এই সব। আফসোস, সেখানে কোনো অপারেটর ডিউটিতে নেই। সে ক্যামেরাটা প্যান করে নিচের দৃশ্য স্পষ্ট ধারণ করতে পারত। সার্কিটও বন্ধ রাখা যেত তাহলে। আমি জানি আপনি জিনিসটা দেখতে চান, যদিও তাতে করে আপনার থিওরির গুড়ে বালি লেপ্টে যাবে।
কী করে? বিরক্ত হওয়ার চেয়ে ধাঁধায় পড়ে গেছে ভ্যান ডার বার্গ।
দৃশ্যটুকু স্লো মোশনে দেখলে বুঝবেন। এই সৌকর্যময় রঙধনুগুলো বায়ুমণ্ডলের ফল নয়, বরং স্বয়ং পাহাড়ের কারসাজি। শুধু বরফের পক্ষেই এমন দৃশ্য তুলে আনা সম্ভব, আর নাহলে কাঁচ দরকার। কাঁচটা এখানে অপ্রাসঙ্গিক, কী বলেন?
অসম্ভব নয়, আগ্নেয়গিরি থেকেও গলিত কাঁচ সৃষ্টি হয়, কিন্তু ওগুলো সাধারণত কালো রঙের…অবশ্যই!
মানে?
তথ্য না পেলে আমি কোনো দাবী করব না। কিন্তু আশা করি আমার ধারণাটা একেবারে স্বচ্ছ। ওটা স্বচ্ছ কোয়ার্টজের সৃষ্টি নয়তো? এ দিয়ে সহজেই প্রিজম আর লেন্স বানানো যায়। আরো অবজার্ভেশনের সম্ভাবনা আছে কি?
মনে হয় না। একেবারে ভাগ্যগুণে এবার পেরেছি। ভাগ্য আর কাকে বলে, সূর্য, পাহাড়, ক্যামেরা সব একই সাথে এসেছে। তার সাথে ছিল মেঘহীন আকাশ। দুর্লভ; সত্যি, হাজার বছরে আরেকবার এ সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না আর।
“থ্যাঙ্কস, এনি ওয়ে, আপনি কি একটা কপি পাঠাতে পারবেন? তাড়াহুড়োর কিছু নেই। পেরিনের দিকে একটা ট্রিপে বেরুচ্ছি, না ফিরে চোখ বুলাতে পারব না।
ভ্যান ডার বার্গ একটা ছোট, সুন্দর হাসি দিল।
ইউ নো, সেটা যদি সত্যি সত্যি রক ক্রিস্টাল হয়ে থাকে তো আমাদের নানা সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমনকি বেতন নিয়ে গণ্ডগোলটাও কেটে যাবে সই করে…
কিন্তু ভাবনাটা একেবারেই ছেলেমানুষী। কবেইতো মানা করে দেয়া হয়েছে, সবখানে যাও তোমরা, এখানে নয়। পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল। এমন কোনো লক্ষণ প্রকাশিত হয়নি যাতে বোঝা যাবে যে নির্দেশটা আর বহাল নেই।
১০. বোকার স্বর্গ
অভিযানের প্রথম আটচল্লিশ ঘণ্টা পর্যন্ত হেউড ফ্লয়েডের ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না কোনোকিছুই; ধূমকেতু, ইউনিভার্স আর এর জীবনপদ্ধতি, সবই যেন অবিশ্বাস্য। এরই মধ্যে তার সহযাত্রীদল আনন্দে আটখানা। যারা কোনোদিন পৃথিবী ছাড়েনি এর আগে, তারা মনে করে স-ব স্পেসশিপ অবশ্যই এমন হতে হবে। হওয়াটা উচিত।
কিন্তু সে এতো কাঁচা নয়, অ্যারোনটিক্সের ইতিহাস ঘাঁটতে হবে তাকে। তার জীবদ্দশায়ই কত শত উত্থান-পতন! নিজেই পেছনের সেই জ্বলজ্বলে গ্রহটার উড্ডয়নবিদ্যায় কতশত নূতনত্বের স্বাদ যে নিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সেই পুরনো লিওনভ আর এই তারুণ্যমাখা ইউনিভার্সের মধ্যে পড়ে আছে কাঁটায় কাঁটায় পঞ্চাশটা বছর। আবেগিক দিক দিয়ে সে ঠিক বিশ্বাস করতে চায় না কথাটা, কিন্তু কী করা, বিধি বাম, এই ছিল কপালে।
সেই রাইট ব্রাদারদের যুগ, তার আধ-শতক কাটতে না কাটতেই রকেটের তর্জন-গর্জন, তার পর পরই একের পর এক ফুয়েল-উন্নয়ন! অবিস্মরণীয়। আর এখন সেকেন্ডে হাজার কিলোমিটার। কিন্তু মাঝের বিশাল সময়টাও বিবেচ্য।
তাই, হয়তো, তার উচিত ছিল না আশ্চর্য হওয়া। হোক না ঘরটা অতি সুন্দরভাবে সাজানো, এমনকি এই সাজানো ঠিক রাখার জন্য একজন কাজের লোক থাকলেও অবাক হওয়ার মতো কী হল? জানালার বাহারও দেখার মতো। আর ঘরতো ঘর নয়, প্রকাণ্ড স্যুইট। ভেতরে টনকে টন বাতাসের চাপ থাকলেও তার মন পড়ে থাকে বাইরে, নিঃসঙ্গ শূন্যতায় ।
আধুনিক সাহিত্য তার মনকে ব্যাপারটার জন্য প্রস্তুত করেছিল, তবু, মাধ্যাকর্ষণের স্বচ্ছ উপস্থিতি যেন কেমন ভড়কে দেয়। ইউনিভার্স মানবেতিহাসে প্রথম স্পেসশিপ যা একবার ধাক্কা দিয়ে সারা পথ চলবে না বরং, নিয়মিত ত্বরণে গতিবৃদ্ধি চলতেই থাকবে মাঝখানের সামান্য তুনা রাউন্ড বাদ দিয়ে।
তার দানবাকার প্রোপ্যাল্যান্ট ট্যাঙ্কে পাঁচ হাজার টন পানি পূর্ণ করে নিয়েও এক দশমাংশ জি তোলা সম্ভব হয়। মোটামুটি ভালই বলা চলে, কিন্তু তার পরও নতুন যাত্রীদের নড়াচড়ার রীতি আর স্যুপ খাবার সময় আস্তে চামচ তোলার কায়দা রপ্ত করার পথে হোঁচট খেতে খেতে কদিন কেটে গেছে ।
এরই মধ্যে ইউনিভার্স তার বুকের মানুষদের চার শ্রেণীতে ভাগ করে নিয়েছে।
আভিজাত্যের শুরু ক্যাপ্টেন স্মিথ আর তার অফিসারদের থেকে, পরের শ্রেণীতে আছে যাত্রীরা; এরপরই নন কমিশন্ড আর সাধারণ ক্রুরা। সবশেষে …।
এই বাস্তব কৌতুকটা প্রথমদিকে পাঁচ তরুণ মহাকাশ বিজ্ঞানী নিজেদের জন্য ঠিক করেছিল, পরে ব্যাপারটা বেশ তিক্ত হয়ে পড়ে। ফ্লয়েডের সুইটের সাথে তাদের ছোট্ট কোয়ার্টারের বিস্তর তফাৎ। ব্যাপারটা ক্যাপ্টেনের চোখে তুলে ধরা ছাড়া উপায় ছিল না।
শিপকে প্রস্তুত করতে হয়েছে শেষ মুহূর্তে, চট-জলদি করে। কারণ হ্যালির জন্যে সে আরো পৌণে শতাব্দী নাও টিকতে পারে। তাই আবাসনের জটিলতা হতেই পারে।
আর সায়েন্টিফিক টিমের তো হাজারো কাজ করার আছে, শিপের বাইরে যাওয়া, হ্যালির বুকে নামা, আরও কত ঝক্কি-ঝামেলা। তাছাড়া এই অভিযানের গুরুত্বও তো তারা জানে, তাই না? প্রথম ধাক্কায় একটু খারাপ লাগতেই পারে।
একটু আবেগ আর উচ্ছ্বাস বেরিয়ে আসে সেসব তরুণের বুক থেকে। তাদের গুঞ্জন তোলা ভেন্টিলেশন সিস্টেম, দমবন্ধ হয়ে যাওয়া কেবিন আর অজানা পদের বিশ্রী গন্ধ নিয়ে আরো হাজারো অভিযোগ করার আছে।