গ্রেট রেড স্পটের মাঝের বিন্দু গজাচ্ছে। নেমে এল তার ভিতর দিয়ে। মহাদেশের চেয়েও বড় বিজলী চমকগুলো ফেটে পড়ে চারপাশে। এগুলোর গ্যাস পৃথিবীর হ্যারিকেনের গ্যাসের চেয়ে অনেক ছোট আণবিক গঠনের, তবু এর বিস্তার দেশ থেকে দেশে। ও জানে, কেন। নিরব স্তরে নেমে যেতেই হারিয়ে গেল হাইড্রোজেন বাতাসের পাতলা চিৎকার। চকচকে তুষার-বরফ খণ্ডের মিশ্রণ নিচে। কিছু টুকরো একেবারে মিশে আছে হাইড্রোকার্বনের পাতলা ফেনিল-পাহাড়ের সাথে। উঁচু থেকে এ বুদ্বুদ বেরিয়ে আসে। এখানটা তরল পানি থাকার মতো গরম, তবু কোনো সাগর নেই। এই খাঁটি গ্যাসের পরিবেশ খুব পাতলা। একটা সাগরের জন্য উপযুক্ত নয়।
মেঘের স্তরের পর স্তর পেরিয়ে গেল সে। এমন একটা জায়গাতে পৌঁছল যেখানটায় মানুষের চোখও হাজার কিলোমিটার স্পষ্ট দেখবে। এটা গ্রেট রেড স্পটের একদম ছোট এক ঘূর্ণি। এতে এক বিশাল রহস্য আছে যেটার কথা মানুষ সব সময় ভেবেছে, প্রমাণ করতে পারেনি কখনো। হোট বড় অসংখ্য ফেনা পাহাড়ের আশপাশে একই আকারের অনেক অনেক মেঘ। প্রতিটিই লাল আর ধূসর, প্রায় গোলাকার। মেঘগুলো ছোট, তবে মানুষের হিসাবের মতো ছোট নয়। একেবারে নগণ্যটাও একটা শহর গ্রাস করবে।
সবগুলোই জীবন্ত। আকাশ ছোঁয়া পর্বতগুলোর পাশে শান্তভাবে ঘুরছে। যেমন করে বিরাট পাহাড়ের ঢালে চড়ে বেড়ায় ভেড়ার পাল। এগুলোর একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব মাপা। এসব জীবের রেডিও শব্দও শুনতে পায় নক্ষত্র শিশু। শব্দ ক্ষীণ হলেও বৃহস্পতির ভিতরে ভাঙা-গড়া আর মাথাব্যথার চেয়ে জোরালো।
গ্যাসব্যাগ ছাড়ার পর পরই ওগুলো বয়ে যায় এক চিকণ স্তর ধরে। স্তরটা ফ্রিজিং পয়েন্টের উচ্চতা থেকে শুরু হয়ে যথেষ্ট গরম গভীরতা পর্যন্ত ছড়ানো। হ্যাঁ, সরু-কিন্তু পৃথিবীর সবগুলো জীবস্তরের সমান চওড়াতো হবেই।
একা নয় ওরা। আরো কিছু ওদের সাথে ধীরে ঘুরছে। এত ছোট যে আরো সহজে দেখতে পাবে একটা মানব-দৃষ্টি। কিছু কিছু একেবারেই পৃথিবীর বিমানের মতো, আকারেও প্রায় একই। কিন্তু ওরাও জীবন্ত-হয়ত শিকারী, হয়তোবা পরজীবী, এমনকি রাখালও হতে পারে।
বিবর্তনের একেবারে নতুন অধ্যায়। যেমন অপরিচিত ছিল ইউরোপার জীবগুলো, এও তেমনি। আস্তে আস্তে ধরা দেয় সামনে। জেট প্রপেলার লাগানো টর্পেডো আছে, অনেকটা পৃথিবীর সামুদ্রিক স্কুইডের মতো। ওগুলো জেলি ফিশের মতো দেখতে গ্যাসব্যাগকে খেয়ে ফেলছে অহরহ। আবার বেলুনগুলোরও আত্মরক্ষার উপায় থাকে। তারা লড়াই করছে বিদ্যুৎ আর শুড় দিয়ে। শুড় বা ওঙ্গের মতো দেখায় যে অংশ সেগুলো বিশাল; তাতে আছে থাবা। কিলোমিটারে ছড়ানো লম্বা চেন-করাতের মতো।
এরচে অদ্ভুত গড়নও দেখা যায়। জ্যামিতির প্রত্যেক সম্ভাবনা আর হিসাব বজায় রেখে কিছু অদ্ভুত অকেন্দ্রিক প্রাণী, আধা-স্বচ্ছ ঘুড়ি, চার তলকীয় ঘনক ধরনের, কিছু আছে গোল, কোনোটা আবার বহুতলকীয়, পেঁচানো ফিতার মতো আছে কিছু… বৃহস্পতি পরিবেশের দৈত্যাকার প্লাঙ্কটনগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে চলন্ত বিজলীর গায়ে মাকড়সার স্বচ্ছ জালের মতো লেগে থেকে উপরে উঠে যেতে পারে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত ওরা নিচেই থাকে, বংশ বিস্তার করে। যথেষ্ট বড় হলে বিজলীর সাথে জড়িয়ে উপরে উঠে নষ্ট হয়ে আবার পরিণত হয় সরল কার্বন অণুতে। নিচে এসে নতুন প্রজননের উপাদান হিসেবে কাজ করে। ফিনিক্স!
সে শতবার পৃথিবীর মতো দেখায় এমন আরেকটা বিশ্ব খুঁজেছে। অনেক দুনিয়া দেখার পরও কোথাও বুদ্ধির একটা ঝিলিক মিলেনি। বড় বেলুনগুলোর রেডিও ভয়েস তাদের ভয়ের প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই না। শিকারীগুলোকে নিয়ে আশা করা যেত, কিন্তু ওরা হাঙরের মতো-মনহীন, রোবট যেন।
এদের আকার দম বন্ধ করে দিলেও বৃহস্পতির জীবস্তর একেবারে ভঙ্গুর। কুয়াশা আর ফেনার রাজ্য। কিছু জীবের সুন্দর রেশমী সুতা আর কাগজ-পাতলা টিস্যু ঘুরে ওঠে, কারণ উপরের বিদ্যুৎ চমক থেকে সূক্ষ্ম জীবকণার তুষার ঝরছে অবিরাম। এখানে খুব কম জিনিসই সাবানের ফেনার চেয়ে ঘন। এর সবচে ভয়াল শিকারীও সবচে নিরীহ পার্থিব বিড়াল গোষ্ঠীর প্রাণীর সামনে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে…
আর এই সমস্ত সৃষ্টিকে শুধু লুসিফারের জন্মের জন্য বলি দেয়া হল?
“হ্যাঁ। বৃহস্পতীয়দের উৎসর্গ করার মাধ্যমে ইউরোপানদের জীবনের নিশ্চয়তা নেয়া হল। সম্ভবত ঐ গ্যাসীয় আবহাওয়াতে কখনোই বুদ্ধিমত্তা জাগানো সম্ভব হত না। তবু, সেই প্রাণীগুলোকে ধ্বংস করা কি তার উচিত হয়েছে? হাল আর আমি এখনো এর জবাব খুঁজে ফিরি। তোমার সহায়তা চাওয়ার এও এক কারণ।
কিন্তু আমরা কী করে বৃহস্পতি খাদক মনোলিথের বিপরীতে নিজেদের স্থান করে নিব?
এ এক যন্ত্রাংশ, ব্যস। এর বুদ্ধিমত্তা অসম্ভব ক্ষিপ্র-কিন্তু বিন্দুমাত্র সচেতনতা নেই। এতে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আমি তুমি আর হাল ওর চেয়ে অনেক এগিয়ে আছি।
বিশ্বাস করা কঠিন। যেভাবেই হোক, কোনো একটা অস্তিত্ব নিশ্চই মনোলিথকে গড়েছিল।
একবার সেটার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। ডিসকভারি বৃহস্পতিতে আসার পর। সে আমাকে ফেরত পাঠিয়েছে এই জগৎগুলোতে এর উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য। তারপর আর কোনো কিছু শুনতে… জানতে পারিনি তার কাছ থেকে। এখন আমরা একদম একা।