হেউড ফ্লয়েড সৃষ্টিজগতের উপর যতটা দৃষ্টি দিতে পারতো তা নিয়েই সন্তুষ্ট ছিল, বিশেষত তার আবাসিক এলাকা যখন ধীরে ঘূর্ণায়মান হসপিটালের আঁধার অঞ্চলে মুখ লুকায়। তখন তার চতুষ্কোণ দৃষ্টি জুড়ে থাকে তারকালোক, গ্রহ জগৎ, নেবুলা আর সব… সব কিছুকে স্নান করে দিয়ে নূতন নক্ষত্র লুসিফারের ক্ষীণ আলোর ঝলক। লুসিফার, সূর্যের নবীন প্রতিদ্বন্দ্বী।
কৃত্রিম রাত শুরুর মিনিট দশেক আগেই সে সাধারণত কেবিনের সবগুলো আলো নিভিয়ে দেয়। লাল ইমার্জেন্সি লাইটটাও বাদ পড়ে না। নিকষ কালো অন্ধকার চাই তার। স্পেস ইঞ্জিনিয়ারদের তুলনায় একটু দেরিতেই বলতে হয়, সেও খোলা চোখের মহাকাশবিদ্যার অপার্থিব আনন্দের একটু সন্ধান পেয়েছে। আজ সত্যি সত্যি সে প্রায়ই নক্ষত্র-বিবর্তনের সন্ধান পায়, নগ্ন চোখে। এমনকি এ প্রক্রিয়ার একটু আলোকছটা ছিটকে এলেই সে ধরতে পারবে।
সেই মে মাসের প্রতিটি রাতেই ফ্লয়েড ধূমকেতুটার অবস্থান দেখে নিয়েছে স্টার চার্টে। তখন সেটা মঙ্গল-এলাকা পেরুচ্ছিল। একজোড়া ভাল দূরবীণেই অবশ্য হ্যালিকে পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু সে কিছুতেই সেসব জিনিস ছুঁয়ে দেখবে না। এ যেন এক খেলা। আর কদুর তার বুড়োটে চোখ সয়ে যেতে পারে তা দেখার চ্যালেঞ্জ। অবশ্য এরই মধ্যে মাউনা কিয়ার দুজন অ্যাস্ট্রোনোমার খালি চোখে ধূমকেতুটাকে দেখার দাবী করে বসেছে। তাদের কথায় কেউ কান দেয়নি। আর পাস্তুরের অন্য বাসিন্দাদের দাবীকে তো অবশ্য মেনে নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
কিন্তু আজ রাতে তার ভাগ্য হয়তো প্রসন্ন। গামা থেকে এফসাইলন পর্যন্ত সে যেন একটা রেখার দেখা পাচ্ছে। এর উপর বসানো কল্পিত কোনো এক ত্রিভুজের দিকে পড়ে আছে দৃষ্টি। যেন একটু চেষ্টা করলেই চোখের মামুলী দৃষ্টি দিয়ে পুরো সৌর জগৎ তেড়ে-ফুঁড়ে বেরুতে পারবে।
এবং এইতো সেই আকাক্ষার বস্তু!-সেই প্রথমবার দেখার অভিজ্ঞতার মতোই। ছিয়াত্তর বছর আগে! অস্পষ্ট, কিন্তু ভুল হবার জো নেই। অবশ্য সে যদি কাঁটায় কাঁটায় খোঁজার জায়গাটা না চিনত তাহলে দেখলেও বোঝার নিশ্চয়তা থাকত না। যেন দূরের কোনো নেবুলা।
খোলা চোখে জিনিসটা নিখুঁত গোল, ধোয়াটে অবয়ব। এতোদূর থেকে বিখ্যাত লেজের দেখা পাওয়া দুষ্কর। চারধারে ভেসে চলা ছোট্ট ফ্লোটিলা প্রোবগুলো একে মাসের পর মাস ধরে পাহারা দিচ্ছে। এরই মধ্যে এর গায়ের একটু বিস্ফোরণের ছোঁয়া আবিস্কৃত। আর মাত্র কিছুদিন পরই সৌকর্যময় পুচ্ছ আলোক-ধোয়ার বন্যা বইয়ে দেবে, নির্দেশ করবে এর স্রষ্টা-সূর্যের ঠিক বিপরীত দিক।
আর সবার মতো হেউড ফ্লয়েডও সেই চিরাচরিত হিমশীতল, আঁধার… না পুরোপুরি কালো গড়নটাকে সৌরজগতের ভিতরদিকে প্রবেশ করতে দেখেছে। শত্রুর বছরের শীতলতা কাটিয়ে সেই পানির জটিল মিশ্রণ, অ্যামোনিয়া আর অন্য বরফের স্তূপ ফুটতে শুরু করে। এ এক উড়ন্ত পাহাড়, আকার আকৃতিতে কিম্ভূত, ম্যানহাটান আইল্যান্ডের মতো বিশাল। হ্যালির ধূমকেতুকে সূর্য একটা ফুটোওয়ালা স্টিম বয়লারের মতো আকৃতি দিচ্ছে। জলীয় বাষ্পের স্কুণের সাথে মিশে আছে ধুলার আস্তর। আর আধডজন জ্বালামুখ থেকে অবিরাম বেরিয়ে আসছে রাসায়নিক ধোঁয়াশা। স্থানীয় সূর্যাস্তের ঘণ্টা দুয়েক পরেই সবচে বড়টাও উদ্গীরণ শুরু করে। সেটার আকার বিশাল একটা ফুটবল মাঠের সমান। ঠিক যেন কোনো বিশাল বাষ্প-উদগীরক।
এরই মধ্যে সেই জ্বালামুখের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকার ফ্যান্টাসিতে ভুগছে সে, যেন অপেক্ষা করছে সূর্যোদয়ের জন্য। চারপাশে পরিচিত পরিবেশ, পরিবেশটাও দেখেছে আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে। অবশ্য হ্যালির বুকে মহাকাশতরী নোঙর ফেললেও ক্রুরা বাইরে যেতে আদৌ রাজী হবে না।
সেই ছোট প্রিন্ট আউটে এ কাজটাকে শক্তভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
আমাকে থামানো তাদের জন্য বড় ঝামেলার ব্যাপার হবে, ভাবল হেউড ফ্লয়েড। আমি নিশ্চিত আজো একটা স্পেসস্যুট ভালমতো ব্যবহার করতে জানি। আর যদি কোনো ভুল হয়েই যায় তো…
একবার তাজমহল দেখতে দেখতে কোনো এক পর্যটক বলেছিল: এমন একটা স্মৃতিসৌধের জন্য আমি কালকেই মরে যেতে রাজি।
সে মহানন্দে তাজমহলের জায়গায় হ্যালি শব্দটা বসিয়ে দিতে চায়।
৩. পুনঃপ্রবেশ
এমন ভয়াল দুর্ঘটনার কথা হিসেব থেকে বাদ দিলেও তার পৃথিবীতে পা রাখা চাট্টিখানি কথা নয়।
প্রথম চমক এসেছিল জেগে ওঠার পরপরই। ড. রুডেস্কো লম্বা ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়। তার পাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল ওয়াল্টার কার্নো। সেই আধঘুমেও ফ্লয়েড বুঝতে পারে কিছু একটা গড়বড় আছে। তারা যেন ফ্লয়েডের জেগে ওঠায় খুব একটা খুশি নয়। সে আগে পুরোপুরি জেগে ওঠে; তারপর জানতে পারে ড. চন্দ্র আর নেই তাদের সাথে।
মঙ্গলের পেছনে কোনো এক জায়গায় তার নিষ্প্রাণ দেহ ভেসে বেরিয়ে যায়। অনেক অনেক আগেই সে লীন হয়ে গেছে সূর্যের সাথে।
কেউ জানে না তার মৃত্যুর কারণ। ম্যাক্স ব্রেইলোভস্কি তার ধারণার কথা বলল, একেবারে অবৈজ্ঞানিক কারণ হলেও সার্জন-কমান্ডার ক্যাথেরিনা রুডেঙ্কা কথাটা ফেলে দিতে পারেনি।
সে হালকে ছাড়া বেঁচে থাকতে পারেনি।
ওয়াল্টার কার্নো আরেকটা কারণ বলেছিল সবাইকে টপকে গিয়ে।