সামনে এগিয়ে যেতে নিয়েছিল, ইন্দ্রা সেখানেই দাঁড় করিয়ে রাখে।
কী ব্যাপার, ভাল করে তাকাও দেখি। দেখতে পাচ্ছ না কিছুই
চোখ পিটপিট করে পোল, তারপর নিকষ কালো অন্ধকারে চোখ রাখে। ঠিক বিশ্বাস করার মতো ব্যাপার নয়… জানালার গায়ে ফাটল।
একপাশ থেকে আরেক পাশে চোখ বোলায় সে। না, দৃষ্টি বিভ্রম নয়; সত্যি। ইউক্লিডের সেই সংজ্ঞার কথা মনে পড়ে যায়, একটা রেখার দৈর্ঘ্য আছে কিন্তু কোনো প্রস্থ নেই।’
সামনে এগোয় সে। দাগটা এতই হালকা যে একে ঠিক সরুও বলা যায় না। যেন ইউক্লিডের সেই কথা, কোন প্রস্থ নেই।
কিন্তু এখানে অন্য একটা ব্যাপার আছে। অনিয়মিত বিরতিতে রেখার গায়ে বিন্দু বিন্দু পুরুত্ব দেখা যায়, ঠিক যেমনটা হয় কোনো মাকড়শার জালে জলকণা লেগে থাকলে।
জানালার দিকে আরো এগিয়ে যাচ্ছে পোল। দৃষ্টি নিচের দিকে। না, দৃশ্যটা অনেক অনেক পরিচিত। ভেসে উঠেছে পুরো ইউরোপা মহাদেশ, উত্তর আফ্রিকার অনেকটা অংশ। স্পেস থেকে এ দৃশ্য কতবার দেখেছে সে তার ইয়ত্তা নেই। আচ্ছা, তাহলে আর কোথাও নয়, অর্বিটেই আছে সে। সম্ভবত কোনো ইকুয়েটরিয়াল অর্বিটে- হাজার খানেক কিলোমিটার উপরে তো হবেই।
রহস্যমাখা হাসি ইন্দ্রার অধরে।
‘জানালার আরো কাছে যাও,’ মৃদু কণ্ঠে বলল সে, তাহলে সরাসরি নিচে তাকাতে পারবে। আশা করি তোমার উচ্চতাভীতি নেই।’
কোনো মহাকাশচারীকে এ কথা বললে আর কী বলা যায়। নিজেকে শোনায় পোল মনে মনে, সামনে এগিয়ে যেতে যেতে। কখনো ভার্টিগোর সমস্যা থাকলে আমি এ পেশায় পা ফেলতেই পারতাম না…
আর একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে সত্যি সত্যি ভিড়মি খেল সে। চিৎকার করে উঠল, ‘মাই গড! সাথে সাথে সরে এল জানালার সামনে থেকে। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে তাকাল আবার।
একটা সিলিন্ডারের মতো শহরের উপর থেকে চোখ রাখছে সে। এর ভদ্রোচিতভাবে গোল হয়ে যাওয়া প্রস্থ কম করেও কয়েক কিলোমিটার হবে। কিন্তু উচ্চতার সাথে এর কোনো তুলনাই নেই। নেমে গেছে এটা। নিচে, নিচে, আরো আরো নিচে। আফ্রিকার উপরে কোথাও ধোঁয়াশার ভিতরে গেছে হারিয়ে। আন্দাজ করে নেয় পোল, জায়গাটা উপরিতলে কোথাও গিয়ে মিশবে।
কত উঁচুতে আছি আমরা?’ ফিসফিস করে সে। হাজার দুয়েক কে। এবার উপরে তাকাও।
এবার ব্যাপারটা তত বিস্ময় নিয়ে আসে না, কী দেখা যাবে তা আগে থেকেই যেন জানত সে। মহাশূন্যের গায়ে একটা বিন্দুতে পরিণত হবার আগ পর্যন্ত উঠেই গেছে, উঠেই গেছে। কোনো সন্দেহ নেই, চলে গেছে একেবারে জিওস্টেশনারি অর্বিটে; বিষুবের ছত্রিশ হাজার কিলোমিটার উপরে। পোলের আমলে এমন সব ফ্যান্টাসির কথা শোনা যেত; কিন্তু বাস্তবে তা দেখার সৌভাগ্যের কথা কোনো মানুষ সে আমলে স্বপ্নেও ভাবত না।
এবার রেখাটার মানে ধরতে পারে সে। সারা শরীরে শিহরণ খেলে যায়। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছোটাছুটি করে টগবগে রক্ত।
‘ওটা নিশ্চয়ই আরেকটা?
হ্যাঁ- এশিয়ান টাওয়ার। তাদের কাছে আমাদেরকে ঠিক এমনি দেখায়। কটা আছে?
মাত্র চারটা। ইকুয়েটরের গায়ে সমানভাবে ছড়ানো। আফ্রিকা, এশিয়া, আমেরিকা, প্যাসিফিকা। শেষেরটা এখনো প্রায় খালি। মাত্র কয়েকশ লেভেল পূর্ণ হয়েছে। পানি ছাড়া আর কিছু দেখার নেই…’
এই বিবশ করে দেয়া ধারণাটাকে কোনোক্রমে গলাধকরণের চেষ্টায় প্রাণ আইঢাই করছে এমন সময় একটা বিরক্তিকর চিন্তা মনে এল।
আমাদের আমলেই হাজার হাজার স্যাটেলাইট ছড়ানো ছিল সবখানে। তোমরা কী করে সেগুলোর সাথে সংঘর্ষ এড়ালে?
এবার ইন্দ্রার অস্বস্তিতে পড়ার পালা।
‘ইউ নো- আমি কখনো ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিনি এটা আমার ফিল্ড নয়। থামল সে। মনের অলিগলি ধরে সার্চ চালাচ্ছে। এরপর উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখাবয়ব।
যদ্দূর মনে হয় বড়সড় কোনো পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নেমেছিল তারা। এখন স্টেশনারি অর্বিটের নিচে কৃত্রিম উপগ্রহ বলতে কিছু নেই।’
এতেই বোঝা যায়, নিজেকে জানায় পোল। এই চার দানবীয় টাওয়ারই হাজার হাজার স্যাটেলাইটের কাজ করতে পারবে।
‘আর এম্নিতেও কোনো দূর্ঘটনা হয়নি? পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া বা এ্যাটমোস্ফিয়ারে ফিরে আসতে থাকা স্পেসশিপের সাথে ধাক্কা অথবা তেমন কোনো ঘটনা?
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ইন্দ্রা। এক দৃষ্টিতে।
একটু পর বুঝতে পারল ব্যাপারটা। সে সবের কোনো প্রশ্নই ওঠে না আর। উপরের দিকে আঙুল তাক করে, যেখানে থাকা উচিৎ সেখানেই আছে সব স্পেসপোর্ট। উপরে। আউটার রিঙে। পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে শেষ রকেটটা উড়েছে কম করেও চারশ বছর আগে।
ব্যাপারটা হজম করতে করতে আরেক কথা মনে পড়ে যায়। এ্যাস্ট্রোনটের ট্রেনিং নেয়ার সময় তাকে অনেক ব্যাপার শিখানো হয়েছিল। স্পেসে ব্যাপারটা জীবন মরণের খেলা।
সূর্যটাকে দেখা যাচ্ছে না। দৃষ্টিসীমার অনেক উপরে। ঠিক মাথার উপর। কিন্তু কিছুটা সূর্যরশ্মি জানালা ভেদ করে পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ছে। সেখানে আলোর আরো একটা ব্যান্ড চোখে পড়ে। অনেক ক্ষীণ, কিন্তু একজন মহাকাশচারীর কাছে আলোর খেলা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, এ ব্যাপার তার দৃষ্টি এড়াতে পারে না। এ কী করে সম্ভব? ফ্রেমে দ্বৈত ছায়া পড়ছে অবলীলায়।
আকাশে তাকানো প্রয়োজন। দেখতে হবে। হাটু ভেঙে সাথে সাথে বসে পড়ে পোল। এবং জমে যায় তার চোখ। দূরে আরেকটা সূর্য দেখা যাচ্ছে।