সে অবশ্য পরিত্যক্ত হয়নি-বরং উল্টো। এমনকি চিকিৎসার সময়ও রিপোর্ট করে যাচ্ছিল, বলছিল হাজারো কমিশনের খবর, ইন্টারভিউ দিচ্ছিল দেদার। সে ছিল এক বিখ্যাত লোক, উপভোগ করত ব্যাপারটাকে। তার নিজের দুঃখময় দুনিয়া থেকে একটু সরে আসতে, একটু স্বস্তি পেতে এই ব্যাপারগুলো অনেক সহায়তা করত।
প্রথম পূর্ণ দশক, ২০২০ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময়টা এত দ্রুত কেটে গেছে যে এখন সেদিকে তাকালে কেমন যেন মনে হয়। কোনো চিরাচরিত সংকট ছিল না, বড় কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়নি, শুধু সেই ক্যালিফোর্নিয়া ভূমিকম্প। কী প্রতাপ ছিল সেটার! পরে স্ক্রিনে দেখেছিল দৃশ্যগুলো। বিশাল মহানগরী মিশে যায় ধুলার সাথে । সেই মহাদানব তার ঐশ্বরিক চোখকে এক-দুজন মানুষের উপর নিবদ্ধ করেনি বলেই অনেক অনেক মানুষ বেঁচে যায় । আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যামেরাগুলোই মূল দৃশ্য তুলে আনতে পেরেছিল।
সেই দশকে ভৌগোলিক টেকটোনিক প্লেটের সাথে সাথে রাজনৈতিক প্লেটগুলোও বারংবার রূপ বদলায়। তার দৃষ্টি যেন সময়কে কেটে পৃথিবীর গোড়ার দিকে চলে যাচ্ছে, একমাত্র মহাদেশ প্যানগায়ার দিকে। তারপর কত শত সহস্রাব্দের ভাঙাগড়ায় এতোগুলো মহাদেশের সৃজন চলতে থাকে। মানুষের বেলাতেও একই কথা প্রযোজ্য। কত অগুনতি গোত্র, উপগোত্র, জাতি, উপজাতি! পুরনো সাংস্কৃতিকতা আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে আসে; ভাষার লক্ষ-কোটি উচ্চারণ, আঞ্চলিকতা ঝরে পড়ে। তারপর মানুষ আস্তে আস্তে এক হয়ে যায়। তবু এই এক হওয়ার প্রক্রিয়াটা মাত্র দু-চার শতাব্দীর অবদান।
ঘটনাটায় অনুঘটকরূপে যোগ দেয় মহাজাগতিক সেইসব ঘটনা, লুসিফার স্বয়ং। আর যে পরিবর্তন আরো কয়েক শতাব্দীতে হবার কথা ছিল তা ঘটে যায় খুব দ্রুত।
জেট যুগ বৈশ্বিক ভ্রমণের দ্বার খুলে দিয়েছিল। প্রায় একই সাথে স্যাটেলাইট আর ফাইবার অপটিক্স যোগাযোগের পথকে আরো সহজ করে তোলে। দু হাজার সালের একত্রিশে ডিসেম্বর থেকে আর কোনো লঙ ডিসটেন্স কল বলতে কিছু নেই পৃথিবীতে। ফাইবার অপটিক্সের বদৌলতে পৃথিবীর সবখানে কলরেট সমান। আর, মানবজাতি তৃতীয় সহস্রাব্দকে বরণ করে, দু হাজার এক সাল অবাক চোখে দেখে পৃথিবীতে পুরো মানবজাতি একটি মাত্র পরিবার।
আর সব পরিবারের মতো এটাতেও অশান্তি ছিল টুকটাক। কিন্তু এর সেসব খুনসুটি আর আগের মতো পুরো গ্রহটাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয় না। দ্বিতীয় এবং সর্বশেষ নিউক্লিয়ার যুদ্ধে মানুষ পারমাণবিক বোমার স্বরূপ আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করে। আস্তে আস্তে শান্তির দিকে চোখ ফেরে সবার। তেলের উপর চাপ কমাতে পারমাণবিক গবেষণাকে শান্তি-শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এতো সহজে এতোকিছু হয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল না। তিন দানব-আমেরিকা, রাশিয়া আর চীন বলিষ্ঠ ভূমিকা নেয়।
এক শতাব্দী আগে কানাডা আর যুক্তরাষ্ট্রের অচিন্তনীয় যুদ্ধের মতোই ২০২০ ২০৩০ এর বড় যুদ্ধটা ছিল অকল্পনীয়। তারপর তারা শান্তির কাজে লাগানো শুরু করে শক্তিকে। দেখতে পায় এখানেও কাজ করছে উত্তেজনা…
কোন আদর্শবাদী লোক পিস হোস্টেজ প্রকল্পের কর্মসূচী হাতে নেয়নি। হঠাই দেখা গেল আমেরিকায় কয়েক লাখ সোভিয়েত লোকের আনাগোনা চলছে আর রাশিয়ায় আধ মিলিয়ন আমেরিকান সব সময় থাকে। এইসব মানুষ থেকেও শান্তির পণবন্দী চিন্তার একটু সূত্রপাত হয়। তাদের পরিজন আছে অনেক অনেক, দু দেশেই। সম্পদ আর রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে কামড়াকামড়িতে তারা উপাদান হতে চায়নি।
আর কোনো দেশ চাইলেও লম্বা কোনো যুদ্ধ বাধানোর উপায় ছিল না। কারণ যুগটা হল স্বচ্ছতার। স্বচ্ছতার যুগের শুরু ১৯৯০ এর পরপরই। সংবাদ সংস্থাগুলো নিজেদের স্যাটেলাইট ছাড়ে সে সময়টায়। তাতে ছিল হাই রেজুলেশন ক্যামেরা, সামরিক স্থাপনাও বাদ পড়ত না সেসবের করাল দৃষ্টি থেকে। পেন্টাগন আর ক্রেমলিন ভয়ংকর, তারচেও বেশি ভয়াল এসোসিয়েটেড প্রেস, রয়টার্স আর চব্বিশ ঘণ্টা-জাগ্রত নিউজ সার্ভিস এর অর্বিটাল ক্যামেরাগুলো। তথ্য লুকিয়ে রাখার যুগ তখন থেকেই তিরোহিত হয়।
২০৬০ সালের মধ্যে যে সারা পৃথিবীকে একেবারে নিরস্ত্র করা গেছে তা নয়, কিন্তু অবশিষ্ট মাত্র পঞ্চাশটা পারমাণবিক বোমাকে আন্তর্জাতিক নজরদারীর আওতায় আনা হয়। সেই জনপ্রিয় দানব অষ্টম এডওয়ার্ড প্রথমবারের মতো পৃথিবীর গৃহপতি নির্বাচিত হবার সময় তেমন কোনো বাদানুবাদ ওঠেনি। মাত্র কয়েকটা স্টেট সমর্থন দেয়নি, আর তারা তেমন শক্তিশালীও ছিল না। আর্জেন্টিনা-ব্রিটেন বিবাদের মতো ব্যাপারগুলো আস্তে আস্তে কেটে যায়।
এরপর বিশ্ব অর্থনীতিতে এলো প্রবল প্রতাপশালী জোয়ার। সেটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতিকরও ছিল। অনেক ছোট প্রতিষ্ঠান ঝরে গেল, ডুবল বড়গুলোও।
এতদিনে নূতন আরো কিছু বানানোর সময় এসেছে। মানবজাতি যুদ্ধের সমান অন্য রকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে পড়ায় মানুষ হাজার সহস্রাব্দ এগিয়ে যাবার কথা ভাবছে, এত সামনে এগুনোর কথা ভাবছে আজকাল, যেখানে যাবার কথা স্বপ্নেও ভাবতে ভয় পেত আগের মানুষ।
৪. উত্তাল ঝড়
জন্মের সময় উইলিয়াম সুংকে বিশ্বের সবচে ব্যয়বহুল শিশু বলা হয়। দাবীটা দু বছর টিকে ছিল। তার বোনই রেকর্ড ভেঙে বসে। এরপর পারিবারিক আইন উঠিয়ে দেয়া হলে আর একে চ্যালেঞ্জ করার মতো কিছু বাকী থাকল না।