আর এখন, বাইরে, তারায় তারায়, বিবর্তন একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে হাটি হাটি পা পা করে। যারা এসেছিল, পরিবর্তনহচ্ছে তাদের মধ্যেও। শরীরগুলো নশ্বর। ধ্বসে যায় খুব সহজেই। যন্ত্রগুলো তার চেয়ে অনেক ভাল। পরিবর্তন আনতে হবে। যন্ত্রের গায়ে আশ্রয় নিল মস্তিষ্কগুলো। তাতে বেড়ে গেল জীবনকাল, বেড়ে গেল চিন্তার ক্ষমতা, কাজের ক্ষমতা, হিসাবের ক্ষমতা। কিন্তু পরিবর্তন চলবেই। এ ব্যবস্থাও খুব বেশি স্থায়ী নয়। এরপর আর ব্রেইন জায়গা করে নিচ্ছে না যন্ত্রের গায়ে। জায়গা করে নিচ্ছে শুধু ভাবনাগুলো। ধাতু আর দামি পাথরের খোলসই এখন তারা। এ রূপ নিয়ে নিহারিকা থেকে নিহারিকায়, পথ থেকে পথে ছুটে গেল।
এখন আর তারা স্পেসশিপ বানায় না। তারাই মহাকাশতরণী।
কিন্তু যন্ত্র-জীবদের সময় পেরিয়ে গেল খুব দ্রুত। জ্ঞান আহরণের বিরামহীন পথপরিক্রমায় তারা শিখল। শিখল আরো বিচিত্র সব ব্যাপার। শিখল কী করে স্পেসের গায়ে জমা করা যায় জ্ঞান। আলোর জমাট আকৃতিতে তাদের অস্তিত্বকে কী করে স্থান দেয়া যায় তা শিখল।
আর তাই, খাঁটি শক্তিতে রূপান্তরিত করে নিল নিজেদেরকে। হাজার হাজার পৃথিবীতে তাদের ফেলে আসা খোলস ভেসে বেড়াল। পরিত্যক্ত হয়ে রইল অনেক কাল ধরে। মৃত্যু তুর্কি নাচন নাচল তাদের ঘিরে ধরে। তারপর মহাকালই সেগুলোকে ধূলিকণায় পরিণত করে নিষ্ঠুর হাতের ছোঁয়ায়।
এখন, তারা তারার দেশের ভাগ্যবিধাতা। সূর্যের বক্ষভেদ করতে জানে, জানে মহাকাশের মহাস্রোতের ভিতরে তলিয়ে যেতে। অনেক বদল এসেছে, এসেছে অচিন্তনীয় সব পরিবর্তন, কিন্তু আজো সেই সাগরের বুক থেকে চরম বিস্ময়ে চোখ মেলার মুহূর্তের কথা ভুলতে পারে না। আজ আর নেই সে মহাসাগর, নেই সেখানকার উষ্ণতা। কালের অতল গর্ভে তলিয়ে গেছে সেই কবে। কিন্তু অনেক আগে স্থাপন করা তাদের সেসব অসাধারণ সৃষ্টি এখনো বিকল হয়ে যায়নি। এখনো কর্মক্ষমতা ফুরিয়ে যায়নি সেসবের।
হ্যাঁ, মহাকাল থাবা বসিয়েছে। অনেকগুলোই ক্ষয়ে যাচ্ছে।
তার পরও, মাঝে মাঝে, পথ দেখায় সেসব। পথ দেখায় অচেনা মহাকাশে।
ক. নক্ষত্র নগরী
১. ধূমকেতুর রাখাল ছেলে
ক্যাপ্টেন দিমিত্রি চ্যান্ডলার [এম ২৯৭৩.০৪.২১/ ৯৩.১০৬// মঙ্গল// স্পেস এ্যাকাড ৩০০৫] সবচে কাছের বন্ধুদের কাছে “দিম”। বিরক্ত সে। স্পষ্ট বোঝা যায়, চরম বিরক্ত। কারণও আছে। পৃথিবী থেকে মেসেজটা স্পেসটাগ গোলিয়াথ এ আসতে সময় নিয়েছে পুরোদস্তুর ছটা ঘন্টা। গোলিয়াথ এখন নেপচুনের কক্ষপথ ছেড়ে চলে এসেছে। আর মাত্র দশটা মিনিট পরে এলেই কর্ম সারা হয়ে যেত। জবাব দিত সে, স্যরি, এখন আর সম্ভব নয়। আমরা এইমাত্র সানস্ক্রিন ডিপ্লয় করেছি।’
কাজটী মোটেও খারাপ হত না। একটা আগাপাশতলায় পরিপূর্ণ এবড়োথেবড়ো ধূমকেতুকে মাত্র কয়েক অণু পুরু কিন্তু কয়েক কিলোমিটার লম্বা পর্দা দিয়ে পুরোপুরি জড়িয়ে দেয়ার কাজ আধাআধি করা অবস্থায় ছেড়ে দেয়াটা ছেলেখেলা নয়।
এখনো এই বিদঘুঁটে অনুবোধ মেনে চললে আখেরে ভালই হবে। এখন সে সূর্যের অন্যদিকে, পৃথিবী আরেকদিকে। শনির বলয় থেকে বরফ তুলে আনা আর এটাকে শুক্রের দিকে নিয়ে যাবার কাজ শুরু হয় সেই দু হাজার সাতশ সালের দিকে। তিনশ বছর আগের কথা। ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলারের চোখে সেই অতীত আর বর্তমানের মধ্যে তেমন কোনো ফারাক ধরা পড়ে না। সেই সে সময় থেকেই সূর্যের হাত থেকে রক্ষার কাজে সোলার কনসার্ভার ব্যবহার করা হয়। সাধারণ মানুষ এখনো বেঁকে বসে। গত কয়েক শতকের বাস্তুতান্ত্রিক ধ্বংসযজ্ঞের কথা ভুলতে পারে না কিছুতেই। ‘শনি থেকে হাত গুটিয়ে নাও’ ভোটে তারা জিতে যায় স্পষ্ট ব্যবধানে। তাই আজ আর চ্যান্ডলার কোনো রিং রাসলার নয়, বরং এখন সে ধূমকেতুর রাখাল ছেলে।
আলফা সেন্টাউরি থেকে তারা অনেক দূরে, কুইপার বেল্ট অভিশাপ ঝাড়তে পারবে না। এখানে অনেক বরফ আছে, শুক্রকে সাগরে পরিণত করার চেষ্টাও করা যায়। কিন্তু সেখানকার আগুনকে নিভিয়ে দিয়ে প্রাণের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করার স্বপ্ন এখনো সুদূর পরাহত। কথা সত্যি সোলার কনসার্ভারগুলো সে জায়গাকে সূর্যের দোর্দন্ড প্রতাপ থেকে সরিয়ে রাখার কাজ করছে। দু হাজার তিনশো চার সালের উল্কাপাতে ঘটা সুনামির জন্য মারা গেছে লাখো লোক- অথচ কী আফসোসের কথা, একটা ল্যান্ড ইম্প্যাক্ট থাকলে তেমন কোনো সমস্যাই হত না। পুরো মানবজাতিকে জানিয়ে দিয়েছে ঘটনাটা মানুষ আসলে একটা ভর ঝুড়ির মধ্যে অনেক বেশি ডিম রাখার ঝুঁকি নিচ্ছে।
যাক, চ্যান্ডলার নিজেকেই শোনায়, এই প্যাকেজটা জায়গামত পৌঁছতে পৌঁছতে বছর পঞ্চাশেক লেগে যাবে, তাই একটা সপ্তাহের হেরফেরে তেমন কোনো কিছু আসে যায় না। কিন্তু ঘূর্ণনের সমস্ত হিসাব নিকাশ, র আর কেন্দ্রের গাণিতিকতা, থ্রাস্ট ভেক্টর আবার বের করতে হবে। মঙ্গলে ফেরৎ পাঠাতে হবে সমস্ত হিসাব, যেন রিচেক করা যায়। মিলিয়ন টনের বরফকে পাঠানোর আগে হিসাবটা কয়েকবার করে নিলে ভালই হয়, ভুল হলেই উটকো সমস্যা হাজির হবে।
আগেও অনেকবার দেখেছে, ডেস্কের উপরে থাকা ছবিটাকে এখনো দেখছে চ্যান্ডলারের চোখজোড়া। তিন মাস্তুলের একটা বাস্পপোত। জাহাজটার উপর ঝুঁকে আছে হিমবাহ। ঠিক একই অবস্থা এখন গোলিয়াথের। বিশ্বাসই হতে চায় না তার, এই শিপটার নামও ছিল ডিসকভারি তখন শিপগুলো সমুদ্রে চলত বাষ্প ইঞ্জিনে, আর একটা মানুষের জীবনকাল ফুরিয়ে যাবার আগেই একই নামে এই মানবজাতি বৃহস্পতির দিকে স্পেসশিপ পাঠিয়ে দিয়েছিল। শিপটার ব্রিজ থেকে দক্ষিণ মেরুর অভিযাত্রীরা কী ভেবে বাইরে তাকাত তা এখনো সে ভেবে পায় না।