রাত নেমেছে। শীতল, স্বচ্ছ, বেপরোয়া। আর কোনো বিপদসংকেত নেই। চাঁদ উঠে এসেছে ধীরে ধীরে নিরক্ষীয় এলাকার পেছন থেকে। অপরূপ এ দৃশ্য কোনো মানুষের চোখ কোনোদিন দেখতে পায়নি। আর পর্বতের গর্তগুলোয় বাধা পাওয়া ঘুম এবং ভয় ধরানো প্রতীক্ষার মাঝেও জন্ম না নেয়া প্রজন্মের দু:স্বপ্নেরা জন্ম নেয়।
এদিকে দ্বিতীয়বারের মতো আকাশের একপাশ থেকে আরেক পাশে যাবার সময় ঠিক মাথার উপর দিয়ে পূর্ব দিকে এগিয়ে চলে একটা কিছু। জ্বলজ্বলে এক আলোর বিন্দু। যে কোনো তারার চেয়ে অনেক বেশি আলোময়।
অধ্যায় ২. নব্য প্রস্তর
রাত, ফুরনোর আগেই অকস্মাৎ সচকিত হয়ে জেগে ওঠে চন্দ্র-দর্শী। সারাদিনের ধকলের পর আজ একটু বেশিই পড়ে-পড়ে ঘুমাচ্ছিল সে। উপত্যকার পথ ধরে প্রথম মৃদু ধ্বনি ওর কানে পৌঁছে যায়।
গুহার পুতিগন্ধময় আঁধার পরিবেশে উঠে বসে সে। নিজের সবটুকু অনুভূতিকে ফিরে পেতে কসরৎ করে, তারপর আচমকা ওর মনের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে আতঙ্ক। ওর বয়স এর মধ্যেই গোত্রের বাকীদের আকাঙ্ক্ষার জীবদ্দশা থেকে দ্বিগুণ। এত দীর্ঘ জীবনেও সে কক্ষনো এমন অলুক্ষনে শব্দ শোনেনি। বিড়াল গোষ্ঠীর বড় প্রাণীগুলো নিরবে উঠে আসে। ওদের ধোকা দেয়ার সাধ্য শুধু ভূমিকম্পেরই আছে। মাঝেমধ্যে ডালপালার ভেঙে পড়ার শব্দও শোনা যায়। অথচ এ আওয়াজ ক্রমাগত ভাঙনের মতো। ধীরেসুস্থে আরো প্রবল হচ্ছে। গায়-গতরে বিশাল কোনো প্রাণী যেন রাতের বেলা ঘুরে বেড়াচ্ছে নিজেকে গোপন করার কোনো চেষ্টা না করেই। বেপরোয়া। একবার চন্দ্র-দর্শী ঝোঁপঝাড় উপড়ে ফেলার শব্দ পেয়েছিল ঠিক ঠিক। এসব অকাজ হাতি আর ডায়নোথেরিয়ারা[৪] মাঝেমধ্যেই করে বসে। কিন্তু অন্য সময় তারাতো একদম বেড়ালের মতো নিঃশব্দ।
এবার এমন এক শব্দ আসে যেটা চন্দ্র-দর্শী চিনতে পারেনি। কারণ এর আগে পৃথিবীর ইতিহাসে কখনো ওঠেনি এমন আওয়াজ। পাথুরে জমির বুকে ধাতব জিনিসের আছড়ে পড়ার শব্দ এটা।
ভোরের প্রথম আলোয় নিজের উপজাতি নিয়ে নিচের তটিনীর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় প্রথমবারের মতো চন্দ্র-দর্শী নতুন পাথর এর মুখোমুখি হয়। রাতের বীভৎস ভয়ের কথা এর মধ্যেই বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে মন থেকে, কারণ সেই শব্দের পরপর কোনো কিছু হয়নি। তাই সে এই অদ্ভুতুড়ে জিনিসের সাথে বিপদ বা ভয়ের কোনো সম্বন্ধ পাতানোর চেষ্টাই করে না। হাজার হলেও, এ নিয়ে সতর্ক হবার মতো কিছু পাওয়া যায়নি।
জিনিসটি চৌকো আর নিরেট। লম্বায় চন্দ্র-দর্শীর চেয়ে কম করে হলেও তিনগুণ, তবে প্রস্থের হিসাবে দু-হাতে আটকে দেয়া যাবে। জিনিসটা একেবারেই স্বচ্ছ কোনোকিছুতে তৈরি। এর প্রান্তগুলোয় সূর্যালোক পড়ে ঠিকরে না বেরুলে অস্তিত্ব বোঝা যেত না। চন্দ্র-দর্শী জীবনেও বরফের মুখোমুখি হয়নি। দেখেনি স্ফটিক স্বচ্ছ জল। কোনো প্রাকৃতিক জিনিসের সাথেই এই ভুতুড়ে গড়নের তুলনা চলে না। হঠাৎই যেন খুব আকর্ষণীয় মনে হয় তার কাছে। ও যথেষ্ট সতর্ক। তবু এর চারপাশে ঘুরে বেড়াতে তেমন সময় নেয় না। যেন কিছুই হয়নি। হাত রাখে এর গায়। ঠাণ্ডা আর শক্ত একটা উপরিতল অনুভব করে সে।
কয়েক মিনিটের ইতস্তত ভাবনার পর এক দারুণ সমাধান মাথায় চলে এল। এটা এক পাথর, অবশ্যই পাথর। জন্মেছে রাতের মধ্যেই। অনেক গাছই এমন সব কাণ্ড করে বসে। সাদা, ফলের কাছাকাছি আকৃতির জিনিসগুলো রাতের প্রহরে প্রহরেই গজিয়ে ওঠে। কথা সত্যি, ওগুলো অনেকটাই ছোট, দেখতে গোলপানা। এদিকে এটা বিরাট আর প্রান্তগুলো ধারালো। হায়, চন্দ্র-দর্শীর অনেক পরের আরো বড় বড় দার্শনিক বিশাল বিশাল সব তত্ত্ব নিয়ে এর সামনে হাজির হলেও বোধ হয় একইভাবে বিনা সমাধানে আহত হয়ে ফিরে যাবে।
এই অসাধারণ চিন্তাই চন্দ্র-দর্শীকে পরের তিন-চার মিনিটের মধ্যে এক যুগান্তকারী কাজে প্রবৃত্ত করল। শিঘি এর স্বাদ নিয়ে নেয়া ভালো। পাথরের মতো দেখতে সেসব সাদা গোলগাল গাছ খেতে ভারি মজা (অবশ্য দু-চারটে এমনও মিলে যায় যা অসুখ দিয়ে কাবু করে তোলে); যতটুকু বোঝা যায়, এই লম্বাটাও…?
দু-চারবার চেটে নিয়ে কামড়াতে গিয়েই ও মিথ্যা আশার প্রহেলিকা থেকে মুক্তি পেল। এখানে কোনো পুষ্টির চিহ্নও নেই। সুতরাং একজন সজ্ঞান বন মানবের মতো সে নিজের দল নিয়ে নদীর দিকে এগিয়ে যায়। অন্যদের দিকে চেয়ে নর্তনকুর্দনের পবিত্র দায়িত্বটা পালনের সময় ভুলে যায় স্ফটিক স্বচ্ছ একশিলার সবটুকু কথা।
আজকের খোঁজাখুজি একদম বৃথা। কোনোমতে এক-আধটু খাবার যোগাড় করতে তাদের চষে বেড়াতে হয় গুহা থেকে দূরের বেশ কয়েক মাইল এলাকা। দুপুরের নির্দয় রোদে এক হাড্ডিসার বনমানবী ভেঙে পড়ে। যে কোনো সম্ভাব্য আশ্রয় থেকে অনেক দূরে তারা। চারদিকে জড়ো হল সাথীরা। অবোধ শোকের শব্দ করল। এটুকুই, এরচে বেশি কিছু করার নেই কারো। আর একটু কম পথশ্রান্ত হলেই নিজেদের সাথে বয়ে বেড়াতে পারত। কিন্তু এত বড় দয়া দেখাবার মতো শক্তির যোগান নেই ওদের। তাকে ফেলেই এগুতে হবে। খাদ্য পেয়ে উঠে না এলে নিজের বাকী সম্বলটুকুও খাবারে পরিণত হবে।
বাড়ি ফেরার পথে সে জায়গাটা ওরা পেরিয়ে যায়। সন্ধ্যাবেলা একটা হাড়ও খুঁজে পাওয়া যায় না।