দলটায় ত্রিশজন। কিন্তু চন্দ্র-দর্শীর দল থেকে খুব একটা আলাদা বলে মনে হয় না। এ গোত্রটাকে আসতে দেখেই ওপাশের ওরা উদ্বাহু নৃত্য শুরু করে। হাত ঝকায়, নিজেদের পাশের নালার মাটিতে আঘাত করে চলে। এপাশের ওরাও একই কায়দায় জবাব দেয়।
শুধু একুটুই হয়। কালেভদ্রে বনমানুষেরা একে অন্যের সাথে লড়ে, কুস্তি করে। তাদের খুনসুটিতে দুর্ঘটনা ঘটে খুব কমই। কোনো নখর নেই, নেই তীক্ষ্ণ দাঁত। তার উপর শরীর জুড়ে আছে প্রতিরক্ষার ভারি লোম। একে অন্যের তেমন কোনো ক্ষতিই করতে পারে না। যেভাবেই বলা হোক না কেন, এ ধরনের অনুৎপাদনশীল কাজে খরচ করার মতো বাড়তি শক্তি তাদের থাকে খুবই কম। তর্জনগর্জনই তাদের সার। শুধু নিষ্ফল আক্রোশ দেখানোর কাজটা নিরাপদ আর সুন্দর।
যুদ্ধংদেহী ভাব চলল পাঁচ মিনিটের মতো, তারপরই যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছে তেমন করে শেষ হয়ে যায় প্রদর্শনী। শেষে প্রত্যেকে পেটপুরে শুষে নেয় কাদাজল। জরুরী কাজ শেষ। আত্মা শান্তি পেয়েছে, এবার যার যার পথ ধরে তারা। গুহা থেকে মাইলখানেক দূরে সবচে কাছের চারণভূমি, সেটাকে ভাগাভাগি করে নিতে হবে বিশালদেহী অ্যান্টিলোপের মতো জানোয়ারের সাথে। সেসব জন্তু পরোয়া করে ওদের থাকা-না থাকাকে। প্রাণীগুলোকে সরিয়ে দেয়া যায় না, কারণ ওরা মাথায় ভয়াবহ ভোজালী-তলোয়ার নিয়ে রণসজ্জায় সজ্জিত। এই শিংয়ের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ বনমানুষদের নেই।
তাই চন্দ্র-দর্শী আর ওর সব সাথী মিলে চিবিয়ে বেড়ায় বেরী, শুকনো ফল আর লতাপাতা; তীব্র জ্বালার সাথে যুদ্ধ করে চলে। অথচ তাদের চারপাশের এসব প্রতিযোগীর সাথে ভাগজোখ করে তৃণ খেয়ে বেড়ানোর কথা না। সেসব প্রাণীই হতে পারত অফুরান, অকল্পনীয় খাদ্যের নিশ্চিত ভাণ্ডার। এই এখনো চারণভূমিতে চড়ে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার টন সুস্বাদু মাংসের উৎস কিন্তু এ গোস্তের তালকে নিজের মনে করার কাজ শুধু তাদের জন্য অসম্ভবই নয়, অকল্পনীয়। প্রাচুর্যের ভেতর ডুবে থেকেও ওরা তলিয়ে যাচ্ছে মৃত্যু আর অবলুপ্তির অতল গহ্বরে।
গোধূলীর আলোয় তেমন কোনো ঘটনা ছাড়াই গোত্রটা ফিরে এল গুহার দিকে। আহত যে বুড়ো বনমানুষীটাকে ওরা ছেড়ে গিয়েছিল সেটা তৃপ্তির মৃদু শব্দ তলে। কারণ চন্দ্র-দর্শী একটা বেরীভর্তি ডাল এগিয়ে দিয়েছে। বনমানুষীটা সাথে সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওটার উপর। এখান থেকে খুব কম পুষ্টিই জুটবে কিন্তু এটুকুই ওকে বেচে থাকতে সাহায্য করবে। সহায়তা করবে চিতার আঘাত থেকে সেরে উঠতে, আবার খাদ্যের খোঁজে যেতে।
উপত্যকার ওপাশ থেকে উঠে আসে পূর্ণিমার চাঁদ, কোন্ দূরের পাহাড় থেকে নেমে এসে হিম-হিম বাতাস বয়ে যায়। আজ রাতে দারুণ ঠাণ্ডা পড়তে পারে, কিন্তু খিদের মতো শীতও তেমন কোনো বাস্তব উদ্বেগের কারণ নয়; এ হল জীবনের পেছনে চিরায়ত চিত্রপট।
নিচের দিকের কোনো গুহা থেকে হুংকার আর আর্তনাদ ভেসে আসছে দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে। চন্দ্র-দর্শী স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে। এখন আর চিতার সেই মাঝেমধ্যে শোনা গর্জনের জন্য ওর অপেক্ষা করার দরকার নেই। ও ঠিক ঠিক জানে কী হচ্ছে সেখানে। সাদা চুলের বুড়ো আর ওর পরিবার লড়তে লড়তে মারা পড়ছে। সাহায্যের চিন্তাটা কখনোই চন্দ্র-দর্শীর মাথায় আসে না; বেঁচে থাকার নগ্ন নিয়মগুলো এতই কঠিন। পুরো পাহাড়ের কোথাও প্রতিবাদের একটা চিৎকার প্রতিধ্বনি ওঠে না। প্রত্যেক গুহাতেই মরণ-নিস্তব্ধতা, নয়তো চেঁচামেচি করলে নিজের গিরিগর্তটাও আক্রান্ত হতে পারে।
অনিশ্চয়তা কেটে গেছে। পাথরের উপর দিয়ে শরীর টেনে নেয়ার শব্দ শুনতে পায় চন্দ্র-দর্শী। মাত্র কয়েক মুহূর্ত পরেই চিতাটি নিজের শিকার উপভোগের মতো উপযুক্ত জায়গা পেয়ে গেল। এ কাজে তেমন শক্তি ব্যয় হয় না। নিরবতায় চিড় ধরে না। সহজেই বাঘটা নিজের চোয়ালে ঢুকিয়ে দিতে পারে শিকারকে।
আরো দু-চারদিন এখানে ঝুঁকি থাকবে; কিন্তু আরো শত্রু থাকতে পারে আশপাশে যারা এই শীতল, ফ্যাকাশে, নিশি-সূর্যের সুযোগ নিতে চায়। ঠিকমতো সবাই জানতে পারলে চেঁচামেচি করে ছোট শিকারীগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। হামাগুড়ি দিয়ে চন্দ্র-দর্শী বেরিয়ে আসে, উঠে যায় প্রবেশ পথের একটা পাথরের উপর। সেখান থেকেই নজর রাখে উপত্যকায়।
সব যুগে, সব কালে পৃথিবীর বুকে এগিয়ে চলা সব প্রাণীর মধ্যে বনমানুষেরাই প্রথম চাঁদের দিকে আগ্রহ নিয়ে মূর্তির মতো চেয়ে থাকতে শিখেছে। তার মনে নেই, যখন ছোট ছিল তখন প্রায়ই পাহাড়ের পেছন থেকে ওঠা এই ভৌতিক অবয়বটাকে ধরার জন্য হাত বাড়াতো।
ও কখনোই সফল হয়নি। আর আজতো ব্যাপারটা বোঝার মতো যথেষ্ট বড়। রাতের সূর্যকে ধরতে হলে প্রথমে অবশ্যই ওকে বিরাট কোনো গাছ বেয়ে উঠে যেতে হবে।
সময় সময়ে সে খুঁটিয়ে দেখত ভ্যালিটাকে। দেখত আকাশের চাঁদ। কিন্তু সব সময় আর একটা কাজ করত-তা হল খেয়াল দিয়ে শোনা। দু-চারবার ছাড়া সর্বদা সে ঘুমায় টান-টান স্নায়ুকে জাগিয়ে রেখে। খরকুটো পতনের শব্দও তাকে বিরক্ত করার জন্য যথেষ্ট। পঁচিশ বছরের মতো বয়সেও সবটুকু ক্ষমতার উপর দখল ধরে রেখেছে নিজে। ওর ভাগ্য সহায় হলে, দুর্ঘটনা এড়িয়ে যেতে পারলে, রোগ-ব্যাধি শিকারী-ক্ষুধাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলে আরো বছরদশেক বেঁচে থাকবে।