একের পর এক মেঘস্তর পেরিয়ে যাচ্ছে সে। নেমে যাচ্ছে অনেক নিচে। এরপর এমন এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছল যেখানে মানুষের চোখও হাজার কিলোমিটার চষে ফেলতে পারবে। এটাই গ্রেট রেড স্পটের গভীরতম বিন্দু। মানুষ ধারণা করেছে, কিন্তু জানতে পারেনি কী আছে এখানে।
পাহাড়ের পাদদেশে চড়ে বেড়ায় মোটামুটি এক আকৃতির, ছোটখাট মেঘখন্ড। লাল আর ধূসর রঙ তাদের। বৃহস্পতিয় হিসাবে একেবারে ছোটছোট। এক একটা ছোট নগরীর আকারের।
তারা জীবন্ত। দেখেই বোঝা যায়। এগিয়ে যাচ্ছে। স্বচ্ছন্দ্যে সামনে যাচ্ছে ধীরলয়ে। বৃহস্পতির ভাঙ্গাগড়ার আওয়াজ ছাপিয়ে মিটার ব্যান্ডে পরস্পরের ডাকাডাকি টের পাওয়া যায়।
জীবন্ত গ্যাসব্যাগ। এরা উড়ার মতো উচ্চতায় থাকতে পারে, সীমার বাইরে না আবার নামতে পারে কিছুটা নিচে, বেশি নামলে ওজনের চাপে প্রাণ হারাবে। কিন্তু এ সামান্য এলাকাই পৃথিবীর সমস্ত জীবজগতের চেয়ে বড়।
শুধু তারাই নেই এখানে। তাদেরই মাঝে চড়ে বেড়াচ্ছে দ্রুতগামী আরেক ধরনের জীব। আকারে অনেক ছোট। পৃথিবীর বিমানের মতো হবে। তারাও জীবন্ত। সম্ভবত শিকারী, হয়ত পরজীবী, হয়ত নিয়ম্ভা- কে জানে।
ইউরোপার বিস্ময় যেমন নতুন, তেমনি বিবর্তনের একেবারে নতুন এক অধ্যায় খুলে যাচ্ছে চোখের সামনে। পার্থিব সমুদ্রের স্কুইডের মতো জেট প্রোপেন্ড টর্পেডো আছে, ছিঁড়েখুঁড়ে দিচ্ছে বিশাল বিশাল গ্যাসব্যাগগুলোকে। কিন্তু বেলুনগুলোও অসহায় নয়, তাদের কারো কারো আছে ইলেক্ট্রিক শক দেয়ার ক্ষমতা, কিলোমিটার লম্বা চেইনস’র অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আছে।
জ্যামিতির প্রতিটা সম্ভাবনা অনুসারে আছে আরো বিচিত্র সব আকৃতি। অসামঞ্জস্যপূর্ণ গড়ন, ঘুড়ি, চতুর্ভুজ, ছ-তলকীয়, বহুতলকীয়, ভজ খাওয়া ফিতা… বৃহস্পতিয় বায়ুমন্ডলের দানবীয় প্যাটনগুলো উপরে উঠতে থাকা বিদ্যুতের প্রবাহের সাথে উঠে যায়। সেখানেই প্রজন্মান্তর ঘটে, তারপর নেমে আসে কখনো কখনন, মৃত্যুর সময় হলে। বিভাজিত হয়ে যায়, মিশে যায় প্রকৃতির সাথে, তারপর আবার কাজে লাগে প্রাণ সৃষ্টিতে।
পৃথিবীর এলাকার চেয়ে শতগুণ বিস্তৃত এক জগত দেখছিল সে। অনেক বিস্ময় থাকলেও বুদ্ধিমত্তার ঝিলিক নেই কোথাও। বিশালবপু গ্যাসবেলুনগুলোর রেডিও ভয়েস ভয় আর সতর্কতা বহন করে, এর চেয়ে বেশি কিছু না। এমনকি শিকারিগুলোর আরো উন্নত হবার কথা থাকলেও আদতে তারা পৃথিবীর হাঙরগুলোর মতোই। মাথাহীন শিকারী।
শ্বাসরুদ্ধকর বিশালতা থাকলেও বৃহস্পতিয় জগতের সবকিছুই একেবারে ভজুর। কুয়াশা আর ফোমের আধিপত্য এখানে। সিল্কের মতো জৈববস্তু, কাগজের মতো পাতলা টিস্যু পাওয়া যাবে এখানে অনেকটাই তৈরি হয় উপরের বজ্রের কারণে। বেশিরভাগই সাবানের ফেনার মতো। পার্থিব মাংসাশির এক থাবায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে মুহূর্তে।
ইউরোপার মতো এটাও একই সাথে জন্মভূমি আবার কবরখানা। কখনো সভ্যতার উন্মেষ দেখা যাবে না। একেবারে খাঁটি বায়বীয় সংস্কৃতি জন্ম নিতে পারে, কিন্তু যেখানে আগুন জ্বলে ওঠা অসম্ভব, যেখানে কঠিন বস্তু থাকবে না, সেখানে সভ্যতা দূরের কথা, প্রস্তর যুগও আসবে না কখনো।
৩১. নার্সারি
মিস প্রিঙ্গল
রেকর্ড
আসলে, ইন্দ্রা- দিম- আমি জানি না এখনো কী ভাবতে হবে। বিশ্বাস করা এখনো কষ্টকর। কী বিচিত্র প্রাণি ছিল সেগুলো। আমরা তাদের দেখা পেতাম কোনো
কোনো কালে। অন্তত রেডিও ভয়েস ধরতে পারতাম একবিংশ শতাব্দিতেই বুঝতে পারি আর না পারি। বৃহস্পতিকে একটা সূর্যে পরিণত করার জন্য সব ঝেড়েমুছে সাফ করে দেয়া হল।
এখন আমরা জানি, কেন। ইউরোপাদের সুযোগ করে দেয়ার জন্য। কী বিচিত্র যুক্তি বুদ্ধিমত্তাই কি একমাত্র আরাধ্য? আমি দেখতেই পাচ্ছি, টেড খানের সাথে অনেক যুক্তিতর্ক হবে এসব নিয়ে
পরের প্রশ্ন হল, ইউরোপারা কি জাতে উঠতে পারবে? নাকি বাকি সময়টা কাটিয়ে দিবে কিন্ডারগার্টেনে- বলা ভাল নার্সারিতে হাজার বছর খুব বেশি সময় না হলেও মানুষ কিছু না কিছু উন্নয়ন আশা করতেই পারে। কিন্তু ডেভের কথা অনুসারে এখনো তারা সমুদ্র ছাড়ার সময়ের পর্যায়েই পড়ে আছে। সম্ভবত এটাই সমস্যা, এখনো সমুদ্রে একটা পা- থুড়ি, একটা গুঁড়ি দিয়ে বসে আছে।
আরো একটা ব্যাপারে খটকা লাগে। আমরা মনে করেছিলাম তারা সমুদ্রে যায় ঘুমানোর জন্য। উল্টো ব্যাপার। সেখানে যায় খাবার জন্য। ভূমি শুধু ঘুমানোর জায়গা। সেই খালের নেটওয়ার্কগুলো আর কিছুই না, প্ল্যাঙ্কটন ফিডার…
ডেভকে প্রশ্ন করেছিলাম, তাহলে ইগলুগুলো যে বানাল সেগুলো কি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন না?
জবাব এল, ঠিক তা না। সাগরের বুকে যে গড়ন গড়ে সেটারই অনুকরণ। নানা শিকারীর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার উপায় মাত্র। বিশেষত উড়ন্ত কার্পেটের মতো একটা প্রাণি আছে, আকারে ফুটবল মাঠের সমান, সেগুলো খুব সমস্যা করে…
মাত্র একটা ক্ষেত্রে তারা কাজের কাজ দেখিয়েছে, আমরা সেগুলোকে সৃষ্টিশীলতাও বলতে পারি। তারা ধাতব বস্তুর প্রতি আগ্রহী। কারণ হয়ত এই যে এগুলো সাগরের বুকে চোখেও দেখে না। এজন্যই জিয়াং কালে পরিণত হয়েছে। একই হাল হয় মনুষ্যবিহীন যানগুলোর।
যোগাড় করা তামা, টাইটানিয়াম, বেরিলিয়াম দিয়ে কী করে? কাজের কাজ কিছুই না। সবটুকু তূপ করে রাখে এক জায়গায়। চমৎকার এক গোল আকৃতি বানায়, সেটার গড়ন বারবার বদলাতে থাকে। সম্ভবত শিল্পসম্মত সৌন্দর্যজ্ঞান বিকশিত হচ্ছে তাদের ভিতরে। মডার্ন আর্টের মিউজিয়ামে এমন দেখেছিলাম আমি… আরো একটা তত্ত্ব মাথায় উঁকি দেয়। কার্গো কান্টের কথা কখনো শুনেছ? বিংশ শতাব্দিতে কিছু কিছু আদিম গোত্র নিজেদের নিজস্বতা বজায় রেখে টিকে ছিল। তারা বাঁশ দিয়ে বিমানের আকৃতি তৈরি করত। একটাই আশা, আকাশ থেকে যে বিচিত্র গর্জনশীল পাখি তাদের উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে উপহার পাঠায় সেগুলোকে আকৃষ্ট করা যাবে। সম্ভবত ইউরোপাদের মধ্যে এ ধারণাই দানা বাঁধছে।