সবাই দু চোখে গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে তার কথা শোেনন। প্রশ্নের জবাব লুফে নেয়। কিন্তু কিছু জানতে চাইলেই কেন যেন শামুকের মতো গুটিয়ে যায় নিজেদের ভিতরে। পোল আস্তে আস্তে বুঝতে পারে, কালচারাল শক থেকে তাকে অতিমাত্রায় সাবধানতার সাথে দূরে রাখা হচ্ছে। নিজের অজান্তেই যেন পায়তাড়া কষে, এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া চাই। যতক্ষণ একা থাকছে, দেখে অবাক হচ্ছে না যে দরজাটা লক করে রাখা হয়।
এবার আসবে ডক্টর ইন্দ্রা ওয়ালেস। পাল্টে গেল পুরো পাশার দান। মেয়েটার নাম যেমনই হোক, রক্তমাংসের গঠনে জাপানি ভাবটাই বেশি। কল্পনার প্রলেপ মিশিয়ে পোল মাঝে মাঝে তাকে গেইশী ভেবে বসে- যে জাপানি মেয়েরা সেবাকর্মে দক্ষ। একটা ভার্চুয়াল চেয়ার আঁকড়ে থাকা কোনো বিখ্যাত ইতিহাসবিদ, ইউনিভার্সিটি লেকচারারের সাথে তার কল্পনা যে মিলবে না তাতো স্বাভাবিক। মেয়েটার আসার সাথে সাথে সব পাল্টে যাওয়াটা শুধু শুধু নয়। অনর্গল পোলের আমলের ইংরেজি বলে যাচ্ছে সে।
‘মিস্টার পোল, শুরু করল সে, খুব দরকারি আঙ্গিকে, আমাকে আপনার অফিসিয়াল গাইডের কাজ দেয়া হয়েছে- কিম্বা বলা ভাল, মেন্টর। আমার কোয়ালিফিকেশন- আপনার সময়ের উপর বিশেষজ্ঞ আমি। অভিসন্দর্ভের বিষয়, ‘জাতিগত রাষ্ট্রের পতন- ২০০০-৫০’। আমার বিশ্বাস দুজনে দুজনকে দারুণ হেল্প করতে পারব।’
‘আমি নিশ্চিত, পারব। আপনার প্রথম কাজ আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে এ নতুন পৃথিবীটাকে দেখতে দেয়া।
‘ঠিক যেটা আমরা চাই। কিন্তু প্রথমেই আপনাকে একটা আইডেন্ট দিতে হবে। যে পর্যন্ত একটা পরিচিতি না থাকছে সে পর্যন্ত আপনি একজন- কী বলে ব্যাপারটাকে- ননপারসন। কোথাও যেতে পারবেন না, করতে পারবেন না কোনো কাজ। কোনো ইনপুট ডিভাইস আপনার অস্তিত্বের কথা স্বীকারও করবে না।
‘ঠিক এমনি আমি আশা করছিলাম, একটু অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বলল পোল, ‘পদ্ধতিটা আমার সময়েই শুরু হয় হয় করছিল। লোকে ব্যাপারটাকে কী ঘেন্নাইনা করত।
‘কেউ কেউ এখনো করে। হাল ছেড়ে দিয়ে, রণে ভঙ্গ দিয়ে সব ছেড়েছুঁড়ে চলে যায় প্রকৃতির কাছে। বাস করে বনে জঙ্গলে। আপনার শতাব্দিতে যতটা অবারিত প্রকৃতি ছিল এখন তেমন নেই। অরণ্যে ছেয়ে গেছে পৃথিবী। তারা কিন্তু জাতে মাতাল তালে ঠিক। কম্প্যাক সাথে নিয়েই যায়। যে কোনো বিপদের চোরাবালিতে পা পড়ে গেলেই হাউমাউ করে সাহায্য চায়। গড়পড়তায় তাদের ডাক আসে দিন পাঁচেকের মধ্যেই।
‘আফসোসের কথা। মানবজাতির আরো অবনতি হয়েছে।
সে আসলে মেয়েটাকে খতিয়ে দেখছে। দেখছে কতটা সহ্য করে সে, কতটা গভীর তার ব্যক্তিত্ব। বোঝাই যায়, তাদের আরো অনেকটা সময় একত্রে কাটাতে হবে, আরো ভয়ানক ব্যাপার হল, এ মেয়ের উপর তাকে অহর্নিশি হাজারটা ব্যাপারে নির্ভর করতে হবে। এখনো জানে না তাকে ভাল লাগবে কিনা- হয়ত এ মেয়ে তাকে জাদুঘরের বস্তু হিসাবে ধরে নিয়েছে।
অবাক হয়ে দেখে পোল, তার কথায় নির্ভয়ে সায় দিচ্ছে ইন্দ্রা।
কথাটা সত্যি- কোনো কোনো হিসাবে। হয়ত শারীরিক দিক দিয়ে আমরা অনেক দূর্বল কিন্তু এখনকার মানুষ যেভাবে বাস করে ততটা সুখে এবং ঐশ্বর্যে কোনোকালে খুব বেশি মানুষ বাস করেনি।’
ছোট একটা চৌকো প্লেটের কাছে হেঁটে গেল মেয়েটা। দরজার গায়ে আঁটা আছে চৌকো জিনিসটা। ছাপার যুগে এমন সব আকৃতির পত্রিকা বের হত। পোল দেখেছে সব ঘরেই এমন কিছু আছে। সাধারণত ফাঁকা। মাঝে মাঝে সেখানে ধীর গতিতে টেক্সট ফুটে ওঠে, উপরের দিকে চলে যায়। বেশিরভাগ শব্দ পরিচিত হলেও পোলের কাছে সেগুলো কোনো অর্থ বয়ে আনে না। একবার তার ঘরের ঐ ডিসপ্লেগুলো জরুরি ভঙ্গিতে বিপ বিপ করেছিল, গা করেনি পোল, এসব নিয়ে যদি কেউ মাথা ঘামায় তো সে অন্য কেউ, সে নয়। ভাগ্য ভাল, শব্দটা যেভাবে শুরু হয়েছিল সেভাবেই থেমে যায়।
প্লেটটার উপর ডক্টর ওয়ালেস হাতের তালু রাখে, সরিয়ে নেয় কয়েক সেকেন্ড পর। পোলের দিকে কটাক্ষ হেনে বলে, ‘আসুন, দেখুন একবার।
সেখানকার লেখাটুকুর উপর চোখ ফেলে অনেকটাই বুঝে ফেলে পোল । ওয়ালেস, ইন্দ্রা [এফ২৯৭০.০৩.১১/৩১.৮৮৫/হিস্ট.অক্সফোর্ড]
আমার যদ্দূর মনে হয় এফ মানে ফিমেল, তারপর আছে জন্মতারিখ- এগারোই মার্চ, উনত্রিশশ সঙুর- আর আপনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের সাথে যুক্ত। আর আমার যতদূর মনে হয় সেই ৩১.৮৮৫ হল পার্সোনাল আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার, ঠিক তো?”
‘একসেলেন্ট, মিস্টার পোল। আমি আপনাদের সময়কার কিছু ই-মেইল এ্যাড্রেস আর ক্রেডিট কার্ড নাম্বার দেখেছি। এমন সব সংখ্যা আর শব্দ যেগুলো মানুষের মনে রাখতে হলে নাভিশ্বাস উঠে যাবে। কিন্তু আমরা সবাই যার যার জন্মতারিখ জানি আর সে তারিখটা ৯৯,৯৯৯ জনের বেশি লোক শেয়ার করবে না। তাই আপনার প্রয়োজন মাত্র পাঁচটা নাম্বার… আর তাও যদি ভুলে যান, কোনো সমস্যা নেই। দেখতেই পাচ্ছেন, ব্যাপারটা আপনার অস্তিত্বের সাথে যুক্ত।
‘গেঁথে দেয়া?
ইয়েস-জন্মের সাথে সাথে ন্যানোচিপ লাগানো হয় দু হাতে। কিন্তু আপনাকে নিয়ে একটা সমস্যা হবে।’
কী?
‘বেশিরভাগ সময় আপনি যেসব রিডারের সম্মুখীন হবেন তাদের মন-মগজ এত বেশি সরল যে বিশ্বাসই করবে না আপনার জন্মতারিখ। তাই আপনার অনুমতির সাথে জন্মতারিখটা এক হাজার বছর এগিয়ে আনব।’