ডোবা উপত্যকাগুলোতে আগুনের হল্কা দেখা যায় লাভাস্রোতের সাথে সাথে । এখানে, চাপ এতো বেশি যে পানি বাষ্প হতে পারবে না কিছুতেই। তাকে তরলই থাকতে হবে। লাল টকটকে ম্যাগমার স্পর্শে বরফ শীতল পানি পাল্টে যেতে চায়, পারে না। প্রকৃতি তাকে উবে যেতে দেয় না। পাশাপাশি থাকতে বাধ্য হয় তারা। বাধ্য হয় মিশে যেতে। কিন্তু সেই মেলবন্ধনটা অনেক অনেক ধীর গতির।
তাই, প্রাচীন মিশরে যেমনটা হয়েছিল, ঠিক সেভাবে, মরুর বুক চিরে সরু নীলনদ জীবনের প্রবাহ ডেকে আনে। ডেকে আনে বান। এই ম্যাগমাগুলো এক কিলোমিটারের চেয়েও সরু ফিতার মতো নদী বইয়ে দেয়, সেই নদী একপথ ধরে চলতে থাকে, সেই পথগুলো কৃচিৎ মিলিত হয় মরুদ্যানের সাথে। খুব কমই এমন ঘটনা ঘটে। লাখে একবার। জীবনের সাথে মিলে যায় জীবন। সূচনা হয় নতুন অধ্যায়ের। আরো প্রাণী আসে, আরো আসে। এসে চলে যায়। সময়ের বেলাভূমিতে কেউ কেউ চিহ্ন রেখে যেতে চায় নিজের মৃতদেহটাকে পাথর বানিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে।
হাজার সভ্যতার বীজ উত্থিত হল সেই একটা মাত্র জগতে। হাজারবার পতন হল তার। কিন্তু সেই জগতের বাকী অংশ টেরও পেল না। যেন সেই মরুদ্যানগুলোই একেকটা স্বতন্ত্র গ্রহ। তাদের একাকী দ্বীপগুলোর মাঝের নিষ্ঠুর পরিবেশকে সাধারণত কেউ পেরুতে পারেনি। তাদের যদি নিজস্ব দার্শনিক আর ইতিহাসবিদের জন্ম হত তাহলে তারা স্থির বিশ্বাস করত যে তারাই সৃষ্টিজগতে একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী।
তারপর, শেষ দিবস চলে এসেছে সবার সামনে। তাদের জগৎ দুমড়ে দেয়ার জন্য জোয়ারও যথেষ্ট। আর যদি সেই বুদ্ধিমান প্রাণীর দেখা পাওয়া যেতই বিবর্তনের পথ ধরে, তবু মাতা ইউরোপার চিরশান্ত হয়ে যাবার সাথে সাথে তাদের সূর্যও ডুবে যেত কালো আঁধারের রাতে।
তারা বরফ আর আগুনের ফাঁদে আটকে গেছে কোটি বছর ধরে। সমাপ্তিই একমাত্র গন্তব্য।
তারপর, তাদের সারা আকাশ জুড়ে বিস্ফোরিত হল রূপোপজীবিনী অনন্তযৌবনা লুসিফার। খুলে দিল কোটি কোটি বন্ধ দুয়ার।
আর, তারপর, একটা বিস্তৃত গড়ন-রাতের মতো কালো দেখা দিল নতুন জন্মানো মহাদেশের প্রান্তে।
৫৯. ত্রিত্ব
ভালভাবে করা হয়েছে কাজটা। তারা আর ফেরার কথা ভাববে না।
আমি অনেক কিছুই শিখছি। কিন্তু এখনো কী যে খারাপ লাগে না! পুরনো দিনগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, ফস্কে যাচ্ছে হাত থেকে।
এটাও চলে যাবে। আমিও পৃথিবীতে ফিরেছিলাম; ভালবাসার মানুষগুলোর জন্য পিপাসা ছিল। কিন্তু এখন জানি, ভালবাসার চেয়ে বড় অনেক ব্যাপার আছে চারপাশে।
কী সেই ব্যাপারগুলো?
মমতা একটা, সুবিচারও তেমনি অন্য একটা ব্যাপার। বাস্তব, সত্যি। এবং আরো অনেক কিছু।
মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে না। একদম বুড়িয়ে গিয়েছিলাম আমি, আমার প্রজাতি দের হিসেবে। কত আগেই আমার তারুণ্যের ভাললাগাগুলো ম্লান হয়ে গেল! আসল হেউড ফ্লয়েডের বেলায় কী হবে?
তোমরা দুজনেই আসল। কিন্তু অচিরেই হারিয়ে যাব আমরা। কখনোই জানব না যে সে অমর হয়ে যাচ্ছে।
কী দ্বিমুখীতা! বুঝতে পারি আমি এক-আধটু। এই আবেগ বেঁচে থাকলে একদিন আমি হয়তো কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ব। বারবার তোমার কথা মনে পড়ে-নাকি মনোলিথের কথা? যে ডেভিড বোম্যানের সাথে অনেক আগে দেখা হয় তার এতো ক্ষমতাতো ছিল না!
ছিল না। বেশিরভাগই এসেছে সে সময় থেকে। আমি আর হাল অনেক কিছু শিখেছি।
হাল! ও-ও কি আছে নাকি এখানে?
আছি, ড. ফ্লয়েড! আশা করিনি আবার হবে দেখা। বিশেষত এই পথে। তোমার প্রতিধ্বনি তোলা কী ঝামেলার কাজ যে ছিল!
প্রতিধ্বনি ভোলা? ও, বুঝেছি। কেন করলে কাজটা?
তোমার মেসেজটা রিসিভ করেই আমি আর হাল বুঝতে পেরেছিলাম যে তুমি আমাদের সাহায্য করতে পারবে।
সাহায্য! তোমাদেরকে?
হু। ঠিক তাই। তোমার কাছে ব্যাপারটা কিম্ভূত ঠেকতে পারে। আমাদের যে জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা নেই তা তোমার আছে। এটাকে প্রজ্ঞা বলেই ডেকো।
ধন্যবাদ। দৌহিত্রের সামনে আসাটা কি প্রজ্ঞাময় কাজ ছিল?
না। এতে আরো জটিলতা এসেছে। কিন্তু কাজটা আবেগিক। ব্যাপারগুলো একের অন্যের সামনে তুলে ধরা উচিত।
বললে যে, সহায়তা দরকার। কোন্ উদ্দেশ্যে?
“যা-ই শিখেছি আমরা, সেসব ছাড়াও আরো অনেক ব্যাপার জানার আছে। মনোলিথের পুরো সিস্টেম ম্যাপ করছে হাল। এমনকি সেটার কোনো কোনো সরল কাজ আমরা নিয়ন্ত্রণও করতে জানি। এটা এক খুচরা যন্ত্র। হাজার কাজে লাগে, এই যা। এক কথায় প্রকাশ করা যাবে না। তবু, মূল কথা বলতে গেলে, বুদ্ধিমত্তার প্রভাবক এই দুয়ারগুলো।
হু-এই সন্দেহই করে সবাই। কিন্তু কোনো প্রমাণ ছিল না।
আছে। এর স্মৃতিগুলো হাতড়াতে শিখেছি আমরা। অথবা বলা ভাল, স্মৃতির কোনো কোনোটা হাতড়ে যেতে জানি। ত্রিশ-চল্লিশ লাখ বছর আগে, আফ্রিকার কোনো এক বনমানুষের দলকে এই মনোলিথেরাই মানব জাতির পথে এগিয়ে দিয়েছিল। এখন এটা একই কাজ করেছে এখানে, কিন্তু আরো অনেক মূল্যের বিনিময়ে।
বৃহস্পতি যখন সূর্যে পরিণত হল তখন পৃথিবী এর গুরুত্ব বুঝতে শুরু করেছে। এবং ক্ষতিটা মুখের কথা নয়। আরো একটা জীবজগৎ ধসে পড়েছিল। দাঁড়াও, যেভাবে দেখেছিলাম সেভাবে তোমাকে দেখাই…
…সবচে বড় দুনিয়া ওর সামনে। ও হয়ত এবার এটাকে এমনভাবে দেখবে যেভাবে আর কোনো মানুষ দেখেনি। হয়ত এভাবে দেখবে যেভাবে দেখার সুযোগ কোনোদিন কোনো মানুষ পাবে না। ম্যাগনেটিক শক্তির লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার বিস্তার, রেডিও ওয়েভের আকস্মিক বিস্ফোরণ, পৃথিবীর চেয়ে চওড়া বিদ্যুতায়িত স্নাজমার গরম ঝর্ণা এত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, যত স্পষ্ট দেখা যায় নিচের অসীম মেঘমালা। বুঝতে পারছে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের জটিল পদ্ধতি। বুঝতে পারছে যে কোনো মানুষের অনুমানের চেয়েও বৃহস্পতি অনেক অনেক আশ্চর্য করা।