এর চন্দ্রকলার আকার দেখতে মনোহর। কিন্তু যখন লুসিফার আর গ্যানিমিডের মাঝামাঝি চলে আসে তখন একটা কালো চাকতি যেন। চারধারে আগুনের গোল দাগ। জ্বলন্ত। সেটা ছোট সূর্যেরই আলোর বিচ্ছুরণ।
মানুষের জীবদ্দশার অর্ধেক সময়ের মধ্যেই ইউরোপা আমূল বদলে গেল। লুসিফারের দিকে সারাক্ষণ মুখ করে থাকা প্রান্তের গহীন বরফ গলে গেল কদিনেই। সৃষ্টি হল সৌর জগতের দ্বিতীয় গলিত সাগর। একটা যুগ ধরে এটা বাষ্পের ঝড় তুলে চলল। অকূল সমুদ্রের চারদিকে পানির ফোয়ারা বাষ্পে পরিণত হচ্ছে। তারপরই দেখা দিল অদৃষ্টপূর্ব ভূভাগ। আজ ইউরোপার আছে একটা নিজস্ব, কার্যকর (কিন্তু মানুষের জন্য নয়) পাতলা বাষ্প-বায়ুমণ্ডল। এখানে আছে হাইড্রোজেন সালফাইড, কার্বন। সালফার ডাই অক্সাইডও এতে শামিল। এমনকি নাইট্রোজেন আর বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য গ্যাসের সমাহারও চোখে পড়ে।
উপগ্রহটার তথাকথিত রাতের দিক আজো জমে আছে গত কোটি বছরের মতো। তার পরও মাঝে মাঝে পানির দেখা মেলে, সেই পানিতে ভাসে বরফের বিশাল বিশাল চাকতি। আর পেছনের বরফ-ভাগটা আফ্রিকার সমান।
এসবই পৃথিবীর অর্বিটে ভেসে বেড়ানো টেলিস্কোপের মাধ্যমে দেখতে হয়েছে। তারপর ২০২৮ সাল এগিয়ে এল । গ্যালিলিয়ান চাঁদগুলোর দিকে চালানো হল প্রথম পূর্ণমাত্রার অভিযান। এরই মধ্যে ইউরোপা এক স্থায়ী মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে সারা জীবনের জন্য। এরপর খুবই সাবধানে প্রোবিংয়ের পালা। দেখা গেল এখনো সাগর শুকায়নি। পুরো ইউরোপা আজো সৌরজগতের সবচে মসৃণ রিয়েল এস্টেট।
দশ বছর পরই আর কথাটা খাটলো না। অদ্ভুত কিছু একটা ঘটছে সেখানে; ইউরোপায়। সাগরের বুক চিরে, চির গোধূলী অঞ্চলের বরফ তেড়েফুঁড়ে মাথা তুলে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে এভারেস্টের মতো বিশাল এক পর্বত। হাজার হলেও, ইউরোপার প্রতিবেশী আইও। তার কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে এই উপগ্রহও অগ্নি উদগীরণ শুরু করে দিল। তারই ফলে এই মহাপর্বতের উত্থান কিনা কে জানে!
কিন্তু এই ব্যাখ্যার সাথে কিছু ঘাপলাও আছে। মাউন্ট জিউস অনেকটা অমসৃণ পিরামিড। স্বাভাবিক অগ্নিগিরির মতো নয়। আর রাডার স্ক্যানেও স্বাভাবিক লাভা প্রবাহের কোনো খোঁজ লাগানো যায়নি। কারণ আছে। গ্যানিমিড থেকে সারাক্ষণ তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকার পর হালকা মেঘ সরে গেলে যে ছবি তোলা যায় তাতে মনের তুষ্টি আসে না কিছুতেই। বরং অস্পষ্ট ছবিতে যেটুকু ঠাহর করা যায় তাতে পর্বতটাকেও বরফের তৈরি বলে মনে হচ্ছে। গঠনে যাই থাক না কেন, এর অনধিকার দ্রষ্টাদের চোখে মাউন্ট জিউস এক মহাবিস্ময়।
কোন এক ম্যাভেরিক বিজ্ঞানী বলেছিলেন যে, মাউন্ট জিউস কোনো মহাজাগতিক বরফখণ্ড। স্পেস থেকে ইউরোপার উপর পড়ে যাওয়া কোনো মহাজাগতিক শিলাখণ্ড । অদূর অতীতে এমনটা যে ঘটেছে সে প্রমাণ দিচ্ছে ক্যালিস্টো। কিন্তু তত্ত্বটা গ্যানিমিডের বুকে খুবই অজনপ্রিয়। তার হতেও-পারে-অধিবাসীরা এর মধ্যেই সমস্যায় পড়ে গেছে। এমন যদি হয়েই থাকে, তবে তাদের জীবন কাটবে শঙ্কায় শঙ্কায়।
তারা অনেকটাই আশ্বস্ত হয় যখন ভ্যান ডার বার্গ তার নূতন থিওরি উপস্থাপন করে। উপর থেকে এতো বড় বরফখণ্ড মানুষের চোখ এড়িয়ে গত এক শতাব্দীতে পড়াটা খুবই কঠিন। আর যত কমই হোক, ইউরোপার একটা নিজস্ব গ্র্যাভিটি তো আছে, তার টানে পাহাড়টা ভেঙে যাবার কথা। জবাব আর যাই হোক, বরফ নয়, কারণ ধীরে ধীরে বরফটা সাগরে ডুবছে।
সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় যদি একটা, মাত্র একটা ছোট্ট পোব ইউরোপার আকাশে পাঠানো যায়। কিন্তু একটা কথাই সব উৎসাহে বরফ শীতল পানি ঢেলে দেয় পলকে।
এই সব দুনিয়া তোমাদের–শুধু ইউরোপা ছাড়া।
এখানে নামার কোনো চেষ্টাই করো না।
ডিসকভারি স্পেসশিপের বুক থেকে ধ্বংসের ঠিক আগ মুহূর্তে ঘোষিত সতর্কবাণী ভুলে যাবার কথা নয়। তবু এ নিয়ে লক্ষ যুক্তি তর্কের ধোঁয়া উঠছে অবিরাম।
“নামার দিয়ে কি ভোব পাঠানোও নিষেধ করা হয়েছে, নাকি শুধু মনুষ্য যানের বেলায় নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য? আর না নেমে যদি কাছাকাছি দিয়ে উড়ে যাওয়া হয়, মানুষ থাক বা না থাক, তাহলে? অন্তত বায়ুমণ্ডলের উপরদিকটায় একটা ভাসমান বেলুন পাঠালে ক্ষতি কী?
বৈজ্ঞানিকের দল সমাধান বের করার জন্য চিন্তায় মরলেও সাধারণ মানুষ ঝুঁকি নিতে নারাজ। ভালইতো আছি ভাই পৃথিবীর বুকে। আরো অর্ধশতাধিক গ্রহ উপগ্রহওতো আমাদের। কেন শুধু শুধু ইউরোপায় নাক গলাতে যাওয়া? তাছাড়া সেসব দেখতেই তো শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে যাবে। তারপর নাহয় নাক গলাই।
সেজন্যেই ভ্যান ডার বার্গ ভালমতো বারবার শুনতে পেয়েছে যেন সেসব নিয়ে খুব বেশি ভাবাভাবি না করে। ইউরোপার চিন্তা গৌন। লাখো কাজ পড়ে আছে গ্যানিমিডে। (হাইড্রোপোনিক ফার্মগুলোর জন্য কার্বন, ফসফরাস আর নাইট্রেট যৌগ কোথায় পাই? আর বসতির কাঠামো? সবুজায়ন কেমন হবে, কতটুকু? এবং এমনি আরো হাজারটা প্রশ্নের প্রহেলিকা…)
কিন্তু তার জিনে পরিবাহিত পূর্বপুরুষদের একাগ্রতা সব সময় জেগে থাকে। আর তার চোখ সবসময় থাকে ইউরোপার দিকে, নির্নিমেষ।
তারপর একদিন, মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য, মাউন্ট জিউসের প্রহেলিকাময় যবনিকা একটু সরে যেতেই দেখা গেল তার কাঙ্ক্ষিত চেহারা।
৭.ট্রানজিট
আমিও নিচ্ছি ছুটি, ছুটি নিচ্ছি, যা ছিল আমার, সবকিছু থেকে…