কে জানে হাল ব্যাপারটাকে কীভাবে নেবে! সেও বিমর্ষ, কোনো…একটা কিছু আমাদের স-ব দেখছে। আজ বা কাল, সে ঠিকই জানতে পারবে।
আর আজ কার্নোও অন্য সবার সাথে চলে গেল; আছে শুধু ছোট্ট জেনিয়া। গত বিশ বছর ধরে তার দেখা নেই। শুধু প্রতি ক্রিসমাসে আজো তার সুন্দর কার্ড ভেসে আসে। সর্বশেষটা তার ডেস্কে পিন দিয়ে সাঁটা আছে, সযত্নে।
কার্ডে আঁকা আছে রাশিয়ান শীতের নিদারুণ বরফ, তার সাথে অতি ক্ষুধার্ত নেকড়ের দল।
পঁয়তাল্লিশ বছর! যেন এই গতকালই লিওনভ পৃথিবীর অর্বিটে ফিরে এসেছিল। পৃথিবীজুড়ে স্বাগত জানানোর জোয়ার যেমন ছিল তেমনই ছিল একটু শীতলতা। লিওনভের বৃহস্পতি মিশন ছিল অনেকাংশে সফল, দামী, সেইসাথে সেই মিশনই আবার একটা প্যানডোরার বাক্স খুলে দিয়ে এসেছে, যেন পৃথিবীর মানুষের জন্য খাল কেটে টেনে এনেছে মস্ত নরখাদক কুমীরকে। কিন্তু সেই বাক্সের রহস্য আজো পুরোপুরি উন্মোচিত হয়নি।
টাইকো মনোলিথ বা টাইকো জ্বালামুখের চৌম্বকীয় বিশৃঙ্খলা আকারে একশিলাস্তম্ভটা চাঁদের বুকে আবিস্কৃত হবার পরই সব বিশৃঙ্খলার শুরু। তখন হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন সেটার অস্তিত্বের কথা জানতো। তার মধ্যে অনেকেই নিশ্চিত ছিল না; মানে রাশিয়ানরা তো শুধু গোয়েন্দা রিপোর্ট পেয়েছিল, ফ্লয়েডের মতো ছুঁয়ে দেখেনি। সময় এগিয়ে গেল, ব্যর্থ হল ডিসকভারির মিশন; পৃথিবীর মানুষ জানল, চার মিলিয়ন বছর আগে অপার্থিব বুদ্ধিমত্তা আমাদের ছুঁয়ে গিয়েছিল। শুধু চাঁদের বুকে ফেলে গিয়েছিল কলিংবেলটাকে। খবরটা স্বস্তিদায়ক হলেও সারপ্রাইজ ছিল না মোটেও। কত দশক ধরে মানুষ এমন একটা খবরের আশায় দিন গুনেছে!
এসবই মানব জাতির আগমনের অনেক অনেক আগের কথা। ডিসকভারির চারধারে আরো কত অব্যাখ্যাত ঘটনা যে ঘটে গেল তারপর? শুধু কম্পিউটারের বিগড়ে যাবার ঘটনা ছাড়া আর কিছুরই প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু দার্শনিক তত্ত্বে কোনো বিচ্যুতি আসেনি, দেখা পাবার কথা গোনায় ধরলে, ত্রিশ-চল্লিশ লাখ বছরে সেই আগন্তুকরা হারিয়ে গেছে এমন মনে করলে, মানুষ তখনো সৃষ্টিজগতের একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী।
কিন্তু আজ আর সে কথাও সত্যি নয়, মাত্র এক আলোক মিনিট দূরে, ব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় ধূলিকণার চেয়েও কম দূরত্বে এমন এক বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ ঘটেছে যে বা যারা আস্ত নক্ষত্রের জন্ম দিতে পারে। যারা নিজেদের সামান্য এক ইচ্ছা পূরণের জন্য পৃথিবীর চেয়ে হাজার গুণ বড় একটা গ্রহকে নির্দ্বিধায় ধ্বংস করতে পারে। তারা মানুষের ব্যাপারে যে পুরোপুরি সচেতন তার প্রমাণস্বরূপ ডিসকভারির মাধ্যমে খবরও পাঠিয়েছে; তারপরই ধ্বংস হয়ে যায় বৃহস্পতি, জন্ম নেয় লুসিফার, শুধু মানুষের মনে বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁটে দেয় সেই মেসেজ
এই স-ব দুনিয়া তোমাদের –শুধু ইউরোপা ছাড়া।
সেখানে নামার কোনো চেষ্টা করো না।
সেই জ্বলজ্বলে নক্ষত্র লুসিফার পৃথিবীর বুকের রাত কেড়ে নিল বছরে কয়েক মাসের জন্য, যখন সে সূর্যকে অতিক্রম করে। নিয়ে এল আশা, কেড়ে নিল অমানিশা, বয়ে আনল ভয়। ভয়-মানুষ চিরদিনই অজানাকে ভয় পায়। আশা-কারণ বিশ্বপ্রকৃতি বদলে যাচ্ছে, সভ্যতার জন্মদাত্রী আলোক আজ সুলভ, পৃথিবীর রাজনৈতিক পট যাচ্ছে বদলে এবং মানুষ চিরদিনই অজানাকে দেখে আশায় বুক বাঁধে।
সব সময় বলা হতো, পুরো মানবজাতি এক হবে সেদিনই যেদিন বাইরের জগৎ থেকে কোনো হুমকি আসবে। কারণ মানুষ সব সময় একতাবদ্ধ হয় হুমকির বিরুদ্ধে আর হুমকিস্বরূপ মানুষের অন্যপক্ষ শুধু মানুষই অবশিষ্ট ছিল। কেউ জানে না লুসিফার হুমকি ছিল কিনা, জানে শুধু এ এক চ্যালেঞ্জ। এই যথেষ্ট।
হেউড ফ্লয়েড পাস্তুরে বসে বসে পৃথিবীর রাজনৈতিক পট বদলে যাওয়া দেখেছে, যেন সে এক অ্যালিয়েন দর্শক। প্রথমদিকে তার আর স্পেসে থাকার সাধ ছিল না, একবার সুস্থ হলেই চলে যেত। কিন্তু তার ডাক্তারেরা অপ্রয়োজনীয় রকমের লম্বা সময় নিয়ে ফেলল।
পরের বছরগুলোর উত্তেজনা দেখে সে ঠিক ঠিক বুঝতে পারে ঠিক কী জন্য তার হাড়গুলো ফিরে যেতে চাচ্ছে না।
সে আর পৃথিবীতে ফিরে যেতে চায়নি। নিচের সেই সাদাটে-নীলচে গোলকে তার জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আজ সে বুঝতে পারে কেন চন্দ্রর বাঁচার কোনো ইচ্ছা বাকি ছিল না।
সেই ইউরোপের ফ্লাইটে তার প্রথম স্ত্রীর সাথে না যাওয়াটাই বদলে দিল সবকিছু। ম্যারিয়ন আজ অন্য জীবনের অংশ, তার দুই কন্যা নিজের নিজের পরিবারে নবাগতদের নিয়ে ব্যস্ত।
কিন্তু সে ক্যারোলিনকে নিজের কারণেই হারিয়েছে, কিন্তু কিছু করার ছিল না। সে কোনোদিনই বোঝেনি। (ফ্লয়েড নিজে কি বুঝেছে?) কেন সে নিজের এতো যত্নে গড়া ঘর ছেড়ে, কয়েক বছরের জন্য সূর্য ছেড়ে এতোদূরে গেল?
মিশনের অর্ধেকটা পেরুনোর পরও সে জানতো আর কোনো উপায় নেই, ক্যারোলিনকে পাওয়া যাবে না। শুধু আশা ছিল ক্রিস তার বাবাকে বুঝবে। কিন্তু তার ছোট্ট ছেলে ততদিনে বাবা ছাড়া অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে বসেছে। ফিরে এসে ফ্লয়েড দেখে তার স্থান অন্য একজন দখল করে বসে আছে, ক্রিসের মনও। ভেবেছিল কোনোদিন এত সব দুঃখ কাটিয়ে উঠতে পারবে না। ঠিক ঠিক পেরেছে, এতোগুলো বছর মুখের কথা নয়। তবে পৃথিবীও তাকে আর ঠিক গ্রহণ করেনি। শরীরও সয়নি। ফিরে যেতে হয়েছে পাস্তুরে, পৃথিবীর কত কাছে! কিন্তু পৃথিবীতে নয়। পৃথিবীর বুকে মানুষ আজ এক শতাব্দী ধরেই অবলীলায় দশ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়, অনেকে প্রতিদিন। সে মাত্র ছ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে সবুজ গ্রহটা দেখা ছাড়া আর কিছু করতে পারে না।