“আজ আর ব্যাপারটায় কোনো পর্দা নেই। বোঝাই যাচ্ছে, আসার পথে কেন প্রোপ্যাল্যান্টের সবটুকু খুইয়ে বসেছিল তারা আর ইউরোপার মতো বিরান এক উপগ্রহের দাবী নিয়ে কেনইবা আসর মাতিয়ে রেখেছিল এতোদিন। রিফুয়েলিং পয়েন্ট হিসেবে ধরলে এখান থেকে শুধু পুরো সৌর জগৎই দাপড়ে বেড়ানো যাবে না, বরং যাওয়া যেতে পারে দূর নক্ষত্রলোকের…
কিন্তু তা আর কাজে লাগল কৈ? ভাবছে স্যার লরেন্স তার কৃত্রিম আকাশরূপী শেল্টারের নিচে বিলাসবহুল চেয়ারে বসে থেকে। কোনো এক অজানা কারণে ইউরোপার দপীয়সী সাগরগুলো আজো মানুষের জন্য অগম্য। আর শুধু অগম্য হলেও সারা হতো, একেবারে অদৃশ্য আর অদৃষ্টপূর্ব। বৃহস্পতি নক্ষত্রে পরিণত হবার পর পরই এর ভিতরের দিকের গ্রহগুলো (ভাবতেও অবাক লাগে, যেগুলো ক দশক আগেও উপগ্রহ ছিল সেগুলো আজ গ্রহ!) বারাজ্যে নিজেদের ঢেকে রেখেছে, আগাগোড়া। এ বাষ্প তাদের শরীর থেকেই উথলে উঠছে অবিরাম।
স্যার লরেন্স আজকের ইউরোপার কথা ভাবছে না, ভাবছে ২০১০ সালের কথা।
সে তখন এক দুরন্ত কিশোের। সেদিন কী গর্বই না অনুভব করেছিল সে, তার দেশের লোক কুমারী বরফাবৃত ইউরোপার ঘুম প্রথমবারের মতো ভাঙিয়েছে। তখনও রাজনীতির লোকেরা হংকং আর চীন নিয়ে কীসব বলে তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি সে।
সেসব দৃশ্য ধারণের জন্য কোনো ক্যামেরা প্রস্তুত ছিল না। তবু মনশ্চক্ষে সে দেখত কীভাবে ইউরোপার মিশকালো আকাশে ধ্বংসের দেবতা নেমে এলো, কীভাবে ধ্বংস হয়ে গেল স্পেসশিপটা। কীভাবে গ্র্যান্ড ক্যানেলে আবার নেমে গেল সেই আততায়ী; পানির স্তরটা কেমন করে আবার বরফে পরিণত হল।
সবাই জানতো এমনটাই ঘটেছে, তাই কল্পনায় দেখে নিতে তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। এবার সেই পুরনো ইউরোপার বদলে এমন একজনের ছবি ভেসে উঠল যাকে চীনারা এতোটা চেনে যতোটা রাশিয়ানরা চেনে গ্যাগারিনকে।
প্রথম ছবিতে রুপার্ট চ্যাংয়ের গ্র্যাজুয়েশন ডের চেহারা ভেসে উঠল, ১৯৮৯ সালের কথা। লাখো মানুষ থেকে ব্যতিক্রমী মেধাবী তরুণ মুখ, পরের দুই দশকে কী ঘটতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই সে মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তিতে।
একটু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সাথে সাথে ভাষক ড. চ্যাংয়ের ক্যরিয়ার বর্ণনা করা শুরু করল। একেবারে জিয়াংয়ের সায়েন্টিফিক অফিসার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া পর্যন্ত বলে গেল একটানা। একের পর এক বয়েসি ছবি এসে আগেরটা দখল করে নিচ্ছে। সবশেষে তার মিশনের আগ মুহূর্তে ভোলা ছবি ভেসে ওঠে।
স্যার লরেন্স প্ল্যানেটরিয়ামের আধো অন্ধকারকে অশেষ ধন্যবাদ দিল। কারণ ড. চ্যাংয়ের লিওনত্রে উদ্দেশ্যে পাঠানো সেই অনিশ্চয়তাময় কথাগুলো প্রচারিত হবার পর তার আশপাশের বন্ধু-শত্রুরা তার চোখে জড়ো হওয়া জলীয়তা দেখতে পাবে না।
…জানি আপনারা লিওনভেই আছেন… হয়তো খুব একটা সময় পাব না হাতে… আমার স্যুট অ্যান্টেনাটা লক্ষ্য করে যেখানে…
কয়েক মুহূর্তের জন্য চলে গিয়েই সিগন্যাল আবার ফিরে আসে। আরো স্পষ্ট, কিন্তু ক্ষীণতা বজায় থাকে।
“…তথ্যগুলো দয়া করে পৃথিবীতে পাঠান। তিন ঘণ্টা আগেই জিয়াং ধ্বংস হয়ে গেছে। একা আমিই আছি বেঁচে। জানি না আমার স্যুট রেডিওর যথেষ্ট রেঞ্জ আছে কিনা, কিন্তু এটা ব্যবহার করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। প্লিজ, মনোযোগ দিয়ে শুনুন। ইউরোপায় জীবন আছে। আবারও বলছি আমি, জীবন আছে ইউরোপায়…
সিগন্যাল অস্পষ্ট হয়ে যায় আবারো।
“স্থানীয় মধ্যরাতের পরপরই। আমরা বেশ ভালভাবে পানি পাম্প করছিলাম, প্রোপ্যাল্যান্ট ট্যাঙ্ক অর্ধেকটা ভরে উঠেছে ততক্ষণে। পাইপ পরিবহন পরীক্ষা করতে আমি আর ড. লি এগিয়ে গেলাম। জিয়াং দাঁড়িয়ে আছে… ছিল… গ্র্যান্ড ক্যানেলের কিনারা থেকে ত্রিশ মিটার দূরে। পাইপ সোজা এখান থেকে নিচে নামানো, বরফ খুবই হালকা। হাঁটাটা নিরাপদ নয়। তার উপর নিচ থেকে গরম পানির ধাক্কাতে এ উপগ্রহে…
আবারো এক লম্বা নিরবতা।
“…নো প্রব্লেম। শিপের উপর পাঁচ কিলোওয়াটের বাতি টানানো আছে। ঠিক যেন এক ক্রিসমাস ট্রি। বর্ণে বর্ণে বর্ণিত, বরফের ভিতর দিয়েও দেখা যাচ্ছে। প্রথমে সেটাকে লি-ই দেখতে পায়। গভীর থেকে এক বিশাল কালচে আকৃতি উঠে আসছে। প্রথমে আমরা মনে করেছিলাম কোনো মাছের ঝাঁক, বিশাল কোনো দল। একক সত্তার পক্ষে আকারটা বিশালতো, তাই। স্বচ্ছ বরফ দিয়ে দেখতে তেমন সমস্যা হচ্ছিল না।
“…অনেকটা সামুদ্রিক শৈবালের ঝোঁপ যেন। এগিয়ে আসছে বরফের বুকে ক্রল করে করে। লী ক্যামেরা আনতে দৌড়ে গেল শিপের দিকে। আমি থেকে গেলাম দেখার জন্য। দেখতে দেখতে রিপোর্ট করব রেডিওতে। জিনিসটা এতো ধীরে নড়াচড়া করছিল যে আমি ইচ্ছা করলেই এরচে দ্রুত যেতে পারতাম। সতর্ক হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি উত্তেজিত ছিলাম। ভাবলাম এটা কী ধরনের প্রাণী আমি জানি। ক্যালিফোর্নিয়ার কাছাকাছি বড় সামুদ্রিক গুল্মবনের ছবি আমার দেখা কিন্তু খুব বড় ভুল হয়ে গিয়েছিল অনুমানের বেলায়।
“… প্রাণীটার কোনো না কোনো সমস্যা ছিল, আমি শিওর। এর সাধারণ পারিপার্শ্বিক অবস্থার চেয়ে একশ পঞ্চাশ ডিগ্রী কম তাপমাত্রায় বেঁচে থাকা অসম্ভব। সামনে আসার সময় জমে কঠিন হয়ে গিয়েছিল-ছোট ছোট টুকরো আলাদা হয়ে যাচ্ছিল কাঁচের মতো কিন্তু তখনো জাহাজের দিকে এগুচ্ছেই। কালো সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস সব সময়ই মন্থর মনে হয়।