সাথে ফুরফুরে সব সুন্দরী মহিলাদের লাইন। সব নতুন সংসার করছে। স্বামীরা সব অফিসে বেরিয়েছে। আর গিন্নীরা সুন্দর পারফিউম মেখে গ্যাসের দোকানে লাইন। হঠাৎ দেখি লাইনে সেই আমার পাশের বাড়ির শ্যামলী।
শ্যামলীকে দেখেই মনটা কি রকম পাক দিতে শুরু করল। কি করে শুরু করি কথা, যদি কথা বলতে গিয়ে কোন অসংলগ্ন কথা বলে ফেলি, তাহলে তো আর রক্ষা নেই। এই বয়সে পাবলিকের হাতে মার খেয়ে আমাকে এই ধরাধাম ত্যাগ করতে হবে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখি আমার পায়ের সামনে একটা সুন্দর রুমাল পড়ে আছে। আমি তাড়াতাড়ি তুলে শ্যামলীর দিকে হাসি হাসি মুখ করে বললাম, এটা কি আপনার?
শ্যামলীও হাসির বিনিময়ে হাসি দিয়ে বলল, হ্যাঁ আমার। তারপর আমার হাত থেকে রুমালটা নিল। রুমালটা নেওয়ার সময় শ্যামলীর নরম নরম হাতের ছোঁয়ায় আমার শরীরের রক্তে এক শিহরণ খেলে গেল।
তারপর ধীরে ধীরে শ্যামলীর সাথে আলাপ জমাতে শুরু করলাম। আর মনে মনে আমার মধুমতীকে ধন্যবাদ দিলাম। মধুমতী যদি আমায় আজ এই গ্যাসদাদার কাছে না পাঠাত তাহলে শ্যামলীর সাথে আলাপ করার সুযোগই পেতাম না। কিছুক্ষণের মধ্যই আমাদের দুজনেরই গ্যাসদার সাথে কথা চুকে গেল। তারপর ঐ গ্যারেজ ঘর থেকে কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে এবং দিয়ে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়ালাম।
শ্যামলী আমায় জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথায় যাবেন?
—আমি ডালহাউসী।
—ভালই হলো আমিও ঐ পথেই যাব। চলুন একসাথে যাওয়া যাক। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়ালাম বাস স্ট্যাণ্ডে তখন লোকে লোকারণ্য। সবাই বাসে উঠবে। বাস আসছে, কিন্তু তাতে খুব কম লোকই উঠতে পারছে। বেশীর ভাগ বাসই বাদুড় ঝোলা।
তারপর অনেক কষ্টে একটা বাসের মধ্যে আমি আর মধুমতী দেহের কসরৎ দেখিয়ে উঠলাম। বাসে আর তিল ধারণের জায়গা নেই। শ্যামলীর শরীরটা আমার শরীরের উপর লেপটে আছে। আমার বুকের উপর পড়ে আছে ওর সুগন্ধী একরাশ কালো চুল। তার গন্ধে আমি মোহিত হয়ে উঠেছি। জীবনটা যেন মনে হচ্ছে কবিতা। হঠাৎ মনে হয় একি করছি আমি। এ পাপ। ঘরে আমার স্ত্রী আছে। শ্যামলীর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চাই। কিন্তু নিরুপায়। বাসের ভীড়ে এপাশ থেকে ওপাশ হবার উপায় নেই। কি সুন্দর নরম তুলতুলে শরীর। মনে হয় যেন ভগবান মোম আর মাখন মিশিয়ে শ্যামলীর শরীর তৈরী করেছেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে হাজির হলাম ডালহাউসী। সময় যেন হুহু করে চলে গেল। রোজ বাসে যেতে যেতে জ্যামে পড়তে হয়। কিন্তু আজ একদম জ্যাম নেই। বাস থেকে আগে নেমে রাস্তায় পা রেখেছি। শ্যামলী নামতে গিয়ে হঠাৎ দেখি পড়ে যাচ্ছে, আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে হাতটা এগিয়ে দিলাম। আমার হাতের উপর ভর দিয়ে টালটা সামলে নিল। এদিকে আমার হাতটাও ধন্য হলো।
তারপর দুজনে নেমে কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেলাম। আমি আমার অফিসে ঢুকে গেলাম, আর আমার অফিসের পাশের বিল্ডিং-এ একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করে শ্যামলী। সত্যি একথা ভাবা যায় না। যাক আসবার সময় আবার আমরা দুজনে। ফিরি। শ্যামলীর অফিসে রোজ নটায় হাজিরা। কিন্তু আমার সরকারী অফিস যখন হোক গেলেই হয়। বডিটাকে একসময় অফিসের মধ্যে শো করতে পারলেই ব্য। মাঝে মাঝে অবশ্য অফিসের হেডক্লার্ক যাকে আমরা সম্মান দিয়ে বড়বাবু বলি তিনি আমায় অনেকদিন বলেছেন যে একটু তাড়াতাড়ি আসবেন। কিন্তু আমি ওসব কথা কোনদিনই কর্ণপাত করিনি। এ পৃথিবীতে বাঁচতে গেল সব কথা কানে শুনতে নেই। যদিও তা ঢোকাই তা অপর কান দিয়ে আবার বাতাসে ছেড়ে দি। আমার দেরীতে আসার সুবাদে অনেকই আমায় মাঝে মাঝে রঙ্গ রসিকতা করে (অর্থাৎ যার অপর কথা টিপ্পনী কেটে) আমার নাম দিয়েছিল ‘লেটুবাবু’। কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি যেমন চলছি তেমন চলব। চাকরীতে যাওয়ার কোন ভয় নেই। এতো আর প্রাইভেট ফার্ম না। যে একটু দেরী হলেই মাইনে কাটা। তার পরেও যদি বেয়াদপি করি, চাকরী নট। এ হচ্ছে সরকারী অফিস। একদিনের কাজ দশদিনে করবো, মাঝে মাঝে ওভারটাইম করবো। আর মাঝে মাঝে অফিস থেকে মাইনে বাড়ানোর দাবীতে বিরাট মিছিল করে সারা কলকাতার বুকে ট্রাফিক জাম করে অবশেষে এসপ্ল্যানেড ইষ্টে বিরাট জনসমাবেশে যোগ। বড় বড় নেতাদের বড় বড় বুলি। আমি অবশ্য বড় বড় নেতা না হলেও ন্যাতা তো বটে। অফিসে রাজনীতি করি। তাই রাজনীতি নেতাদের আজকাল খুব একটা কেউ খাটতে চায় না। একটা প্রচলিত কথা আছে যে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা, আর আজকাল রাজনীতির দাদারা ছুঁলে একশ ঘা।
যাক্ আপনাদের সামনে আমার উপর বৈপ্লবিক চরিত্রের পরিচয়টা দিতে চাই না।
এবার আমার ফুলটুসি, আমার প্রাণকুমারী শ্যামলির কথা বলি। এখন রোজই সকাল আটটার মধ্যে বাস-স্ট্যাণ্ডে পৌঁছে যাই। ঐসময় শ্যামলীও বাসে ওঠে। একই সাথে দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কখনো বা ভাগ্যে কুলোলে পাশাপাশি বসে দুজনে সুখ দুঃখের কথা বলতে বলতে অফিসে যাই। এ যে কি থ্রিলিং তা ঠিক মুখে বলা যায় না।
আমাকে এত সকাল সকাল দেখে অফিসের লোকেরা তো একেবারে ‘থ’। কি হলো! আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলো এর রহস্য। কিন্তু সত্যি কথাটা বলতে পারলাম না।
অফিসে থেকে ফেরার সময়ও প্রায়ই আমরা একটুখানি হেঁটে আউটট্রাম ঘাটে গিয়ে পাশাপাশি বসতাম। নানারকম কথা বলতাম। সিনেমা হলের অন্ধকারে বসে ওর দিকে হাত বাড়ালাম। শ্যামলী অবশ্য এসব কিছু আপত্তি করত না। মনে হত শ্যামলীও বোধ হয় আমাকে ভালবাসতে চাইছে। কেউ কি কোনদিন একা বাঁচতে পারে। সবাই সঙ্গ চায়, সঙ্গী সঙ্গীনী চায়। প্রায়ই লক্ষ্য করতাম, শ্যামলীর মধ্যে একটা পাপের প্রবল আকর্ষণ আছে।
মধুমতী দু-চারদিনের জন্য তার পিত্রালয়ে গেছেন আমিও একেবারে ঝাড়া হাত পা। একদিন রবিবার শ্যামলী আমায় সকালে চা জলখাবার নিমন্ত্রণ করেছে। সকাল সকালই চলে গেছি। গিয়ে দেখি চারদিক নিস্তব্ধ। কাউকে না ডেকেই ঘুরে ঢুকে দেখলাম। শ্যামলী বড় লোভনীয় ভঙ্গীতে বিছানায় শুয়ে আছে। বুকের ওপর থেকে শাড়ির আঁচলখানা সামান্য সরানো। পরনে লাল রঙের ব্লাউজ। শরীরটা যেন সেই ব্লাউজ ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। উত্তেজনায় বুকের ভেতরটা কিরকম ওঠা-নামা করছে। কি করব বুঝতে পারছি না। হঠাৎ আমার পায়ের আওয়াজ শ্যামলী চোখ মেলে তাকাল। তাকিয়েই আমার জিজ্ঞেস করল, কি কতক্ষণ এসেছেন?
-এই এইমাত্র আপনি ঘুমোচ্ছেন দেখে আমি আর ডাকিনি। এই একটাই তো ছুটির দিন।
তারপর শ্যামলী এক মারাত্মক ভঙ্গীতে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। আমি সেই সুযোগে শ্যামলীর গোপন জায়গাগুলো দেখবার অবকাশ পেলাম। আমাকে বসিয়ে রেখে শ্যামলী কলঘরে গেল। তারপর বেশ ফ্রেস হয়ে এসে আমায় জিজ্ঞেস করল, কি চা না কফি? আমি উত্তর দিলাম কফি আমার উত্তর নিয়ে আবার জোরাল গতিতে কিচেনে চলে গেল। ইতিমধ্যে খবরের কাগজওয়ালা ছুড়ে কাগজখানা ঘরে দিয়ে গেল। একটু হলেই আমার নাকে এসে লাগত। ভাগ্য ভালো লাগেনি। খবরের কাগজখানা তুলে পড়তে লাগলাম। ইতিমধ্যে শ্যামলী চা আর অন্য খাবার নিয়ে এসে হাজির।
শ্যামলী একগাল হেসে বলল, নিন, খেয়ে নিন।
আমি তো খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে অবাক। আমি ভদ্রতার খাতিরে হেসে বললাম, আমার জন্য আবার কষ্ট করে এতসব করতে গেলেন কেন?
—না কষ্ট কিসের, আমার আবার নিত্যনতুন খাবারদাবার তৈরী করতে খুব ভালো লাগে। তখন আমার মধুমতীর কথা মনে পড়ল। মধুমতীর কাছে সকালে সামান্য একটু চা চাই। তার বদলে পাই এক কাপ ঘৃণা।
আমার চোখ দুটো ঐ খাবরের প্লেটের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। ধীরেধীরে খাবারগুলোকে আমার নরম আঙুল দুটো মুখের ভেতরে চালান করে দিতে লাগল। তারপর এল রসবড়া। আমি মুখে পুরে দিয়ে বললাম দারুণ হয়েছে। এ যেন ঠিক মনে হচ্ছে প্রেমের রসবড়া।
আমার কথা শুনে শ্যামলী তো হেসে কুটি পাটি।
-কেন ভুল কথা বললাম।
—না তা কেন! আপনি বেশ মজার মজার কথা বলতে পারেন বটে।
তারপর খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ। এবার আমি আর শ্যামলী গল্পের পর্বে বসেছি। শ্যামলী বিছানায় আর আমি হাত কয়েক দূরে সোফাতে গাটাকে এলিয়ে বসেছি। গল্পের মাঝ মাঝে শ্যামলী বিছানায় গড়াতে গড়াতে এমন এক একটা ভঙ্গী করছে, যেটা অনেক সময় বাজারের কোন চালু বিজ্ঞাপনে দেখা যায়। আর উত্তেজনায়। আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন ভরাট হয়ে উঠছে। আমি তাড়াতাড়ি একটা সিগারেট ধরিয়ে উত্তেজনা কাটাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ফল হলো না।
আবার কথা একথা থেকে সে কথা, আর সে কথা থেকে একথা। শ্যামলীর বুকের নীচে একটা নরম বালিশ। দু কনুই বিছানার উপর গেঁথে রাখা। হাতের চেটোয় মুখখানাকে ধরে রাখা। ঘাড়ের পাশ দিয়ে কালো চুলের ঢল নেমে এসে গড়িয়ে পড়েছে বালিশের উপর। পা দুটোকে ভঁজ করে একটু একটু করে দোলাতে শুরু করেছে শ্যামলী। শাড়িটা কুঁচিয়ে হাঁটু অবধি এগিয়ে আসায় শুভ্র নরম পা দুটোকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে। ও দুটোকে জড়িয়ে ধরে খেলা করতে ইচ্ছে করছিল। অথচ নড়বার ক্ষমতা তখন হারিয়ে ফেলেছি। বুকের ভেতরটা টেনশনে দপদপ কেমন যেন একটা উত্তেজক শব্দ শুরু হয়ে গিয়েছিল। শ্যামলী শরীর দেখাতে জানে। অপরের শরীরে আগুন ধরাতেও জানে।
আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি। আর ঠিক সেই সময় শ্যামলী আবার অন্য পোজ দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে বাঁকা হয়ে একপাশে নিজেকে ঝুলিয়ে দিয়ে দুষ্ট-মিষ্টি ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, হাঁ করে তাকিয়ে কি দেখছেন?
আমি যে শ্যামলীর কাছে ধরা পড়ে গেছি তা আর বুঝতে দেরি হলো না। আমি তাই আমার…ঢাকবার জন্য আমতা আমতা করে বললাম, কৈ কিছু না তো।
—কিছু না তো মানে, এতক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে দেখছিলেন। আপনার না বয়স হয়েছে। আপনার ঘরে স্ত্রী আছে।
একথা শুনে না আমার মাথা দিয়ে আগুন বেরোতে শুরু করল। ঘরে স্ত্রী আছে ঠিক কথা। কিন্তু আমার বয়স তুলে কথা বললে ভীষণ খারাপ লাগে। আমার কি এমন বয়স হয়েছে। দু-একটা চুল পেকেছে। কিন্তু সে তো আমি কলপ করে চুল কালো করে দিয়েছি। তুমিই বা কি এমন কচি খুকি? তোমার বয়সও তো পেকেছে। চামড়ার চেকনাইকে কসমেটিক দিয়ে বাড়াতে হয়। যেসব জায়গায় তোমার যৌবন, সে সব জায়গাগুলোও সামান্য ঝুলে পড়েছে। তুমি কি ভাব তোমার আর সে বাজার আছে। যে তোমাকে দেখে দুনিয়ার যুব সমাজ হামলে পড়বে। আমার বউটা নেহাত আমায় গাল-মন্দ দেয়। একটু সোহাগ টোহাগ করে না। তার উপর অনেকদিনের পুরনো মাল। তাই একটু নূতনের স্বাদ পাবার জন্য তোমার কাছে আসা। না হলে, তোমার কাছে আমার আসতে বয়েই গেছে।
আমার উপরিউক্ত কথাগুলো অবশ্য সবই মনে মনে। ভাষায় প্রকাশ করলেই এক্ষুণি এমন এক ক্যাঁত করে লাথি কষাবে না। পাক খেতে খেতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে সেই নর্দমায়। তার থেকে চুপ মেরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। আর তাছাড়া মেয়েছেলের কথায় বেশী কান দিতে নেই। কান দিলেই অশান্তি।
আমি আবার খুব শান্তিপ্রিয় মানুষ। তাই আমি যুদ্ধ নয় শান্তি চাই। যাক শ্যামলীর সাথে কথা না বাড়িয়ে একটু চা খাবার প্রস্তাব রাখলাম।
শ্যামলী তাড়াতাড়ি চা তৈরী করতে গেল। হঠাৎ একটা উঃ উঃ করে শব্দ। আমি তাড়াতাড়ি রান্না ঘরের দিকে ছুটে গেলাম। গিয়ে দেখি বাঁ হাত দিয়ে ডানহাত খানা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে যন্ত্রণার ছাপ। চোখ ছলছল।
আমি তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে? কোথাও পুড়ে গেল নাকি?
শ্যামলী ডান হাতের মাঝখানটা দেখিয়ে বলল, এই যে এইখানটা পুড়ে গেছে। জ্বালা করছে।
পুড়ে যাবার বিশেষ লক্ষণ আমার অবশ্য চোখে পড়ল না হাতের মাঝখানে সামান্য একটু ফোঁসকা।
তবুও দরদী কণ্ঠে বললাম, ইস খুব জ্বালা করছে তাই না? কি করে পুড়ল?
—এই একটু পাঁপড় ভাজতে গিয়েছিলাম, আর তেল ছিটকে এসে পড়েছে।
-কি দরকার ছিল। একটু আগেই তো এত সব খেলাম এখন শুধু চা হলেই হতো।
—থাক্ চলুন।
বার্নল জাতীয় মলম আছে?
-হ্যাঁ আছে, কিন্তু ও তো লাগালে খুব জ্বলবে।
–আরে, না না আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।
তারপর আমি শ্যামলীকে রান্নাঘর থেকে এনে ধীরে ঘীরে নরম বিছানায় শুইয়ে দিলাম। সামনের দিকে প্রসারিত হয়ে আছে শ্যামলীর নগ্ন হাত। আমি বার্নলের টিউব থেকে মলম নিয়ে হাতে বার কয়েক ঘষতেই হারে জ্বালাটা কমে গেল। শ্যামলী মিষ্টি হেসে বলল, আপনি বেশ যাদু জানেন দেখছি। আমার জ্বালাটা অনেকটা কমে গেছে।
—আপনার জ্বালা জুড়োবার জন্যই তো আমার বেঁচে থাকা। যেদিন থেকে শুনেছি আপনার প্রেমিক আপনাকে ধোঁকা দিয়ে চলে গেছে। আর সেই দুঃখে আপনি এখনো বিয়ে করেন নি। সেদিন থেকেই বুঝেছি আপনার কত দুঃখ, কত জ্বালা।
শ্যামলী বলল, নিন্ এবার হাতটা ছাড়ুন, অনেকক্ষণ ধরে আছেন।
—হাতটা ছাড়তে প্রাণ চায় না, মনে হয় চিরকাল ধরে রাখি। কি সুন্দর আপনার হাতখানা, কি নরম। ঠিক মাখনের মতো।
শ্যামলী মুচকি হেসে বলল, তাই নাকি! আপনার স্ত্রী-এর হাতও তো ঠিক এইরকম তাই না।
—কি যে বলেন। সে হাত শিলনোড়ার মতো শক্ত পাথর। আদর করে ধরলে হারে মালিক খ্যাক করে ওঠে।
আমার কথা শুনে শ্যামলী বলল, আপনারও খুব দুঃখ তাই না।
—হ্যাঁ কে আর বুঝলো বলুন।
এদিকে শ্যামলী আমার পাশে এসে, গায়ে গা লাগিয়ে বসেছে। আর তখনই আমার একমাত্র স্ত্রী মধুমতীর কথা মনে পড়ছে। গায়ে গায়ে শ্যামলী। ত্বকে ত্বকে শ্যামলী, দেহের উত্তাপ, চুলের সুগন্ধা, শরীরের পাহাড়-পর্বত উপত্যকায়।
ধ্যাত তেরিকা মধুমতী মোটা, অম্বল, বাতের রুগী। ধীরে ধীরে আমার একটা হাত শ্যামলীর কাঁধ আর খোঁপার ওপর দিয়ে ঘুরে গিয়ে আঙুলগুলো ওপাশের বুকের ওপর খেলা করছে। এদিকে শাড়ির একটা দিক খুলে পড়েছে। শ্যামলীর বিশাল খোঁপাসহ মাথা আমার কাঁধে। উত্তেজিত গরম নিঃশ্বাসে আমার বুক ওঠা নাম করছে, খোঁপা খুলে গেছে, তখন আমি ভাবছি, শ্যামলী কি সুন্দরী।
শ্যামলীর লাল টুকটুকে ঠোঁটের ওপর আমার তৃষ্ণার্ত ঠোঁট। আমার জিভ ক্ষুধার্তভাবে চলে এলো শ্যামলীর সুগন্ধী মুখের ভেতরে। ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে লাগলো সুন্দর সারিবদ্ধ দাঁত, জিভ, ঠোঁটের ভেতরের নরম জমি। এতে শুধু সুখ নয় স্বর্গসুখ। ঘরের বউকে ছেড়ে অন্য মেয়ের সাথে…বেশ ভালই লাগে।
আমি শ্যামলীর কানের কাছে মুখ রেখে বলি, শ্যামলী তুমি কি দারুণ। আমার কথা শুনে শ্যামলী খিলখিল করে হেসে ওঠে।
আর তখনই আমার চুলের পেছনের দিকে একটা প্রচণ্ড টান অনুভব করি। ঐ টানেই আমার দেহখানি শ্যামলীর দেহ থেকে আলাদা হয়ে সোজা মাটিতে দাঁড়িয়ে পড়ি। তারপর পিছনে ফিরে দেখি আমার বিয়ে করা একমাত্র স্ত্রী মধুমতী।
মধুমতী আমায় শ্যামলীর সাথে এই অবস্থায় দেখতে পেয়ে ব্যাস! শুরু করে দিলেন—
ও শ্যামলীর সাথে এত দূর। আমাকে বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দিয়ে মেয়েছেলে নিয়ে ফুর্তি। আজই আমি গায়ে কোরোসিন ঢেলে দিয়ে আগুন দিয়ে দেবো। তখন বুঝবে ঠ্যালা। কত ধানে কত চাল, স্ত্রী হত্যার দায়ে জেলের ঘানি টানতে হবে বারো বছর।
তা অবশ্য ঠিক কথা। স্ত্রী এখন জনগণের সম্পত্তি। গায়ে একটু আঁচড় লাগলেই প্রথমে জনগণের প্যাদানি। তারপর আদালতের কাঠগড়া। কিন্তু ওনারা আমার মাকে কাশীবাসী করাবেন। আমাকে সারা জীবন হামনদিস্তেয় ফেলে পিষবেন। কিন্তু কিছু বলা যাবে না। সারাজীবন শুধু বলির পাঁঠার মতো ব্যা ব্যা করে চল।
অতঃপর কি আর করা যাবে। সুবোধ বালকের মত আমি আবার হতাশ মনে আমার স্ত্রীর হাত ধরে বাড়ীর মুখে চললাম।