গ্যানিমিডে থাকা সবার মতো সেও এখন ত্রিকোণ পর্বতের আড়ালে থাকা তারাগুলোর আসা যাওয়া দেখতে পায়। সম্ভবত সে সিদ্ধান্তে আসার আগে আরো অনেকে চলে এসেছে।
যদি কেউ চতুষ্কোণ ব্লক দিয়ে একটা বৃত্ত গড়তে চায়- অনুপাত ১:৪:৯ হোক আর যাই হোক- প্রান্তগুলো সম্ভবত মসৃণ হবে না। অবশ্যই, ছোট ছোট রক ব্যবহার করে প্রায় মসৃণ করা যাবে, কিন্তু গাণিতিক হিসাবে সত্যিকার নিখুঁত বৃত্ত গড়া যাবে না। বাইরের প্রান্ত একটু এবড়োথেবড়ো থাকবেই। কি উদ্দেশ্য যখন সূর্য আড়াল করার মতো স্ক্রিন তৈরি করা, তখন কে নিখুঁত করার ঝামেলায় যাবে?
মেয়রের কথা সত্যি, ক্লিনটা সাময়িক। কি সৌরসময়ের হিসাবে এ সাময়িক সময়টা কত ল তা জানা সম্ভব নয়।
আরো জুম করা হয়েছে। আরো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে লুসিফার আড়াল করা জিনিসটার গাঠনিকতা। ঠিকই, অসংখ্য একক দিয়ে গঠিত। সম্ভবত ইউরোপার মহাপ্রাচীরের সমান লাখ লাখ ক’ দিয়ে গড়া। এখন তারা সরে যাচ্ছে। আলো আসহে ফাঁকফোকড় দিয়ে। যেন দানবীয় এক জিগস পাজলকে এলোমেলো করে দেয়া হচ্ছে আস্তে আস্তে।
এলোমেলো আলো এসে পড়হে গ্যানিমিডের বুকে। আস্তে আস্তে বাশীভূত হচেই চতুষ্কোণগুলো, যেন একত্রে থাকলেই ব্লক করে রাখতে পারত, এখন আর সম্ভব নয়।
আনুবিস সিটির মানুষের কাছে যেন ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কেটে গেল, আসলে পুরো ব্যাপারটা ঘটে মাত্র পনের মিনিটে। পুরো ব্যাপারটা ফুরিয়ে যাবার আগে কেউ ইউরোপার দিকে মন দিতে পারেনি।
সেখানে মহাপ্রাচীরের কোনো অস্তিত্ব নেই। ঘন্টাখানেক পর পৃথিবী, মঙ্গল, চাঁদ থেকে খবর এল, সূর্যও সামান্য সময়ের জন্য মিটমিটে হয়ে গিয়েছিল, আবার আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে।
খুব সাবধানে বেছে নেয়া হয়েছিল চন্দ্রকলার মতো গড়নগুলোকে উদ্দেশ্য মানবজাতি। সৌরজগতের আর কোথাও অন্য কিছু টের পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক উচ্ছ্বাসের পর মানুষ টের পায়, টি এম এ-জিরো আর টি এম এ-ওয়ান নেই। টাইকো আর আফ্রিকার বুকে রেখে গেছে তাদের চরিশ লাখ বছরের স্মৃতিচিহ্ন।
.
হয়ত এই প্রথম ইউরোপানরা তাদের মাঝে মানুষের সন্ধান পেল। কিন্তু বজ্রগতিতে চলতে থাকা বিশালবপু প্রাণিগুলোকে দেখে তারা না পাচ্ছে ভয়, না হচ্ছে অবাক।
এই বিচিত্র পাতা ও প্রশাখাহীন ছোট গাছগুলোকে দেখে তাদের কী অনুভূতি হয় তা জানা সহজ নয়। যোগাযোগের কোনো মাধ্যম আছে কি তাদের?
তারা যদি এলসায়ন নামার পর সেখান থেকে অভিযাত্রীদের বেরুতে দেখত, তাহলে গুটিশুটি মেরে ইগলুতে গিয়ে লুকাত এতে কোনো সন্দেহ নেই।
ফ্যাৰু পোল স্পেসস্যুটের ভিতরে থেকে উজ্জ্বল তামার তারের উপহার নিয়ে যেতে যেতে ভাবে, ইউরোপারা কী ভাবছে সাম্প্রতিক এ ঘটনার ব্যাপারে তাদের সাপেক্ষে ইউরোপায় কোনো গ্রহণ হয়নি, কিন্তু মহাপ্রাচীরের অন্তর্ধান নিশ্চয়ই অবাক করেছে। স্মৃতিরও আগে থেকে জিনিসটা এখানেই ছিল, বর্ম হিসাবে, প্রতিরক্ষা হিসাবে, এবং আরো অনেক কিছু হিসাবে যা তারা বুঝতে শিখেনি; তারপর, আচমকা চলে গেল সেটা, এমনভাবে চলে গেল যেন কোনোদিন ছিলই না…।
পেটাবাইটের ট্যাবলেটটা তাদের জন্য অপেক্ষা করছে, জিনিসটার চারপাশে জটলা পাকাচ্ছে একদল ইউরোপা, এই প্রথম দেখল, আগ্রহ দেখাচ্ছে তারা কোনো বিষয়ে। কে জানে, হালম্যান তাদের বলে দিয়েছে কিনা এটার কথা, বলে দিয়েছে কিনা দেখভাল করার কথা- সে আসার আগ পর্যন্ত।
এখন এটাকে সরিয়ে নিতে হবে। সরিয়ে নিতে হবে এর ভিতরে থাকা বন্ধু সহ, ভিতরে থাকা এমন আতঙ্ক সহ, যার সমাধান করবে ভবিষ্যতের কোনো মানবসমাজ, তারপর মুক্ত করবে ভিতরের অস্তিত্বটাকে। সে পর্যন্ত রেখে দিতে হবে বিশেষ এক জায়গায়…
৪০. মধ্যরাত্রি : পিকো
এর চেয়ে বেশি শান্তিময় দৃশ্যের কথা কল্পনা করা কঠিন, ভাবে পোল। গত কয়েক সপ্তাহের ঝক্কি-ঝামেলার পর এখন মন জুড়ে আছে অবসাদ। পূর্ণ পৃথিবীর আলোয় ভাসছে জলহীন বৃষ্টিসাগর।
চান্দ্রযানের ছোট্ট বহর পিকো পর্বতের ভল্টটার সামনে অর্ধবৃত্ত রচনা করে দাঁড়ানো। পর্বতটা মোটামুটি গোলাকার, আর সব পাহাড়ের মতো খাড়া তীক্ষ্ণ চূড়া নেই। স্থানীয় বাইসাইকেল রাইডাররা তীব্রগতিতে চলে যায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতার সময়, এর উপর দিয়েই। তারা কল্পনাও করতে পারবে না এর ভিতরে কী লুকানো আছে। জানলে তাদের স্বাস্থসম্মত এসব চর্চা কোথায় উবে যেত কে জানে!
ঘন্টাখানেক আগের কথা। মনের যন্ত্রণা লুকাতে পারে না পোল। গ্যানিমিড থেকে সোজা চাঁদে নিয়ে আসার পথে জিনিসটাকে একবারও চোখের আড়াল করেনি সে।
‘বিদায়, প্রিয় বন্ধুরা, নিচু স্বরে বলে সে, ভাল কাজ করেছ। হয়ত পরের কোনো এক প্রজন্ম জাগাবে তোমাদের। কিন্তু সব মিলিয়ে আমার খুব একটা আশা নেই।
সে ভালভাবেই জানে কেন হালম্যানের স্মৃতি প্রয়োজন। এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো মেসেজ চলে গেছে নিয়ন্ত্রকের কাছে। কপাল ভাল, জবাব পৌঁছতে সাড়ে নয়শ বছর লাগবে।
আগের দিনে পোল মাঝে মাঝেই আইনস্টাইনকে অভিশাপ দিত। এখন দেখা যাচ্ছে মনোলিথের পিছনে যে বিপুল শক্তিমত্তা কাজ করে তারাও আলোর গতি ভেদ করতে পারেনি। তাই মানবজাতির হাতে আরো হাজারখানেক বছর আছে পরের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার পথে- যদি আদৌ যুদ্ধ থেকে থাকে। হয়ত ততদিনে প্রস্তুতি ভালভাবেই নেয়া হয়ে যাবে।