চ্যান্ডলারকে সাজ্জাতিক মিস করে পোল। জীবনের এতটা অংশ জুড়ে যে মানুষ থাকতে পারে তা ভাবা যায় না। এখন, আর একজনই এ শূন্যতা পূরণ করতে পারত, ডেভ বোম্যান। তারা আবার স্পেসে যাবার পরিকল্পনা করেছিল। একেবারে ওর্ট মেঘের কাছে। অনেকটা অজানা এ অঞ্চলের বরফরাজ্যে যাবার আশা যে কোনো এ্যাস্ট্রোনোমারের কাছে সুখস্বপ্ন। পরিকল্পনায় হরদম বাগড়া দিয়েছে শিডিউলের ঝামেলা, সবশেষে স্বপ্নটা অধরা থেকে গেল।
আরো একটা দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান ঘটেছে- ডাক্তারদের হাজার মানা থাকা সত্ত্বেও। পৃথিবীর বুকে নেমে গেছে পোল একবার। একবারই যথেষ্ট।
তার আমলের শারীরিক প্রতিবন্ধি লোকজন যে ধরনের জিনিসে যেত, হুইলচেয়ার, তেমনি একটা যানে করে পৃথিবীর মাটির স্পর্শ নেয় সে। জিনিসটা মোটোরাইজড, গাড়ির টায়ারের মতো বাতাস ভরা চাকা আছে। মোটামুটি মসৃণ এলাকায় চলতে পারে। উড়তেও পারে জিনিসটা বিশ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে। উড়ে যাবার কাজটা চালায় নিচের দিকে বসানো শক্তিমান ফ্যানের বাতাসে সৃষ্ট এয়ার কুশন। পোল প্রথমে আশ্চর্য হয়ে যায়, এত পুরনো টেকনোলজি এখনো পৃথিবীতে আছে। কিন্তু ইয়ার্শিয়া-কন্ট্রোল ডিভাইস দিয়ে সূক্ষ্ম যাতায়াত সম্ভব নয়।
হোভারচেয়ারে আরাম করে বসে সে বাড়তি ওজন তেমন টের পায়নি। নেমে গেছে আফ্রিকার হৃদপিন্ডে। শ্বাস নিতে একটু কষ্ট হলে কী হবে, এ্যাস্ট্রোনট ট্রেনিঙের সময় এর চেয়ে অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সূর্যের তাপ সহ্য করা যাচ্ছিল না সকালেই, দুপুরে কী হবে কে জানে!
পৃথিবীর, মাটির যে একটা নিজস্ব ঘ্রাণ আছে সে কথাও মনে ছিল না। বিচিত্র সব গন্ধ মনটাকে চনমনে করে তোলে।
চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল পোল, খোলার আগে ঘাড়ের কাছে লকলকে কীসের যেন স্পর্শ পায়।
‘এলিজাবেথকে হ্যালো বলুন, বলেছিল গ্রেট হোয়াইট হান্টার গ্রাব পরা গাইড, ‘সে আমাদের অফিশিয়াল গ্রিটার।’
চেয়ার ঘুরিয়ে পোল একটা বাচ্চা হাতি দেখতে পায়।
‘হ্যালো, এলিজাবেথ,’ একটু আড়ষ্ট ভঙ্গিতে স্বাগত জানায় সে। সাথে সাথে স্যালুট করে এলিজাবেথ, গুড়টাকে উঁচিয়ে। এমন একটা আওয়াজ ওঠে তার কণ্ঠ চিরে, সভ্য সমাজে যেটাকে ঠিক স্বাগত জানানোর মতো মনে হয় না, কিন্তু সে নিশ্চিত, এটাই এ বন্ধুভাবাপন্ন প্রাণির বন্ধুত্ব করার রীতি।
পৃথিবী নামক নীলচে সবুজ গ্রহটায় সব মিলিয়ে ঘন্টাখানেক সময় ব্যয় করে সে। কৃত্রিমতা ছাড়াই সিংহগুলোর হুঙ্কার দেখে সে, দেখে হাজার হাজার বছর ধরে অপরিবর্তিত অকৃত্রিম আফ্রিকার কুমিরগুলোকে।
টাওয়ারে যাবার আগে পোল একটু ঝুঁকি নিয়ে পা বাড়ায় মাটির দিকে। দু- এক কদম হেঁটে নেয়। কিন্তু সিদ্ধান্তটা ঠিক ছিল না। আরো কম তাপমাত্রায় চেষ্টা করা উচিৎ। আবার চেয়ারের নরম গদিতে তলিয়ে গিয়ে নিজেকে ঠিক করে নেয় সে।
‘অনেক হয়েছে, কাতর গলায় বলে সে, এবার টাওয়ারের দিকে ফিরে যাওয়া যাক।
এলিভেটর লবির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আসার সময় চোখে পড়েনি এমন এক সাইনে চোখ পড়ে যায়:
আফ্রিকায় স্বাগতম!
“বনানীতেই পৃথিবী সংরক্ষিত।”
–হেনরি ডেভিড থোরিউ(১৮১৭-১৮৬২)
আগ্রহ দেখে হাইড জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি তাকে চেনেন?
এমন সব প্রশ্ন সব সময় শুনে এসেছে পোল। প্রায়ই জবাব খুঁজে পায় না।
মনে হয় না, বলল সে একটু বিতৃষ্ণা নিয়ে।
তার ঠিক পরের মুহূর্তেই পিছন থেকে বন্ধ হয়ে গেল বিশাল দরজা। বন্ধ হয়ে গেল আদি বসুধামাতার রূপ, রস, গন্ধ, রঙ। নেমে গেল মানুষের আদি নিবাসের ঝাঁপ।
লেভেল দশ হাজারের এ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসার পর পৃথিবী দেখার ফল ফলল। অবশ্য গায়ের নানা জায়গায় ব্যথা-বেদনার কোনো মূল্য নেই তার কাছে। এ গণতান্ত্রিক সমাজেও তার এ্যাপার্টমেন্টের অবস্থানটা অভিজাত। ফিরে আসা পোলকে দেখে ভড়কে গেছে ইন্দ্রা। সোজা বিছানার পথ দেখিয়ে দিয়েছে।
‘এন্থেউসের মতো হাল হয়েছে- বিপরীত আর কী! ইন্দ্রা বলল মুখ কালো করে।
মাঝে মাঝে স্ত্রীর সাথে সে কথায় পারে না। অনেক রেফারেন্সই মাথার উপর দিয়ে চলে যায়।
‘কার মতো?’
‘পৃথিবী-দেবী গায়ার ছেলের মতো। হারকিউলিস তার সাথে লড়েছিল। কিন্তু যতবার মাটিতে পড়ে যায়, ততবার শক্তি ফিরে পায় এহেউস।
তারপর? কে জিতল?
হারকিউলিস, অবশ্যই। এন্থেউসকে বাতাসে, মাটির উপর ধরে রাখে যেন মা ছেলের ব্যাটারি চার্জ করে দিতে না পারে।
যাক, আমার ব্যাটারি চার্জ হতে বেশি সময় নিবে না। একটা শিক্ষা হয়ে গেছে। আরো অভিজ্ঞতা না নিলে হয়ত এক সময় চান্দ্র এলাকায় গিয়ে হাপ ছাড়তে হবে।
পেপালের মনোভাব পুরো এক মাস ঠিক থাকে। প্রতি সকালে ঝাড়া পাঁচ কিলোমিটার হাঁটে সে। প্রতিদিন আফ্রিকা টাওয়ারের এক একটা লেভেল ধরে নেয়। কোনো কোনো লেভেল এখনো ফাঁকা। খা খা শূন্য ধাতব গড়নে মরুভূমির হাহাকার। কখনো ভরে উঠবে কিনা এ জায়গা কে জানে। অন্য লেভেলগুলোর আলাদা আলাদা সৌকর্য আছে। আছে ভিন্নতর স্থাপত্যশৈলি, প্রকৃতি। অনেকগুলো অতীত থেকে সংস্কৃতি ধার করেছে। কোনো কোনোটা ভবিষ্যতের পথ দেখায়। সেগুলোকে এড়িয়ে যায় সে। অনেক জায়গাতেই হাঁটার সময় সম্মানজনক দূরত্ব রেখে কৌতূহলী ছেলেমেয়েরা ভিড় জমায়। সাধারণত বেশি সময় তার সাথে হেঁটে পারে না।