প্রোগ্রামটা উদ্বোধন করা হয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর এক চৈনিক আবিষ্কারককে উৎসর্গ করার মাধ্যমে। অচেনা সেই বৈজ্ঞানিক রকেটের জনক ছিলেন বলে দাবী করা হয়। প্রথম পাঁচ মিনিট তুমুলবেগে ঐতিহাসিক জগৎ খুঁড়ে দেখার কাজ চলল। তারপর ড. হিউ সেন জিয়াংকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অনেক উপরে তোলা হল; অবশ্যই তার ক্যারিয়ারের পেছনে আমেরিকা, রাশিয়া আর জার্মানির বিজ্ঞানীদের সব অবদানকে তুচ্ছ করে। অবশ্য তার দেশের মানুষকে মাফ করা যায়, এমন একটা জমকালো অনুষ্ঠানে লোকজন তাঁকে রকেটশিল্পের জগতে গদার, ভন ব্রাউন কিংবা কোরেলভের সাথে তুলনা করলেও অত্যুক্তির মতো দেখাতো না। এরপরই যুক্তরাষ্ট্রে তার গ্রেফতার হওয়ার কথা নিয়ে তুবড়ি ছোটে, ঘটনাটার কিছুদিন আগেই ডক্টর জিয়াং সুখ্যাত জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরি স্থাপন করেন এবং তার পরপরই ক্যালটেকের মতো প্রতিষ্ঠানে প্রথম গদার প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ পান। কিন্তু তারপর তিনি গ্রেফতারের ঘটনায় আঘাত পেয়ে মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন।
১৯৭০ সালে লঙ মার্চ ১ রকেটের মাধ্যমে চীন যে প্রথমবারের মতো মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠায় সেকথা খুব কমই উচ্চারিত হল। কারণ হয়তো এই যে, সে সময়টায় আমেরিকানরা চাঁদের বুকে দাপড়ে বেড়াচ্ছে। আসলেই, বিংশ শতাব্দীর বাকী সময়টা দু-চার মিনিটেই যেন কেটে গিয়েছিল। এরপরই সেই অবিস্মরণীয় স্পেসশিপ জিয়াং এর সৃষ্টির ঘটনা, ২০০৭ সালে।
ভাষ্যকার বাকী কাহিনীটুকু বলেনি, বলেনি যে জিয়াঙের অনেক আগেই, ২০০১। সালে আমেরিকার ডিসকভারি মাতিয়ে রেখেছিল বৃহস্পতি-শনি জগৎ, এমনকি জিয়াং যাত্রা শুরু করার সামান্য কিছুদিন আগে রাশিয়ার একক প্রযুক্তিতে মার্কিন-রাশিয়ান অভিযান চালানো হয় বৃহস্পতির দিকে কসমোনট অ্যালেক্সি লিওনভ স্পেসশিপে করে । এ কথা উচ্চারণ করাও যায় না, কারণ তড়িঘড়ি করে জিয়াংয়ের এগিয়ে যাবার ফলটা ছিল বড় মর্মপীড়াদায়ক; অন্যদিকে সফলতার সাথে লিওনভ ফেরত আসে।
টিভি সম্প্রচার খুব একটা কঠিন কাজ ছিল না। কিন্তু ইউরোপার বুকে জিয়াংয়ের কুরা টিভি ডকুমেন্টারি প্রস্তুত করার চেয়ে জরুরী কাজ করছিল; ব্যস্তভাবে।
তারপর বৃহস্পতির চান্দ্রজগতে মানুষের প্রথম পদার্পণের গৌরবগাঁথা বলা হল সুন্দর করে। লিওনভের বুক থেকে সেই ল্যান্ডিং আর তার ফলে অবধারিত দুর্ঘটনার ধারাভাষ্য দিয়েছিল হেউড ফ্লয়েড, সবিস্তারে। আর ইউরোপাকে চিত্রিত করার মতো
অনেক অনেক ডকুমেন্টারি পাওয়া যায় লাইব্রেরিগুলোতে, সেসবও দেখানো হল দেদারসে। সেই সাথে ফ্রয়েডের ঐতিহাসিক কথা:
“ঠিক এ মুহূর্তে আমি শিপের সবচে শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছি নির্নিমেষ চোখে। আপনারা ভোলা চোখে চাঁদকে যেমন দেখেন আমি দেখছি তারচে দশ গুণ বড়। আর আসলেই, দৃশ্যটা ভয়াল।
“উপরিতলটা মোটামুটি গোলাপী বর্ণের। সাথে আছে কয়েকটা ধূসর আঁচড়। কিছু সরু রেখা জটিল গোলকধাঁধা গড়ে তুলেছে; কোকড়ানো, ঢেউ খেলিয়ে চারদিকে ছড়ানো। বাস্তবে কোনো মেডিক্যাল টেক্সটবুকের শিরা-ধমনীর ছবির মতোই লাগে।
“সেসব রেখার কয়েকটি শত শত এমনকি হাজার মাইল লম্বা। দেখতে অনেকটা পার্সিভাল লোয়েল ও অন্যান্য বিংশ-শতাব্দী-বিজ্ঞানী বর্ণিত মঙ্গলের খালের মতো।
“কিন্তু মঙ্গল-নালার মতো ইউরোপা-নালা মোটেও ফাঁকিবাজী নয়। আর ঐ বিজ্ঞানীরা যেমন দাবী করতেন যে মঙ্গলের খালগুলো সভ্য প্রাণীর গড়া-তেমন কোনো ব্যাপারও এখানে নেই। এসবই প্রাকৃতিক। উপরি পাওনা হল, মঙ্গলের সেসব কল্পিত খাল ছিল খটখটে শুকনো, আর এখানে অকূল পানি; অন্তত অনেক অনেক বরফ পাওয়া যাবে। কারণ এই উপগ্রহটা চারদিকে গড়ে পঞ্চাশ কিলোমিটার গভীর সমুদ্রে ঢাকা পড়ে গেছে।
“সূর্য থেকে অনেক অনেক দূরে হওয়ায় বৃহস্পতির এই প্রজার উপরিতল তাপমাত্রায় অনেক অনেক কম । শূন্যের দেড়শো ডিগ্রীরও নিচে। সুতরাং যে কোনো সুস্থ মানুষ ভাবতে পারে যে পুরো সাগরটা বরফের এক টুকরো।
“কিন্তু অবাক হলেও সত্যি যে, বাস্তবটা তেমন নয়, ইউরোপার অভ্যন্তরীণ তাপ একে গলিয়ে রাখে, তার উপর প্রতিবেশী আগ্নেয়-উপগ্রহ আইওর জোয়ার-আকর্ষণ সব সময় পানিটাকে নড়াচড়ার উপরই রাখছে। আর আছেন গ্রহরাজ, তাঁর দোর্দণ্ড প্রতাপ সমেত।
“তাই সারাক্ষণ বরফ ভাঙছে, গলছে, আবার জমে উঠছে শক্ত হয়ে। আর তাই আমাদের মেরুদেশে ভাসমান বরফের উপরের ফাটলের মতো দেখতে কিন্তু তারচে শতগুণ বড় আর গভীর ফাটল তৈরি হচ্ছে সারাক্ষণ। এই সব জটিল খানাখন্দই দেখছি এখন। এদের বেশিরভাগই অতি পুরোনো আর অন্ধকার। কোনো কোনোটা লাখ লাখ বছরের পুরনোও হতে পারে। কিন্তু কোনো কোনোটা একেবারে তুষারশুভ্র। তারা মাত্র জন্মাচ্ছে, কারো কারো খাদ মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার গভীর।
“এই সাদা গর্তগুলোর কোনো একটার পাশেই জিয়াং অবতরণ করে। পনেরশ কিলোমিটার লম্বা গড়নটা; নাম গ্র্যান্ড ক্যানেল। স্বাভাবিকভাবেই চৈনিকেরা এ থেকে পানি তুলতে চায়; সেই পানি পোপ্যাল্যান্ট ট্যাঙ্কে ভরে নিয়ে তারা বৃহস্পতীয় উপগ্রহ জগৎ ছুঁড়ে বেড়িয়ে পৃথিবীতেও ফিরে যাবার মতলব এটেছে। কাজটা ছেলের হাতের মোয়া নয়, কিন্তু তারা আগুপিছু না ভেবে এসেছে এমনটা হতেই পারে না। তারা অবশ্যই যা করতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখে।