স্মৃতির কোন গহীন থেকে সাঁতরে লাইনটা উপরে উঠে এল? হেউড ফ্লয়েড বন্ধ করল চোখ দুটো। অবশ্যই কোনো কবিতার লাইন। আর কলেজ ছেড়ে আসার পর সে কি আদৌ কোনো কবিতা পড়েছে? অবশ্য একবার একটা ছোট ইংরেজির সেমিনারে বসেছিল।
তারপরই স্টেশন কম্পিউটারে কথাটা প্রবেশ করিয়ে দেয়ার পর লাইনটা খুঁজে বের করতে বেশ অনেকটা সময় নেয় কম্পিউটার। দশ মিনিট। কবিতার নাম জানা থাকলে কয়েক সেকেন্ড লাগতো, কিন্তু পুরো ইংরেজি সাহিত্য চষে ফেলে লাইনটা খুঁজে বের করা চাট্টিখানি কথা নয়।
যুদ্ধের কবিতা, কিন্তু কোন যুদ্ধের? বিংশ শতাব্দীটাইতো যুদ্ধের ডামাডোলে গেল…
এখনো মনের কুয়াশা ছিন্ন করে খুঁজে যাচ্ছে সে লাইনটাকে। এরই মধ্যে তার মেহমানরা এসে পড়েছে; এক-ষষ্ঠাংশ মাধ্যাকর্ষণে অভ্যস্ত তারা, নড়াচড়া করে ধীরে ধীরে। পাস্তুরের সমাজ কেমন বদলে যাচ্ছে। যারা নড়তে পারে না তেমন, তারা পছন্দ করে হাসপাতালের মাঝামাঝি এলাকাটাকে। প্রায় মাধ্যাকর্ষণহীন। আর পাস্তুরকে ভালবাসে যারা তাদের আবাস কিনারা আর মধ্যবিন্দুর মাঝে। সেখানে মাধ্যাকর্ষণ চাঁদেরই মতো। কিন্তু একদল মানুষ ফিরে যেতে চায় উৎসভূমি পৃথিবীতে, তারা বেছে নিয়েছে প্রান্তভাগ। এখানেই ফোর্সটা সবচে বেশি।
আজকাল জর্জ আর জেরিই হেউড ফ্রয়েডের সবচে পুরনো বন্ধু। ব্যাপারটা মজার, কারণ তাদের মধ্যে মিল ছিল সামান্যই।
তুমি কি কখনো ডিভোর্সের কথা ভাবনি? সে মাঝেমধ্যেই খোঁচা দেয়ার ভঙ্গীতে প্রশ্ন করেছিল।
স্বভাবত জর্জও বাঁকা পথে জবাব দেয়। জর্জের কারণেই ক্লাসিক অর্কেস্ট্রা ফিরে এসেছে বিনোদনের জগতে।
ডিভোর্স-কখনোই না তারপর একটু থামে, খুন-কখনো কখনো।
অবশ্যই, সে কখনোই পালাবে না। ফোড়ন কাটে জেরি, সেবাস্টিয়ান বরং সিমগুলো ফেলে দিবে।
সেবাস্টিয়ান হল তাদের আনা তোতা পাখি, অনেক কষ্টে তাকে আনা গেছে। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের সাথে বচসা করে। সে শুধু কথাই বলতে পারে না, বরং সিবেলিয়াস ভায়োলিন কনসার্তোও বাজাতে পারে মুখে মুখে। যে কাজে জেরি অর্ধশতাব্দী আগে অ্যান্টোনিও স্ট্রাভার্দির সাথে বিস্তর সুনাম কুড়িয়েছিল।
এবার জর্জ, জেরি আর সেবাস্টিয়ানকে বিদায় জানাবার পালা। হতে পারে মাত্র কয়েক হপ্তার জন্য, চিরদিনের জন্যও হতে পারে। এরই মধ্যে বাকী সবার সাথে বিদায় নেয়া হয়ে গেছে একটা পার্টি দেয়ার মাধ্যমে। হাসপাতালের মদের সেলারটাও বেশ। হাল্কা হয়ে গেছে সেই সুযোগে। তেমন কোনো কাজ আর বাকী নেই।
আর্চি, তার পুরনো মডেলের কার্যকর কমসেককে ভালমতো প্রোগ্রাম করা হয়েছে, সে ঠিকঠিক গুছিয়ে নিতে পারবে নতুন আসা মেসেজগুলোকে। বেশিরভাগের সুন্দর, ভদ্র জবাব পাঠিয়ে দেবে সাথে সাথে। বেশি গুরুত্বপূর্ণগুলো চলে যাবে ইউনিভার্সের বুকে।
এই এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেও যদি যার সাথে ইচ্ছা কথা বলা না যায় তো ব্যাপারটা কেমন বেখাপ্পা ঠেকবে? অবশ্য ভাল দিকও আছে, যাকে অপছন্দ তাকে এড়ানো যাবে সহজেই। এতো দূর চলে যাবে ইউনিভার্স স্পেসশিপ যে আর সরাসরি কারো সাথে কথা বলা সম্ভব নয়। কারণ আলো যেতেই মিনিট-ঘণ্টা পেরিয়ে যাবে। কথা হবে টেলিটেক্সট অথবা রেকর্ডে।
আমাদের ধারণা ছিল তুমি আমাদের বন্ধু, অভিযোগ করছে জর্জ, তোমার পক্ষে কাজ করতে হবে আমাদের, অথচ রেখে যাচ্ছ না কিছুই।
দু একটা চমক তো তোমাদের জন্য থাকছেই, ক্যাবলা-হাসি দিয়ে বলল ফ্লয়েড, সাধারণ খবরগুলো দেখবে আর্চি। তোমরা শুধু দেখবে ও কিছু বুঝতে না পারলে, এই আরকি।
ও না পারলে আমরা কস্মিনকালেও পারব না। তোমার ওই ছাইপাশ সায়েন্টিফিক সোসাইটির মাথামুণ্ডু আমরা যে কী বুঝব আল্লা মালুম।
ওদের নিয়ে চিন্তা নেই আমার, নিজেদের আখের ভালই গোছাতে জানে। খেয়াল রেখ যেন ক্লিনার ঘরটাকে উজবুকের মতো আলুথালু করে না ফেলে। আর যদি ফিরে না-ই আসি তো এখানে কিছু ব্যক্তিগত জিনিস আছে, সেসব বিভিন্নখানে পৌঁছে দিতে হবে। বেশিরভাগই পারিবারিক।
পারিবারিক! কথাটা বলার মধ্যে যেন নিযুত দুঃখ এগিয়ে আসে, আর আসে অনেক অনেক সুখের স্মৃতি।
আজ তেষট্টি বছর ধরে… তেষট্টি বছর! ম্যারিয়ন নেই। সেই যন্ত্রণাময় বিমান দুর্ঘটনা! আর এর পরই একটু অপরাধী মনে হয় নিজেকে, যতটা উচিত ততটা বেদনাবোধ যেন তার নেই, কিংবা স্মৃতি অনেক অনেক পলেস্তারা বসিয়ে দেয় মানুষের মনে।
সে কি আজো বেঁচে থাকতো না? মাত্র একশ বছর বয়েস হত এতোদিনে। কাঁটায় কাঁটায়…
আর তার সেই দুই অতি আদুরে কন্যা আজ ধূসর চুল নিয়ে হাজির হয়, সাথে থাকে ছেলেমেয়ে, এবং নাতি নাতনী! তাদের নিজের। বয়েস তো ওদেরও কম হল না, ষাটের ঘর পেরিয়ে যাচ্ছে।
সেদিকে আছে নজন। আর্চির সহায়তা ছাড়া তাদের নামও ঠিকমতো মনে করা কঠিন। আর ভালবেসে হোক বা দায়িত্ববোধে- তারা প্রতি ক্রিসমাসেই তাকে মনে করে। জানে তার নাম।
অন্যদিকে আবার বিয়ে; প্রথম স্ত্রী হারানোর যন্ত্রণা মুছে যাওয়া; আবার বিচ্ছেদ-অর্ধশতাব্দী আগে; পৃথিবী আর বৃহস্পতির মাঝামাঝি কোথাও। কিন্তু আশা ছিল-ছেলেকে ফিরে পাবার আশা, স্ত্রীকে ফিরে পাবার আশা। কিন্তু দেখা হল ফিরে আসার পরে সবার জন্য দেয়া পার্টিতে। নিতান্ত পরিচিত একজনের মতোই! তারপর আর কী, অসাবধানতা, অবসাদ, ভরবেগের হিসাব ঠিক রাখতে না পেরে দোতলার বারান্দা থেকে পড়ে যাওয়া এবং সবশেষে, পাস্তুর।