এই এখানে, দিগন্ত বিস্তৃত বরফের মধ্যে মাত্র নব্বই ভাগ বিশুদ্ধ পানির বরফ আর বাকিটা কার্বন-সালফারের যৌগ। লোকে শুধু শুধু বলত না আগের দিনে, ‘ধূমকেতুতে খারাপ বাতাস ভর করে। এখানে আছে খারাপ ধরনের বিস্ফোরক সব গ্যাস। বিপজ্জনকভাবে জমা হয়ে থাকে। কোনটায় কতটুকু ঝুঁকি আগে থেকে বোঝ যায় না।
স্কিপার টু অল পার্সোনেল, ঘোষণা করল চ্যান্ডলার, প্রোগ্রামে সামান্য রদবদল হয়েছে। আমাদের অপারেশনে একটু এদিক সেদিক হবে। আপাতত বন্ধ থাকবে। কারণ একটা টার্গেটের ব্যাপারে স্পেসগার্ড রাডারের কিছু বলার আছে।
‘বিস্তারিত জানা যায় কিছু?’ শিপের ইন্টারকমের গুঞ্জন কমে এলে একজন প্রশ্ন তুলল।
খুব বেশি কিছু না। জানতে পারলাম এটাও মিলেনিয়াম কমিটির কারসাজি।
আরো গুঞ্জন উঠল। সবাই দু হাজারের সময়টাকে বিদায় দেয়ার জন্য উদগ্রীব ছিল। তিন হাজার সালের পহেলা জানুয়ারি কোনো রকম অঘটন ছাড়াই পেরিয়ে যাবার পর সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। মানবজাতি স্বাভাবিক কাজে ফিরে এসেছিল আরেকবার।
‘এনিওয়ে, গতবারের মতো এটাও আরেক ফলস এ্যালার্ম হতে পারে। যত দ্রুত সম্ভব কাজে নেমে পড়ব আমরা। স্কিপার আউট।’
চ্যান্ডলার ভাবে, ক্যারিয়ারে এটা তৃতীয়বারের মতো আলেয়ার পিছনে ছোটা। কত শতাব্দি ধরে সৌরজগতকে চষে ফেলছে মানুষ, তার পরও বিস্ময় দেখা দেয়। স্পেসগার্ডের অনুরোধের জোরালো কারণ থাকে সব সময়। মনে মনে একটাই আশা জাগছে, কোনো কল্পনাবিলাসি বোকার হদ্দ সেই বহুচর্চিত ‘সোনালি গ্রহাণুপুঞ্জ দেখেনিতো! যদি সত্যি সত্যি স্বর্ণালি এ্যাস্টেরয়েডের অস্তিত্ব থাকে–যা চ্যান্ডলার বিশ্বাস করতে চায় না এ মুহূর্তে–তাতে আহামরি কোনো লাভ হয়ে যাবে না। তাল তাল সোনা দিয়ে মানুষ কচুটা করবে। বরং এর চেয়ে অনেক মূল্যবান এই পানির বরফ; একটা খালি অঞ্চলকে প্রাণবন্ত করে তুলতে পারে এটা।
এসবে খুব বেশি কিছু এসে যায় না। এর মধ্যেই মানুষ তাদের রোবট পোব পাঠিয়ে দিয়েছে একশ আলোকবর্ষ দূরে, চতুর্দিকে। টাইকো মনোলিথ আগেই জানিয়ে দিয়েছে যে উন্নততর বা আগে জন্মানো সভ্য প্রাণিরা আগেই সে কাজটা করেছিল। সৌরজগতে অন্য সভ্যতার নিদর্শন এখনো থাকতে পারে যেগুলোর নাগাল পায়নি মানুষ। এর ভিতর দিয়ে যেতে থাকতেও পারে। ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলারের মনে ক্ষীণ সন্দেহ, স্পেসগার্ড তেমন কিছুই ধারণ করে। তা না হলে একটা প্রথম শ্ৰেণীর স্পেসটাগকে তার কাজ ফেলে রেখে রাডারে ধরা পড়া অচিহ্নিত গতিশীল বম্ভর পিছু ধাওয়া করতে বলত না।
ঘন্টা পাঁচেক পর গোলিয়াথ সত্যি সত্যি একটা সিগন্যাল ধরতে পারল। অত্যন্ত শক্তিমান সিগন্যালসময়ের সাথে সাথে আরো তীব্র হচ্ছে। কিন্তু সেই সাথে একটু হতাশার ভাব দেখা দেয়। না, জিনিসটা যাই হোক, খুব ছোট। এবং ধাত। মাত্র মিটার দুয়েক লম্বা। এর অর্বিট দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, গন্তব্য এ সৌর জগতের কোথাও নয়, বাইরে কোথাও।
চ্যান্ডলারের মনে একটা সন্দেহ দেখা দেয়, এটা গত সহস্রাব্দে মহাকাশে মানুষের পাঠানো জিনিসগুলোর কোনো ধ্বংসাবশেষ নয়ত।
এরপর, ভিজুয়াল ইন্সপেক্টরের কল্যাণে কাছে এগিয়ে এল সেটা। বিস্মিত ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলার ঠিক ঠিক বুঝতে পারে, এ মূহুর্তে পৃথিবীতে এবং মানুষের অন্যান্য কলোনিতে মহাকাশ ইতিহাসবিদরা আতিপাতি করে মহাকাশ যুগের প্রথম দিকের রেকর্ডগুলো খুঁজে দেখছে। কোনো সন্দেহ নেই।
শিহরণ বয়ে যায় তার শরীরে।
‘গোলিয়াথ থেকে বলছি,’ পৃথিবীর উদ্দেশ্যে গর্ব আর স্থিতার সুরে বলে চলে সে, ‘আমরা হাজার বছরের পুরনো এক এ্যাস্ট্রোনটকে তুলে আনছি। সহজেই অনুমান করতে পারি কে তিনি’
২. কে জানিত আসবে তুমি গো, অনাহুতের মতো
জেগে উঠল ফ্র্যাঙ্ক পোল। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারল না সে। এমনকি নিশ্চিত হতে পারল না নিজের নাম সম্পর্কেও।
অবশ্যই, এ এক হসপিটাল রুম। চোখ বন্ধ, তাতে কী, স্পষ্ট বোঝা যায়, প্রাচীনতম অনুভূতি তাকে বলে দেয়, এখন সে একটা হাসপাতালেই শুয়ে আছে। কেন যেন মনে পড়ছে না কী হয়েছে… তারপর হঠাৎই পুরোটা বুঝে ফেলল সে। অবশ্যই!- এ্যারিজোনার হ্যাঁঙ গ্লাইডিং চ্যাম্পিয়নশিপের সময় ঘটেছিল এ অঘটনটা।
এবার আস্তে আস্তে পুরোটা ফিরে আসছে মনে। আমি ডেপুটি কমান্ডার ফ্র্যাঙ্ক পোল, এক্সিকিউটিভ অফিসার, ইউ এস এস এস ডিসকভারি, বৃহস্পতির পথে একটা টপ সিক্রেট মিশনে আছি
যেন কোনো বরফ শীতল হাত চেপে রেখেছে তার হৃদপিন্ড। আস্তে আস্তে, স্লো। মোশন প্লেব্যাকের মতো করে সব কথা মনে আসতে থাকে… সরে যাওয়া স্পেস পোডট তেড়ে আসছে তার দিকে, ধাতব নম্বরগুলো সামনে বাড়ানো… তারপর নিরবতা, আর সেই নিরবতায় চিড় ধরে যায় স্পেস স্যুটের বাতাস বাইরে বেরিয়ে যাবার সাথে সাথে। তারপর শুধু একটা স্মৃতি, মহাশূন্যে অসহায়ভাবে ডিগবাজি খেতে খেতে ভেসে যাওয়া, ভেঙে যাওয়া এয়ার হোসটাকে আবার লাগিয়ে দেয়ার অর্থহীন চেষ্টা…
স্পেসগোড কন্ট্রোলের যে সমস্যাই হয়ে থাক না কেন, সে এখন নিরাপদে আছে। সম্ভবত ডেভ সময় মতো ই ভি এ ঠিক করেছিল, তাকে তুলে এনেছিল স্পেস থেকে, কোনো বড় ক্ষতি হয়ে যাবার আগেই।