তারপর তুমি কোনো প্রাপ্তিস্বীকার পাওনি, দাদু?
একটু ইতস্তত করছে ফ্লয়েড। স্মৃতিটা খুব তাড়াতাড়ি হারিয়ে গেলেও হঠাৎ সে রাতের সেই মিনি মনোলিথটার কথা মনে পড়ে গেল।
কিছুই হয়নি তখন। শুধু একটা ছোট্ট একশিলাস্তম্ভ হাজির হয়েছিল তার সামনে। আর কেন, কে জানে, তখন থেকেই সে মনে মনে নিশ্চিত হয়ে গেছে দেখা হবে। দেখা হবেই ক্রিসের সাথে।
না। ধীরে ধীরে বলল অশীতিপর বিখ্যাত মহাকাশবিদ, আমি কোনো জবাব পাইনি কখনো।
হাজার হলেও, ব্যাপারটা স্বপ্ন হতেই পারে। আর স্বপ্নে মানুষ তাই দেখে যা তার অবচেতন মন চায়।
৮. সালফারের রাজত্ব
অষ্টম পর্ব – সালফারের রাজত্ব
৫৮. শত ফুল বিকশিত হোক
বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে মহাকাশ অভিযাত্রা শুরুর আগে মানুষ কখনো ভাবেনি যে সূর্য থেকে এতো দূরে জীবনের বিন্দুমাত্র বিচ্ছুরণ পাওয়া সম্ভব। পঞ্চাশ কোটি বছর ধরে যে সাগরটাকে ইউরোপা নিজের জঠরে লুকিয়ে রেখেছিল সেটায় অন্তত পৃথিবীর সিন্ধুগুলোর মতো জীবন-পূর্ব প্রস্তুতিগুলো চলছিল।
বৃহস্পতিতে আগুন লেগে যাবার আগে বাইরের একেবারে বায়ুশূন্যতা থেকে সাগরগুলোকে আগলে রেখেছিল মোটা বরফের আস্তর। সেই আস্তরণ কোথাও কোথাও কয়েক কিলোমিটার গভীর। কিন্তু দুর্বল রেখা ছিল সেগুলোতে। ফেটে যেত, চিড় ধরিয়ে আলাদা হয়ে যেত দু অংশ।
সৌর জগতের আর কোথাও যে দু মহা পরাক্রমশালীর সরাসরি দেখা হয়নি, হয়নি মল্লযুদ্ধ তাই শুরু হয়ে যেত তারপর। মহাসাগর আর মহাকাশের মধ্যে মুক্ত যুদ্ধ। মাঝে কোনো বায়ুমণ্ডল নেই দফা রফা করার জন্য। কিন্তু এ যুদ্ধে প্রতিবারই দু পক্ষের কিছু ছাড় আর কিছু বিজয় আসে। কিছু পানি বাষ্প হয়ে উবে যায়, কিছু সাথে সাথে শক্ত আবরণ গড়ে ফেলে সাগরের উপরে। বরফের বর্ম গড়ে তোলে। মুহূর্তের মধ্যেই।
কাছের গ্রহরাজ বৃহস্পতির প্রভাব না থাকলে কোন্ আদ্যিকালেই ইউরোপা জমে পাথর হয়ে যেত। সারাক্ষণ এই আগুন-বক্ষার শীতল বাইরেটাকে আর না বাড়ার আদেশ দিয়েছে গ্রহরাজ। সে তার দিগ্বিজয়ী টান দিয়ে টালমাটাল করে রেখেছে। ছোট্ট জগতটার অন্তর্জগত। এর মধ্যে আইওর কিছু অবদান আছে। একদিকে উপগ্রহ, আর একদিকে গ্রহের টানাপোড়েনে সমুদ্রের নিচে সারাক্ষণ ভূকম্পন চলে। ফলে, জমতে পারে না ভিতরের জগৎ।
এবং, তাই, এখানে, উপচে পড়েছে জীবনের হল্লা। মাটির নিচ থেকে উঠে আসা লাভা-ঝর্নাগুলোর চারদিকে শখানেক মিটার জুড়ে চলেছে প্রাণোৎসব। কখনো ঝর্নাগুলো দেখতে দুর্গের মতো হত, কখনো গীজার মতো। তাদের চিমনি থেকে বলকে বলকে বেরিয়ে আসত কালো জীবনামৃত। যেন কোনো শক্তিমানের হৃদপিণ্ড থেকে জীবন-তরল বেরিয়ে আসছে, ধীর লয়ে। এবং, রক্তের মতোই, সেগুলোও জীবনের বার্তা টেনে আনে।
উপর থেকে নেমে আসে মরণ-হিম। নিচ থেকে হেরে না যাবার উষ্ণতা। তারপরও, শীতলতা কেড়ে নিতে চায় জীবনের উৎসবটুকু-এক ফুৎকারে চায় নিবিয়ে দিতে। সফল হয় বেশিরভাগ সময়। প্রাণহীন পড়ে থাকে নিথর প্রাথমিক অসহায় প্রাণীগুলো। সাগরতলে উষ্ণতার প্রতিবাদ-শিবির গড়ে ওঠে। এখানে, এমন এক টানাপোড়েনে খাদ্য আর জীবনের মৌলিক উপাদান শুধু মরে যাবার অপেক্ষায় জন্ম নেয়।
গ্যালিলীয় উপগ্রহগুলোতে মানুষ যে দশকে চোখ রেখেছিল সেই দশকেই এমন সব সামুদ্রিক মরুদ্যান দেখা গেছে স্বয়ং পৃথিবীর সমুদ্রগুলোর বুকে।
এখানে, ইউরোপায়, দু হাজার দশ সালের আগ পর্যন্ত জীবনের কী বিচিত্র আর নিষ্ঠুর নাটক অভিনীত হয়েছে কোটিবার! গাছ ধরনের কিছু চলমান প্রাণী জন্মাতো সেসব জায়গায়; সেসব গাছ খেয়ে বেঁচেবর্তে যেত কিছু আদ্যিকালের সরল প্রাণী। অনেকে আবার সরাসরি ঝর্না থেকে বেরিয়ে আসা প্রাকৃতিক উপাদান খাবার হিসেবে নিত। তাদের চারদিকে, উষ্ণতার আরেকটু দূরে কাকড়া-মাকড়শা-চিংড়ির মাঝামাঝি কয়েক ধরনের প্রাণী ঘিরে থাকত। তারা গরম যেমন সহ্য করত কম তেম্নি উৎস থেকে বেশিদূরে যেতেও পারত না। কিন্তু প্রাণদায়িনী প্রস্রবণ এক সময় নিভে আসত। বিরান হয়ে যেত মৃত প্রাণীর আস্তাকুঁড়।
একটা ছোট সমুদ্ৰোদ্যান দেখতে দেখতেই জীববিদদের কোনো বাহিনীর সারা জীবন কাটানো আক্ষরিক অর্থেই সহজ ছিল। পৃথিবীর পোলিওজোয়িক সাগরের মতো নয় এ সমুদ্রগুলো। এখানে কোনো স্থিরতা নেই। এখানকার বিবর্তনের কথা তাই আগ বাড়িয়ে বলাও সম্ভব নয়। নানা প্রকৃতির নানা আকৃতি নানা জায়গায় নানাভাবে ফুটে উঠেছে নিজের নিজের মতো।
কিন্তু সমাপ্তি অবধারিত। এই জীবন-উৎস শুকিয়ে যাবেই, দুর্বল হবেই, মুখ ফিরিয়ে নিবেই, অন্য কোথাও চলে যাবেই-আজ হোক বা হাজার বছর পরে।
প্রমাণ ছিটিয়ে আছে সর্বত্র। কবরখানায় কঙ্কালের বহর ভেসে বেড়ায়, ডুবে থাকে, তূপ করে পড়ে থাকে বছরের পর বছর। জীবন-অধ্যায় এখান থেকে তার পাতাগুলোকে সযত্নে গুটিয়ে নিয়েছে।
একটা মানুষের চেয়েও বড় ট্রাম্পেটের মতো বিশাল বিশাল খোলস পড়ে আছে এখানে। বাইভা এমনকি ট্রাইভা সমৃদ্ধ প্রাণীর দেহাবশেষ কী অযত্নে পড়ে আছে সেখানে! কোনো কোনো সর্পিল পাথর আকৃতিও দেখা যায়। মিটারের পর মিটার জুড়ে ছড়ানো। ক্রিটোকিয়াস যুগের শেষে পৃথিবীর সাগর থেকে যারা গায়েব হয়ে গেছে একদম।