অবশ্যই, ফ্লয়েড সাথে সাথে আরো নেমে গেল। আরো আরো। সে যেন তার আগে বলা সব কথা বেমালুম ভুলে গেছে, যেন তার সেই সময়জ্ঞান এখন আর নেই।
তারপর, হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে ভ্যান ডার বার্গ উপলব্ধি করল যে তারা ল্যান্ড করছে।
সাথে সাথে বিজ্ঞানী তার চোখ জোর করে তুলে নিল দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকা স্থাপত্যটা থেকে, তাকালো তার পাইলটের দিকে।
এখনো বিল টির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তারই হাতে, তারপরও, ফ্লয়েড যেন মোহাবিষ্ট হয়ে গেছে; নামতে থাকা আকাশ খেয়াটার সামনের বরাবর ভূমির দিকে তার দৃষ্টি স্থির নিবদ্ধ।
ক্রিস! ক্রিস, কী হল?
জবাব নেই কোনো।
কী করছ তুমি! দোহাই খোদার, জান? কী করছ তুমি!
অবশ্যই জানি। তাকে কি দেখনি নাকি?
কাকে দেখব?
ঐ লোকটাকে? সবচে বড় সিলিন্ডারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে যে! সে তো কোনো ব্রিদিং গিয়ার পরেনি।
ভোন্ট বি এন ইডিয়ট, ক্রিসি: কেউ নেই, কেউ নেই সেখানে…
তিনি মুখ তুলে তাকাচ্ছেন। তাকাচ্ছেন আমাদের দিকে। নড়ছেন তিনি-যতটুকু মনে হয় চিনতে-ও মাই গড!
কেউ নেই, কেউ নেই সেখানে! পুল আপ!
ফ্লয়েড তাকে পুরোপুরি অবহেলা করল।
তারপর, নামার ঠিক আগ মুহূর্তে বন্ধ করে দিল ইঞ্জিন, যেমনটা করার কথা। যখন নেমে এল বিল টি কে নিয়ে, সে এক্কেবারে শান্ত আর পেশাদার এক পাইলট।
খুবই শান্তভাবে সে ইনস্ট্রমেন্ট রিডিং দেখল, অন করল সেফটি সুইচগুলো।
সব কাজ সুচারুভাবে শেষ করে আরেকবার কি সে অবজার্ভেশন উইন্ডো দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল? হয়তো। তার মুখে তখন একটু বিভ্রান্ত শান্তির ছোঁয়া।
ভ্যান ডার বার্গ যদ্র দেখল, তাতে কারো দিকে না তাকিয়েই ক্রিস বলল একটা কথা।
হ্যালো, দাদু।
৫১. ভূত
সবচে ভয়াল দুঃস্বপ্নেও ভ্যান ডার বার্গ কখনো কল্পনা করেনি একটা একরত্তি স্পেস ক্যাপসুল নিয়ে আটকে পড়বে কোনো দস্যু এলাকায়; অচেনা ভুবনে; সাথি শুধু সদ্য পাগল হওয়া এক লোক!
ভরসার কথা একটাই, ক্রিস ফ্লয়েডের আচরণে কোনো ক্ষতিকর দিক দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এখানে নামিয়ে আনার চেয়ে ক্ষতিকর আর কী হতে পারে! ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নেও অবশ্য মানুষ কল্যাণের কথা ভাবে। সাহসী বৈজ্ঞানিক লোকটাও তাই আশা করছে ক্রিস যে কোনো সময় আবার উড়াল দেয়ার চেষ্টা করতে পারে… যেতে পারে গ্যালাক্সির দিকে…
এখনো সে চেয়ে আছে শন্যের দিকে। আর তার ঠোঁট নিরবে কথা বলেই যাচ্ছে কার সাথে যেন।
এখনো অচেনা বসতিতে প্রাণের কোনো স্পন্দন নেই। দেখে মনে হতেই পারে শতাব্দী আগেও এখানে কোনো প্রাণী ছিল না। আশপাশের তুষার-প্রলেপ অনেকটা সরে গেছে বিল টির জেটের ধাক্কায়। ছোট্ট চত্বরটায় এখনো বরফের গুড়া লেপ্টে আছে। এ যেন কোনো বই থেকে ছিঁড়ে নেয়া পাতা। কিছু লেখা আঁকাজোকা আছে, আর কিছু হায়ারোগ্লিফিক-এর কোনোটা সে পড়তে পারে, কোনোটা যেন দুর্বোধ্য, দুয়ে।
কোন ভারি জিনিস যেন এ পধ ধরে টেনে হিঁচড়ে আনা হয়েছে, নয়তো সেটা নিজের ক্ষমতায়ই এসেছে এখানে, এ পথ ধরে। একটা ইগলুর ভিতরে স্পষ্ট চলে গেছে চাকার দাগ। অনেক দূরে একটা কন্টেইনার দেখা যাচ্ছে, বোধ হয় ইউরোপানরা মানুষের মতোই কেয়ারলেস হয়ে যায় কখনো কখনো…
প্রাণ যে আছে তা আর বলতে হয় না। বরং অনুভূতিটাই অসহ্য। হাজার চোখ যে দেখছে তাকে এই অনুভূতিটা স্পষ্ট টের পায় ভ্যান ডার বার্গ। শুধু এটা ভেবেই কোনো কূল কিনারা পায় না সে, সেই চোখগুলোর পেছনে লুকানো মস্তিষ্কে বন্ধুত্ব লুকিয়ে আছে, নাকি নির্জলা ঘৃণা!
কিংবা, কে জানে, তারা হয়তো অপেক্ষা করছে অনাহুত অতিথির বিদায়ক্ষণের জন্য। মানুষের দল চলে যাবে, তারা-ইউরোপানরা আবার তাদের সেই গোপন কাজে নেমে যাবে, পূর্ণ করবে নিজেদের বিরান-নগরীর ছেড়ে যাওয়া ঘরগুলোকে। আবার ব্যস্ত হবে নগর-চত্বর।
তারা দুজন আদৌ অনাহুত তো? নাকি রবাহুত? হতেও পারে, ফ্লয়েডকে দেখে তেমি মনে হয়, হতে পারে, তারাই ডেকে এনেছে….
তারপর, আবার ক্রিস ফ্লয়েড কথা বলল শূন্যতার উদ্দেশ্যে।
বিদায়, দাদু। শান্ত স্বরে সে বলে যায়, কেমন যেন বিষণ্ণ মন নিয়ে। ফিরে তাকায় ভ্যান ডার বার্গের দিকে। তারপর চিরাচরিত সরল কণ্ঠে বলে, যাবার সময় হয়েছে, আমাদের যাবার সময় হয়েছে, তিনি বললেন আমাদের। ভেব না পাগল টাগল হয়ে গেছি।
তার কথায় সায় না দেয়াটাই সবচে বুদ্ধিমানের কাজ, ভাবল ভ্যান ডার বার্গ। কিন্তু এখনো মন খারাপ করার মতো কিছু ব্যাপার আছে এখানে।
ফ্লয়েড বিল টির ডিসপ্লের লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করছে। বোঝার মতো স্পষ্ট সুরে বলছে, ব্যাপারটার জন্য… স্যরি, ভ্যান। আশার চেয়ে বেশি ফুয়েল খরচ হয়ে গেল যে ল্যান্ডিংয়ের কাজে!
এবং, সাথে সাথে বজ্রপাত হল ভ্যান ডার বার্গের মাথায়। বলে কী! মিশন প্রোফাইল বদলে নিতে হবে।
এই পথটাই, ভাবল ভ্যান ডার বার্গ, কথা বলার সঠিক পন্থা এমন মানুষের সাথে, এবং আমরা গ্যালাক্সিতে ফিরে যেতে পারছি না। বলেই কথার উপর নিয়ন্ত্রণ হারালো বিজ্ঞানী, এমন পরিবেশে খুবই স্বাভাবিক, ঘোল ঢালি তোর দাদার মাথায়… কিন্তু শেষ কথাটা আটকে গেল গলার কাছে, কী বলতে নিয়েছিলাম আমি! কাকে! এবং, আবার নিজেকে ফিরে পেয়ে, কথাটা কণ্ঠনালী থেকেই গিলে নিয়ে বলল, তো, আমরা এবার কী করব?