“তারপর দেখতে পাই পুংকেশরগুলো…এ নামেইতো ডেকেছিলাম-এদের ডগার উপরে উজ্জ্বল নীল ফোঁটা ধরে রেখেছে। দেখতে ঠিক ছোট উজ্জ্বল নীল রঙা তারার মতো অথবা ঝিনুকের আবরণের সাথে নীল চোখের মতো-সেগুলোও আলো থেকে সাবধান, কিন্তু সত্যিকারের মুড নিতে পারেনি। তারপর উজ্জ্বল নীল ম্লান হয়ে যায়, সাধারণ পাথরের মতো…
ডক্টর ফ্লয়েড অথবা অন্য যে কেউ শুনছেন… আশা করি কেউ না কেউ শুনতে পাবেন আমার কথা, হাতে খুব একটা সময় নেই, বৃহস্পতি কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সিগন্যাল ব্লক করবে। আমার কথা অবশ্য প্রায় শেষ।
“জানি এরপর আমার কী কাজ। হাজার ওয়াট বাতির তারটা ঝুলছিল মাটির কাছাকাছি। এটাতে হ্যাঁচকা টান মারলে লাইটটা নিভে গেল একটু স্পার্ক করে। অনেক দেরি হয়ে গেছে কিনা ভেবে আমি ভয়ও পেয়েছি কিছুটা। কিছুক্ষণ কিছুই হয়নি। সুতরাং মনের ঝাল ঝাড়তে চারদিকের জট পাকানো শাখাপ্রশাখার দেয়ালের উপর হাঁটতে হাঁটতে লাথি লাগালাম কষে।
“ধীরে ধীরে প্রাণীটি তার শরীরকে ছিন্নভিন্ন করে নেয় গ্র্যান্ড ক্যানেলে ফিরে যাওয়ার জন্য। অনেক আলো থাকার কারণে আমি সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। বৃহস্পতির দুই উপগ্রহ গ্যানিমেড আর ক্যালিস্টো আকাশে ভাসে আর গ্রহরাজ বৃহস্পতি দেখায় পাতলা এক চাঁদের মতো। আইওর ঘুরতে থাকা শেষপ্রান্ত বৃহস্পতির দিকে ফেরানো। উপগ্রহটার রাতের আকাশে মেরুজ্যোতির ফুলঝুরি ফুটেছিল। কোনো প্রয়োজন ছিল না আমার হেলমেট লাইট ব্যবহার করার। আমি বেশ আগ্রহের সাথে দৌড়াই প্রাণীটার পেছনে। একটু ধীর হয়ে এলেই লাথিও দিই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে; অনুভব করি বুটের নিচে বরফ ভাঙার কড়মড় শব্দ…ক্যানেলের কাছাকাছি যেতেই মনে হল এটা শক্তি পেয়েছে আরো। ঠিকই, সে ফিরছে নিজের বাড়িতে। ভয় পাচ্ছিলাম এবার একটু একটু। আবার মুকুল সৃষ্টির জন্য বেঁচে থাকতে পারে। শত্রু এলাকায় কিছু মৃত লার্ভা রেখে সে চলে গেল পানির উপর দিয়ে। খোলা পানিতে কিছুক্ষণের জন্য বুদবুদ উঠল যে পর্যন্ত বরফের একটা চাদর পানির স্তরটাকে শূন্যতা থেকে সরিয়ে না আনে। দৃষ্টি সরিয়ে ফিরে গেলাম শিপের কাছে। যদি কেউ বেঁচে থাকে…এ নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। আমার শুধু দুটি অনুরোধ আপনার কাছে, ডক্টর। যখন ট্যাক্সোনমিস্টরা এই প্রাণীকে শ্রেণীভুক্ত করবে, আশা করি নামটা হবে আমার নামে।
“আর…ডক্টর…প্লিজ…পরের শিপ আসার সময়-তাদের একটু বলে রাখবেন আমাদের কঙ্কাল যাতে চীনে নিয়ে যায়। মাইনাস একশ পঞ্চাশ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে আমরা পচে যাব না। আর…আমার বাসায় আছে ছোট্ট…না, থাক। যা বলছিলাম, বৃহস্পতি আমাদের ধ্বংস করে দেবে কয়েক মিনিটের মধ্যে। আশা করি এবং আমার বিশ্বাস কেউ
কেউ আমার কথাগুলো শুনছে। যাই হোক, যোগাযোগ করার সুযোগ পেলে এ মেসেজ আবার পাঠাব। অবশ্য আমার স্পেস স্যুট যদি তখনো টিকে থাকে।
“ইউরোপা থেকে প্রফেসর চ্যাং মহাকাশ যান জিয়াং ধ্বংসের প্রতিবেদন দিচ্ছি। আমরা ল্যান্ড করলাম গ্র্যান্ড ক্যানেলের পাশে। আমাদের পাম্পগুলো বসানো হয় বরফের কিনারায়…
সংকেতটি ধীরে মিলিয়ে গিয়ে আবার মুহূর্তের জন্য ফিরে এসে শ্রাব্যতার সীমার নিচে নেমে চিরতরে হারিয়ে গেল ।
আবার যোগাযোগের সুযোগ হয় এক সময়। একই ফ্রিকোয়েন্সিতে লিওনভ মনোযোগ দেয়-কিন্তু প্রফেসর চ্যাংয়ের কাছ থেকে আর কোনো মেসেজ আসেনি কোনোদিন।
৬. গ্যানিমিডের সবুজ হয়ে ওঠা
রালফ ভ্যান ডার বার্গ ই এ কাজের জন্য একেবারে উপযুক্ত। উপযুক্ত স্থানে, উপযুক্ত সময়ে। আর কোনো সমন্বয়ই কাজে লাগত না।
সেই সঠিক মানুষ কারণ সে দ্বিতীয় প্রজন্মের আফ্রিকানা রিফিউজি; এবং একজন সুপ্রশিক্ষিত ভূগোলবিদ। দুটো ব্যাপারই সমান গুরুত্বপূর্ণ। জায়গাটা উপযুক্ত, কারণ এটা হল বৃহস্পতি উপগ্রহ জগতের সবচে বড় সম্পদ; আইও, ইউরোপা, গ্যানিমিড, ক্যালিস্টোর মধ্যে তৃতীয়টা।
সময়টা উপযুক্ত, কারণ গত কয়েক দশক ধরে হাজারো পর্যবেক্ষণের ডাটা পাহাড় গড়েছে। ভ্যান ডার বার্গ সাতান্ন সালের আগে এ ভাবনাটার মুখোমুখি হয়নি। আরো একটা বছর তার কেটে গেল নিজেকে পুরো ব্যাপারটা বোঝাতে। এ ব্যাপারটা বোঝাতে যে সে পাগলাটে নয়। আর পরের বছর অর্থাৎ উনষাট সালে পদক্ষেপ নেয় যাতে তার আবিষ্কারে আর কেউ নাক না গলাতে পারে। এবং এতোকিছুর পরে পরের সমস্যাটায় মনোযোগ দেয়ার সময় পেল: এবার কী করা?
সবটাই শুরু হয়ে গেছে। ঘটনার শুরু তার উপজাতীয় চোখে কিছু এলাকা আর ঘটনা খুটিয়ে দেখা থেকে। তার চাকরি প্ল্যানেটারি ইঞ্জিনিয়ারিং টাস্ক ফোর্সে, একজন সদস্য হিসেবে সে দেখে বেড়াতো গ্যানিমিডের প্রাকৃতিক সম্পদ। এর সাথে আরেকটু কাজও ছিল, মাঝে মাঝে পাশের নিষিদ্ধ উপগ্রহে চোখ ফেরানো।
কিন্তু ইউরোপা যেন এক রুদ্ধদ্বার কিংবদন্তী। তার আশপাশের কাউকে প্রবেশাধিকার দেবে না। সাতদিন অন্তর সে গ্যানিমিডের পাশ দিয়ে যায়, আর পাশ কাটিয়ে যায় সেই ক্ষুদে তারকাকে যেটা এককালে বৃহস্পতি ছিল। তৈরি হয় চন্দ্রকলার মতো কলা, মাত্র বারো মিনিটের জন্য। সবচে কাছ থেকে এটাকে দেখতে পৃথিবীর আকাশে চাঁদের চেয়ে একটু ছোট। কিন্তু অন্যপাশে চলে গেলে অনেক ছোট হয়ে যায়।