অথবা এটা চান্দ্রবিদ বা সেলেনোলজিস্টদের বিশ্বাস। এই চেঁচামেচি আর রহস্যের শুরু প্রথম যেদিন গ্যালিলিও গ্যালিলি চাঁদের দিকে তাঁর টেলিস্কোপ ফেরান সেদিন থেকেই। কারণ কিছু কিছু চান্দ্র পর্বত এমনভাবে আলো ছড়ায়, যেন মাথায় বরফ-কিরীটি নিয়ে বসে আছে। আধুনিক অ্যাস্ট্রোনমির জনক উইলিয়াম হার্শেল মহা ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলেন অ্যারিস্টার্কাস পর্বতের বিরাট জ্বালামুখটার দেদীপ্যমান রূপ দেখে; নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন চাঁদে অগ্নি উদগীরণ হচ্ছে। তার উপর সময়টা রাতের। কিন্তু এখানেও ভুল হয়েছিল। তিনি তিনশো ঘণ্টায় জমে ওঠা পাতলা চকচকে কিছু দেখেছিলেন জ্বালামুখটায়। আর তার থেকে যে আলো ঠিকরে বেরুচ্ছিল তা পৃথিবী থেকেই আসা।
কিন্তু অবশেষে হতাশা থেকে বাঁচা গেল। চাঁদের গভীরে এক বিশাল বরফ স্তর আবিষ্কার হওয়ার পর থেকেই মহাকাশ ভ্রমণের বাধা আরো কমে যায়।
সুং নৌবহরের প্রথমটির নাম কসমস। সে মানুষ আর জিনিসপাতি বহন করে পৃথিবী-চাঁদ-মঙ্গল রুটে। একই সাথে পরীক্ষা চলছে মিউওন ড্রাইভের। এটা নির্ভেজাল চলতে থাকলে ড্রাইভটা স্বীকৃতি পাবে ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান আর সরকারের কাছে। কারণ কসমসের সাথে হাজারো রকমের চুক্তি হয়েছে তাদের। ইম্বিয়াম শিপইয়ার্ডে জন্মাবার পর সে শুধু চাঁদের মাধ্যাকর্ষণটুকু কাটিয়ে উড়ে যাবার ক্ষমতা পেয়েছে। তাও আবার বিনা ভারে। আর কোনোকালেই সে কোনো ভূমি স্পর্শ করবে না। অর্কিট থেকে অর্বিটে ঘুরবে, গ্রহ থেকে গ্রহে। অনেকটা বিজ্ঞাপন হিসেবেই স্যার লরেন্স এটাকে স্পুটনিক দিবসের শততম বার্ষিকীতে মহাকাশে পাঠায়। দিনটা ছিল চৌঠা অক্টোবর, দু হাজার সাতান্ন।
দু বছর পরেই কসমসের আরেক বোনের জন্ম হয়। গ্যালাক্সির জন্ম পৃথিবী বৃহস্পতি পথ ধরে চলার জন্য। সে আরো ক্ষমতা রাখে, নিয়মিত বৃহস্পতীয় চাঁদগুলোয় নামতে এবং উঠতে পারবে, বেশ খানিকটা পে-লোড সহ! এমনকি প্রয়োজনে একটু চিকিৎসা নিতে তার জন্মস্থান চাঁদের বুকেও নেমে যেতে পারবে।
মানুষের বানানো সর্বকালের সবচে গতিময় বাহন সে। সবটুকু প্রোপ্যাল্যান্ট এক ধাক্কায় পুড়িয়ে দিলে প্রতি সেকেন্ডে হাজার কিলোমিটার ছাড়িয়ে যেতে পারবে। অবিস্মরণীয় গতি! বৃহস্পতি-পৃথিবী ট্রিপ সম্ভব মাত্র এক সপ্তাহে, দু বছর নয়। আর এই অবিস্মরণীয় গতিতে নিকটতম নক্ষত্রলোকে যেতে লাগবে হাজার বছরের কিছু বেশি সময়।
এ নৌবহরের তৃতীয়জনই স্যার লরেন্সের সমস্ত বিজ্ঞানীকুলের সব দরদ ঢেলে তৈরি করা ক্ষণজন্মা মহাকাশ অগ্নিরথ, ইউনিভার্স। দু বোনের সমস্ত জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর অভিজ্ঞতার সাথে সাথে বিজ্ঞানের অগ্রগতি যুক্ত হয়েছে তার সারা গায়ে, অলঙ্কারের মতো।
পৃথিবী থেকে সৌর জগতের হীরা শনির দিকে সেই প্রথম যাত্রীবাহী রণপোত।
স্যার লরেন্সের ইচ্ছা ছিল এর উদ্বোধনে আরো বিচিত্র কিছু করার। কিন্তু কিছু বিদঘুঁটে আন্দোলনের কারণে নির্মাণ পিছিয়ে যায়; কয়েকটা টেস্ট ড্রাইভের পর লয়েডস এর সার্টিফিকেট নিতে নিতে দু হাজার ষাটের শেষ মাস এসে পড়বে। কিন্তু আফসোস, হ্যালির ধূমকেতু তো আর অপেক্ষা করবে না, এমনকি স্যার লরেন্স সুংয়ের জন্যও নয়।
৯. দেবরজের পর্বত
ইউরোপা-৬ পর্যবেক্ষণ উপগ্রহ পনের বছর ধরে অর্বিটে ঝুলে আছে। অবশ্য এর প্রত্যাশিত আয়ু এরই মধ্যে ফুরিয়ে গেছে একেবারে; কিন্তু কাজ চলায় একে সেখানেই রাখা হবে, নাকি অন্য একটা বসানো হবে তা নিয়ে গ্যানিমিডের ছোট্ট সায়েন্টিফিক এস্টাবলিশমেন্টে একটু কথাবার্তার ঝড় উঠবে এই যা।
এতে চিরাচরিত জিনিসপাতি ঠাসা ছিল। যেমন আজকাল অচল হিসেবে বিবেচিত ইমেজিং সিস্টেম। তবু বিজ্ঞানীরা ইউরোপার সদা অপরিবর্তিত মেঘের দল ভেদ করার লক্ষ্যে সেটাকেই তরতাজা রাখে। বর্তমানে কুইক লুক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক সহজে পৃথিবীর পথে ডাটার প্রবাহ পাঠানো যাচ্ছে প্রতি সপ্তাহে। তাই ওরা বরং স্বস্তি পাবে যদি ইউরোপা-৬ তার অপ্রয়োজনীয় তথ্যভাণ্ডার খালি করে আর সামনে না এগোয়, যদি অকেজো হয়ে যায়।
কিন্তু এখন, এ্যাত্তোদিন পরে, প্রথমবারের মতো শিউরে দেয়া কিছু কাজের কাজ করল সে।
অরবিট ৭১৯৩৪, বলল ডেপুটি চিফ অ্যাস্ট্রোনমার, রাতের পাশ থেকে এগিয়ে আসছে, সরাসরি মাউন্ট জিউসের দিকে। অবশ্য আগামী দশ সেকেন্ড কিছুই দেখতে পাবেন না।
ভ্যান ডার বার্গ দেখল স্ক্রিনটা পুরোপুরি কালো । অবশ্য কল্পনা বশ মানছে না। মেঘের ছাদের হাজার কিলোমিটার নিচে বরফের মহাসাগর দিব্যি চোখে ধরা দেয়। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দূরের সূর্য দেখা যাবে। এদিকে ইউরোপা ঘুরে গেছে আরো একপাক। প্রতি সাত পৃথিবী-দিনের পর পরই ঘোরে। রাতের পাশ না বলে আসলে গোধূলী পাশ বলাই ভাল। অর্ধেক সময় শুধু হাল্কা আলো ছিল, তাপ নয়। কারণ এর অন্য অর্থ আছে, ইউরোপা সূর্যোদয় চেনে, লুসিফারোদয় নয়।
আর এগিয়ে আসছে সেই দূরের সূর্য, সৌরজগতপতি; মিলিয়ে যাচ্ছে আঁধার।
এতো হঠাৎ আলোর ঝলকানি এলো যেন কোনো আণবিক বিস্ফোরণ হয়েছে। সেখানে। এক সেকেন্ড না পেরুতেই রঙধনুর সবগুলো রঙ পেরিয়ে উজ্জ্বল সাদার বন্যা তলিয়ে দিল সবকিছু। কারণ সূর্য এবার উঠে এসেছে পাহাড় পেরিয়ে। তারপর হারিয়ে গেল। অটোম্যাটিক ফিল্টারগুলো সার্কিট কেটে দিয়েছে।