ফ্লয়েড এমন কোনো সুযোগ পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে চাচ্ছিল, কিন্তু এখন হঠাৎই তার আনন্দের সাথে বেদনা মিলে একাকার হয়ে যায়। প্রায় অর্ধ শতাব্দীর বাসা পেছনে ফেলে কয়েক সপ্তাহ থাকতে হবে। ছেড়ে যেতে হবে গত কয়েক বছরের বন্ধুদের । আজকের ইউনিভার্স কে পরিবহনের ক্ষেত্রে তুলনা করা হয় আদ্দিকালের লিওনভ এর সাথে । (লিওনভ এখন ল্যাগ্রেন্স জাদুঘরে এক দর্শনীয় পুরোনো মহাকাশযান। মহাকাশের সন্তান লিওনভ কখনো মাটি ছোঁয়নি, এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর বাইরের জাদুঘরটার সাথে ।) হাজার তুলনা করা হোক, আজো বড় মহাকাশ অভিযানগুলোয় কিছু কিছু ঝুঁকি থাকে। বিশেষত এমন মাইলফলক কোনো অভিযান হলেতো কথাই নেই….
কিন্তু তারপরও সে হয়তো ঠিক এমন কোনো মওকাই খুঁজছিল-এই একশ তিন বছর বয়েসেও। (কিংবা মৃত প্রফেসর ক্যাথেরিনা রুডেস্কোর কমপ্লেক্স জেরিয়াট্রিক এ্যাকাউন্টিংয়ের হিসেবে তরতাজা পঁয়ষট্টি।) আজো সে বুভুক্ষের মতো চেয়ে থাকে; এতো আরামদায়ক, নির্ভেজাল জীবন সহ্য হচ্ছিল না গত এক যুগ ধরে।
সৌরজগত জুড়ে আজ হাজারো চমৎকার প্রজেক্টের ছড়াছড়ি। মঙ্গলের নব্যকরণ, মার্কারি বেসের উদ্বোধন, গ্যানিমেডে সবুজায়ন… আসলে আজ আর এমন কোনো স্বতন্ত্র প্রজেক্ট বাকী নেই যেখানে সে তার ক্ষয়িষ্ণু দেহমন নিবেদন করতে পারে। দুই শতাব্দী আগে বৈজ্ঞানিক যুগের প্রথমদিকের এক কবি তাঁর আবেগকে তুলে ধরেছিলেন নিখুঁতভাবে, ওডিসিউস / ইউলিসিসের কণ্ঠ দিয়ে:
জীবনের উপর জীবনের স্তূপ
সব ছিল একেবারে ক্ষীণকায়, এর মধ্যে একটা আমার
থেকে যায় সামান্যই, কিন্তু বেঁচে যায় প্রতি ঘণ্টা
সেই অপার নিরবতা থেকে, এরচেও বেশি কিছু,
নূতনের আমন্ত্রক: এবং এ ছিল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র
আমাকে তিনখানা সূর্য যক্ষের ধন করে রাখতে হয়,
আর এই ধূসর আত্ম প্রত্যাশা-কাতর
পিছু ধাওয়া করে ডুবন্ত সূর্যের মতো জ্ঞানকে,
মানুষের অকিঞ্চিৎকর ক্ষমতার অনেক অনেক বাইরে।
তিনখানা সূর্য, অবশ্যই। চল্লিশেরও বেশি ছিল, ইউলিসিস হয়তো নিজেই লজ্জা পেয়ে যেত। কিন্তু পরের পদ্যটা আরো বেশি মিলে যায়:
উপসাগরের দল আমাদের ধুয়েমুছে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতেও পারে,
আমরা অবশেষে সুখ-দ্বীপপুঞ্জের সন্ধান পেয়ে যেতেও পারি,
আর মহান একিলিসকে দেখ একটি বার, আমরা যাকে চিনতাম।
যদিও নেয়া হয়েছে অনেক, অপেক্ষা করছে অনেক; এবং যদিও
আজ আর অতীতের শক্তি-মদ-মত্ততা নেই আমাদের ভেতর
নিরন্তর ঘুরে চলে পৃথিবী আর স্বর্গ; আমরা যা, আমরা তা-ই;
সেই একই সমান, সতেজ বীর-হৃদয়
সময় আর ভাগ্য যাকে ক্ষীণকায় করে তুলেছে, শুধু আছে শক্ত ইচ্ছা
সংগ্রামের জন্য, অনুসন্ধানের জন্য, পাবার জন্য, পুরস্কারের জন্য নয়।
অনুসন্ধানের জন্য, পাবার জন্য… আজ সে জানে ঠিক কী খুঁজে বেড়াচ্ছিল এতোদিন তার মন। খোঁজার জন্য এবং পাবার জন্য… সে জানে খোঁজার ও পাবার স্থানটা কোথায়। আর তাকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ নেই।
এই লক্ষ্যটাকেই যে সে সব সময় সচেতনভাবে মনে রেখেছিল এমন নয় । ফ্লয়েড জানেও না ঠিক কী কারণে ব্যাপারটা এত অগ্রাধিকার পাচ্ছে। সে হয়তো মানবজাতির দিকে আবারো আসতে থাকা জ্বরের প্রতিষেধক মনে করে নিজেকে দ্বিতীয় বারের মতো!-কিন্তু তার ভুলও হয়ে থাকতে পারে। কিংবা ইউনিভার্স এর অভিযাত্রীদের শর্ট লিস্টে তার নাম রাখার অতল প্রলোভন তার মনের গহীনে লুকিয়ে ছিল, সেটাই জেগে উঠছে।
আরো একটা সম্ভাবনা আছে, এই এতো বছর পরেও, ১৯৮৫/৮৬ সালের দ্বন্দ্বে মানুষের মনোভাবের কথাটা ভোলা যায়নি। এবার একটা সুযোগ এসেছে-তার জীবনের শেষ সুযোগ-আর মানুষের জন্য প্রথম বারের মতো-যার মাধ্যমে আগের সব অসন্তুষ্টি কাটিয়ে ওঠা যায় ।
সেই বিংশ শতাব্দীতে শুধু ওড়াউড়িই সার ছিল। এরচে বেশি কিছু করা মুশকিল। কিন্তু আজ সত্যি সত্যি ল্যান্ড করা সম্ভব। পথ দেখিয়েছিল আর্মস্ট্রং আর। অলড্রিনের চাঁদের বুকে প্রথম পদক্ষেপ।
ডক্টর হেউড ফ্লয়েড, ২০০১ সালের চাঁদের মনোলিথ বিষয়ক সিদ্ধান্তদাতা, ২০০১ সালের বৃহস্পতি-শনি মিশনের সর্বেসর্বা, ২০১০-১৫ সালের বৃহস্পতি অভিযানের অংশগ্রহণকারী তার সমস্ত কল্পনাকে উড়তে দিল। অতল মহাকাশ থেকে উঁকি দেয়া সেই পরিদর্শকের চারপাশে উড়তে দিল। সেই অতিথি নিজের গতি আরো আরো বাড়িয়ে নিচ্ছে, প্রদক্ষিণ করবে সূর্যকে। আর পৃথিবী ও শুক্রের অর্বিটের মাঝামাঝি এখনো অসম্পূর্ণ স্পেস লাইনার ইউনিভার্স তার প্রথম উড্ডয়নেই মিলিত হবে স-ব ধূমকেতুর রাজার সাথে।
সম্মিলনের জায়গাটা কাঁটায় কাঁটায় ঠিক করা হয়নি, কিন্তু তার সিদ্ধান্ত ঠিকই ঠিক করা হয়ে গেছে।
হ্যালি-এইতো, আসছি আমি…, ফিসফিস করে ওঠে হেউড ফ্লয়েড।
২. প্রথম দর্শন
এমন কোনো কথা নেই- কেউ পৃথিবী ছাড়লেই যে পরিপূর্ণ স্বর্গসুধা পানের উদ্দেশ্যেই শুধু যাবে। আর আকাশ থেকে দেখা আকাশ ও পৃথিবীর যে কোনো উঁচু পর্বতশৃঙ্গ থেকে মেঘহীন রাতে দেখা আকাশের মধ্যেও একচুল ফারাক নেই। আসলে আকাশ এর চিত্রপটে তেমন কোনো বদল দেখাই যায় না। এমিতে বায়ুমণ্ডল ভেদ করে তারার আলো আরো উজ্জ্বল দেখায়, সাথে নক্ষত্রলোককে আরো উদ্দীপিত লাগে, কিন্তু খালি চোখে স্পেস থেকে দেখা আকাশ আর নিচ থেকে দেখা আকাশের মধ্যে তেমন কোনো তফাৎ পাওয়া যাবে না। এই অবজার্ভেশন উইন্ডো তো এক লহমায় তুলে আনতে পারে না আধখানা পৃথিবীকেও।