পোলের শিরদাঁড়া বেয়ে যেন শিতল একটা স্রোত নেমে গেল কুলকুল করে। মনে যে চিন্তাগুলো এল সেগুলোকে ঠিক জুড়ে দিতে পারছিল না সে।
সব চেয়ে খারাপ কী হতে পারে? সবচে খারাপ হতে পারে এই যে আমাকে ডেভ উদ্ধার ঠিকই করেছিল, মৃত অবস্থায়। আর এখানে, তা এ জায়গা যেখানই হোক, এখানে অবশেষে আনা হয় এবং কোনো না কোনো প্রক্রিয়ায় সজাগ করা হয়। আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ…’।
‘ঠিক তাই। আপনাকে পৃথিবীর বুকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আসলে… এর খুব কাছাকাছি কোথাও।
মানে? এর খুব কাছাকাছি কোথাও মানে? মাধ্যাকর্ষণের একটা টান যে আছে তা তো সত্যি খুব ধীরে ঘুরতে থাকা মহাকাশ স্টেশনেও একই হাল হবে। চুলায় যাক, আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যাপার নিয়ে ভাবতে হবে এখন।
মনে মনে খুব দ্রুত কিছু আঁক কষে নিল পোল। ডেভ যদি তাকে হাইবারনেকুলামে আর সব ক্রুর সাথে শুইয়ে রেখে থাকে, বৃহস্পতির মিশন শেষ করে থাকে- তাতেই বা কী এসে যায়, পাঁচ বছরের মধ্যে মারা যাবার কথা তার, ফিরে আসতে আসতে।
আজকের তারিখটা ঠিক কত? যথা সম্ভব শান্ত থেকে জিজ্ঞেস করল সে। প্রফেসর আর ম্যাট্রন সাথে সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে। গলার কাছে আবার ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়া টের পায় পোল।
আপনাকে বলতেই হবে, মিস্টার পোল, যে, বোম্যান আপনাকে উদ্ধার করেনি এজন্য তাকে দোষ দেয়ারও কোনো উপায় নেই- আপনাকে জীবিত পাবার কোনো পথ খোলা ছিল না। এদিকে তার নিজের জান নিয়েই মরণপণ টানাটানি পড়ে যায়…
‘আপনি মহাকাশে ভেসে বেড়ালেন, পেরিয়ে গেলেন মহাদেবতা বৃহস্পতির বিশাল জগৎ, এগিয়ে চললেন অন্তহীন তারার দেশে। কিন্তু একটা ব্যাপার অবাক করার মতো, সূর্য থেকে এমনিতেই দূরে ছিলেন, আরো অনেক অনেক দূরে চলে গেলেন, ফ্রিজিং পয়েন্ট থেকে অনেকটা নেমে গেল তাপমাত্রা, এত নিচে, যে কোনো প্রকার মেটাবলিজম চলা সে অবস্থায় অসম্ভব। কিন্তু সবচে অবাক করা ব্যাপার হল, ফিরে পাওয়া গেছে আপনাকে। জীবিত মানুষদের মধ্যে আপনিই যে সবচে ভাগ্যবান সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই- ভুল বললাম, কোনোকালে আপনার মতো ভাগ্যবান কেউ ছিল না।
আসলেই ভেঙে পড়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করে পোল । পাঁচ বছর, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এর মধ্যেতো একটা শতাব্দিও পেরিয়ে যেতে পারে, পেরিয়ে যেতে পারে আরো অনেকটা সময়।
‘লেট মি হ্যাভ ইট, সামলে নিচ্ছে সে।
প্রফেসর আর ম্যাট্রন যেন কোনো অদশ্য দর্শকের সামনে নিজেদের সামলে নিচ্ছে। তাদের কানের সাথে একটা কিছু লাগানো হল। পোল বুঝে নেয়, এখন তারা হসপিটালের নেটওয়ার্কে যুক্ত।
ফ্র্যাঙ্ক, চিরচেনা পারিবারিক ডাক্তারের মতো করে বলল এ্যান্ডারসন, ব্যাপারটা তোমার কাছে খুব বড় শক হয়ে আসবে, কিন্তু আমি জানি, এটা হজম করার ক্ষমতা তোমার আছে- আর যত দ্রুত জেনে যাও ততই ভাল।
‘চতুর্থ সন্ত্রা শুরু করতে যাচ্ছি আমরা। বিশ্বাস কর পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছিলে প্রায় এক হাজার বছর আগে।
বিশ্বাস করছি তোমার কথা, একেবারে শান্ত স্বর ফ্র্যাঙ্ক পোলের। তারপর কী যেন হয়ে গেল। চোখের সামনে দোদুল্যমান পুরো ঘরটা। ঘুরছে। কোথায় যেন তলিয়ে গেল সেই প্রাচিন ডিসকভারির ত্রু।
* * *
আবার ফিরে আসছে সচেতনতা। একটু অবাক হয়ে দেখল, এখন আর কোনো হাসপাতালের কামরায় নেই। শুয়ে আছে মনোরম এক স্যুইটে। দেয়ালে দেয়ালে ফুটে উঠছে অসাধারণ সব দৃশ্য। কোনো কোনোটা বিখ্যাত চিত্র, বাকিগুলো। ল্যান্ডস্কেপ আর সমুদ্রের ছবি, সম্ভবত তার সময়কার। কোনো কিছুতেই অপরিচিতের ছাপ নেই। কিন্তু সেগুলো আসবে, ভাবে সে।
কোন সন্দেহ নেই, বর্তমানে তার চারপাশটাকে খুব সাবধানতার সাথে প্রোগ্রাম করা হয়েছে। টেলিভিশনের কাছাকাছি কী আছে এখন? এটাই কিন্তু বিছানার আশপাশে কোনো কন্ট্রোল দেখা যাচ্ছে নাতো। কত চ্যানেল থাকতে পারে তৃতীয় সহস্রাব্দে?
এ নতুন পৃথিবীতে কত কী যে নতুন করে শিখে নিতে হবে তার লেখাজোকা নেই। যেন কোনো বুনো এসে হঠাৎ হাজির হয়েছে উন্নত সভ্যতার সামনে।
কিন্তু প্রথমে তাকে শক্তি ফিরে পেতে হবে- শিখে নিতে হবে ভাষাটা; পোলর জন্মস্থানেই তার সেই জীবনটায় ভাষা কত পাল্টে গেল, উল্টে গেল কত ব্যাকরণ। নিশ্চয়ই আরো হাজার হাজার নতুন শব্দ এসেছে, বেশিরভাগই বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির সাথে সম্পর্কিত, কোনো কোনোটার অর্থ সে মোটামুটি ধারণ করে নিতে পারে।
আরো হতাশাজনক ব্যাপার হল, হাজার বছরে অনেক অনেক নতুন নাম এসেছে। আগাপাশতলা কিছু বুঝে উঠতে পারে না সে। সপ্তাহ ধরে তার কথাবার্তায় বাধা পড়ে পটে আঁকা জীবন-ইতিহাসের সামনে।
আস্তে আস্তে ফিরে আসছে শক্তি, একই সাথে বাড়ছে দর্শনার্থীর সংখ্যা। সেই সাথে শ্যেনদৃষ্টিতে নজর রাখছে প্রফেসর এ্যান্ডারসন। অতিথিদের মধ্যে মেডিক্যাল স্পেশালিস্ট আছে, আছে নানা শাখার তুখোড় সব স্কলার এবং তার সবচে বেশি নজর যাদের দিকে, তারা হল স্পেসক্র্যাফট কমান্ডার।
ডাক্তার আর ইতিহাসবেত্তাদের নতুন করে জানানোর খুব বেশি কিছু নেই, প্রায় সবই এবং তার চেয়েও বেশি জমা হয়ে আছে মানবজাতির অকল্পনীয় বিশাল সব ডাটাব্যাঙ্কে। কিন্তু সে একটা কাজ ভাল করতে পারত, নানা ইতিহাসের বেড়াজালের পথে আটকে পড়া বাদ দিয়ে তার সময়টাকে একেবারে সাদাসিধাভাবে তুলে আনতে পারত।