- বইয়ের নামঃ বিদ্যাসাগর চরিত
- লেখকের নামঃ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
০. বিজ্ঞাপন – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর – আত্মজীবনচরিত
বিজ্ঞাপন
পিতৃদেব, পূজ্যপাদ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্বীয় “আত্মজীবনচরিত” লিখিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। কিন্তু নিতান্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, সম্পূর্ণ করা দূরে থাকুক, দুই পরিচ্ছেদের অধিক তিনি লিখিয়া যাইতে পারেন নাই। শারীরিক অসুস্থতা ও নানাকার্য্যে ব্যস্ততা নিবন্ধন তাঁহার অনেক আরব্ধ গ্রন্থ অসমাপ্ত পড়িয়া আছে। তাঁহার আত্মজীবনচরিতও তাহদের অন্যতম।
“আত্মজীবনচরিতের” অতি অল্প ভাগই তিনি লিখিয়া গিয়াছেন। তাঁহার পূৰ্ব্বপুরুষগণের সঙ্ক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত, ও স্বীয় শৈশবের সামান্য বিবরণ মাত্র, এই দুই পরিচ্ছেদে লিপিবদ্ধ আছে। যদি তিনি, বিধবাবিবাহের আন্দোলনের সময় পর্য্যন্ত, অন্ততঃ তাঁহার কৰ্ম্ম-জীবনের প্রারম্ভ পৰ্য্যন্ত, লিখিয়া যাইতে পারিতেন, তাহা হইলেও আমরা পর্য্যাপ্ত মনে করিতাম। কারণ, তাহার পর হইতে তিনি সমাজে বিলক্ষণ প্রতিপন্ন হইয়াছিলেন, এবং পরবর্ত্তী জীবনে, তিনি অনেকের ঘনিষ্ট সংস্রবে আসিয়াছিলেন। সুতরাং, সে সময়ের ঘটনা-পরম্পরা, তিনি নিজে না লিখিয়া গেলেও, জানিবার সম্ভাবনা ছিল। যদি তিনি তাঁহার ছাত্রজীবনের ইতিহাস নিজে লিখিয়া যাইতে পারিতেন, তাহা হইলেও তাঁহার জীবনচরিত সম্পূর্ণ করা সহজ হইত।
তিনি, প্রায়ই, আত্মীয় ও বান্ধবগণের নিকটে, স্বীয় জীবনের অনেক ঘটনার গল্প করিতেন; আমরাও নানাসূত্রে কিছু কিছু অবগত আছি। তদ্ভিন্ন, স্বৰ্গীয় পিতৃদেব, অনেক কাগজ পত্র রাখিয়া গিয়াছেন। সেই সমুদয় অবলম্বন করিয়া ভবিষ্যতে তাঁহার জীবনচরিত লিখিত হইতে পারিবেক। কিন্তু তিনি নিজে লিখিলে যেরূপ হইত, আর কিছুতেই সেরূপ হইবার সম্ভাবনা নাই, ইহা অল্প আক্ষেপের বিষয় নহে।
আমাদের ইচ্ছা ছিল, ভবিষ্যতে যখন আমরা তাঁহার জীবনচরিত ও চিঠিপত্র প্রকাশিত করিব, তখন, তাহার প্রারম্ভ ভাগে, তাঁহার আত্মজীবনচরিতের এই দুইটি পরিচ্ছেদ গ্রথিত করিয়া দিব। কিন্তু, স্বগীয় পিতৃদেবের আত্মীয় স্বজনগণ, ইতিপূৰ্ব্বে শুনিয়াছিলেন যে, তিনি আত্মজীবনচরিত লিখিতেছেন। তাঁহাদের ইচ্ছা ও অনুরোধ এই যে, তিনি যতটুকু লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছেন, আপাততঃ তাহাই প্রকাশিত হউক। তদনুরোধে, তদীয় আত্মজীবনচরিতের এই দুই পরিচ্ছেদ এত শীঘ্র প্রকাশিত হইল।
এই দুই পরিচ্ছেদ “বিদ্যাসাগর চরিত” নামে অভিহিত হইল। আপাততঃ এই স্বল্পপরিমিত আত্মজীবনচরিত তদীয় জীবনচরিতের প্রথম অংশ স্বরূপ পরিগণিত হইবে। ভবিষ্যতে, তাঁহার জীবনের অবশিষ্ট ভাগের বিবরণ, স্বতন্ত্র প্রকাশিত হইবে।
শ্রীনারায়ণ শর্ম্মা।
কলিকাতা
৯ই আশ্বিন, সংবৎ ১৯৪৮।
১. শকাব্দাঃ ১৭৪২, ১২ই আশ্বিন
প্রথম পরিচ্ছেদ
শকাব্দাঃ ১৭৪২, ১২ই আশ্বিন, মঙ্গলবার, দিবা দ্বিপ্রহরের সময়, বীরসিংহগ্রামে আমার জন্ম হয়। আমি জনকজননীর প্রথম সন্তান।
বীরসিংহের আধ ক্রোশ অন্তরে, কোমরগঞ্জ নামে এক গ্রাম আছে; ঐ গ্রামে, মঙ্গলবারে ও শনিবারে, মধ্যাহ্নসময়ে, হাট বসিয়া থাকে। আমার জন্ম সময়ে, পিতৃদেব বাটীতে ছিলেন না; কোমরগঞ্জে হাট করিতে গিয়াছিলেন। পিতামহদেব তাঁহাকে আমার জন্মসংবাদ দিতে যাইতেছিলেন; পথিমধ্যে, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইলে, বলিলেন, “একটি এঁড়ে বাছুর হইয়াছে”। এই সময়ে, আমাদের বাটীতে, একটি গাই গর্ভিণী ছিল; তাহারও, আজ কাল, প্রসব হইবার সম্ভাবনা। এজন্য, পিতামহদেবের কথা শুনিয়া, পিতৃদেব মনে করিলেন, গাইটি প্রসব হইয়াছে। উভয়ে বাটীতে উপস্থিত হইলেন। পিতৃদেব, এঁড়ে বাছুর দেখিবার জন্য, গোয়ালের দিকে চলিলেন। তখন পিতামহদেব হাস্যমুখে বলিলেন, “ও দিকে নয়, এ দিকে এস ; আমি তোমায় এঁড়ে বাছুর দেখাইয়া দিতেছি”। এই বলিয়া, সূতিকা গৃহে লইয়া গিয়া, তিনি এঁড়ে বাছুর দেখাইয়া দিলেন।
এই অকিঞ্চিৎকর কথার উল্লেখের তাৎপর্য্য এই যে, আমি বাল্যকালে, মধ্যে মধ্যে, অতিশয় অবাধ্য হইতাম। প্রহার ও তিরস্কার দ্বারা, পিতৃদেব আমার অবাধ্যতা দূর করিতে পারিতেন না। ঐ সময়ে, তিনি, সন্নিহিত ব্যক্তিদের নিকট, পিতামহদেবের পূর্ব্বোক্ত পরিহাস বাক্যের উল্লেখ করিয়া, বলিতেন, “ইনি সেই এঁড়ে বাছুর; বাবা পরিহাস করিয়াছিলেন, বটে; কিন্তু, তিনি সাক্ষাৎ ঋষি ছিলেন; তাঁহার পরিহাস বাক্যও বিফল হইবার নহে; বাবাজি অামার, ক্রমে, এঁড়ে গরু অপেক্ষাও একগুঁইয়া হইয়া উঠিতেছেন”। জন্ম সময়ে, পিতামহদেব, পরিহাস করিয়া, আমায় এঁড়ে বাছুর বলিয়াছিলেন; জ্যোতিষশাস্ত্রের গণনা অনুসারে, বৃষরাশিতে আমার জন্ম হইয়াছিল; আর, সময়ে সময়ে, কার্য্য দ্বারাও, এঁড়ে গরুর পূর্ব্বোক্ত লক্ষণ, অামার আচরণে, বিলক্ষণ আবির্ভূত হইত।
বীরসিংহগ্রামে আমার জন্ম হইয়াছে; কিন্তু, এই গ্রাম আমার পিতৃপক্ষীয় অথবা মাতৃপক্ষীয় পূর্ব্ব পুরুষদিগের বাসস্থান নহে। জাহানাবাদের ঈশান কোণে, তথা হইতে প্রায় তিন ক্রোশ অন্তরে, বনমালিপুর নামে যে গ্রাম আছে, উহাই আমার পিতৃপক্ষীয় পূর্ব্ব পুরুষদিগের বহুকালের বাসস্থান। যে ঘটনাসূত্রে, পূর্বপুরুষদিগের বাসস্থানে বিসর্জন দিয়া, বীরসিংহ গ্রামে আমাদের বসতি ঘটে, তাহা সংক্ষেপে উল্লিখিত হইতেছে।