ক্লার্কের জাদুর সাথে কুবরিকের পরিচালনায় সৃষ্ট অমর গাঁথার ছবিটা মুক্তি পায় উনিশশো আটষট্টিতে। অবাক ব্যাপার, এর গ্রাফিক্যাল কাজ দেখে কেউ বলবে না এটা এত আগের। আর খারাপ দিক হচ্ছে-একেকটা দৃশ্য অনেক অনেক বেশি লম্বা এবং কাহিনীকে বেশ বদলে দেয়া হয়েছে ছবিতে। চার বছর আগে প্রয়াত বিখ্যাত চিত্র পরিচালক স্ট্যানলি কুবরিক ঘটনাটা নিয়েছিলেন। এ ছবি এত বেশি প্রভাব। ফেলেছে বাস্তব ক্ষেত্রে-যা এক কথায় অবিশ্বাস্য।
ইসরায়েলী কম্পিউটার সংস্থা বহুদিন ধরে গবেষণা চালাচ্ছে শুনে শেখা কম্পিউটার বিষয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে তারা তাদের কম্পিউটারের নাম রেখেছে ‘হাল’! এর বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (A.I) বিষয়ক অগ্রগতিরও দাবী করছে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা তাদের সর্বশেষ মহাকাশযানের নাম রেখেছে ‘ওডিসি’। রুশ বিজ্ঞানীরা শুনে শেখা কম্পিউটার তৈরির ব্যাপারে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছুবার ঘোষণা দিচ্ছেন।
বহুদেশে ‘আর্থার সি ক্লার্কের রহস্যময় জগৎ’ টিভি সিরিয়ালটি চলছে। ওটা তের পর্বের।
ছোটগল্পের মাঝে ‘দ্য সেন্টিনেল’, ‘হুজ দেয়ার হলো ক্লার্কের নিজ রীতির খাঁটি ভয়ভিত্তিক সায়েন্স ফিকশন। প্রতীক্ষা’, ‘সময় সমস্যা’, ‘অস্ত্র প্রতিযোগিতা’, ‘অন্ধকারের পথ’ তাঁর কয়েকটি অনন্য কর্ম।
তাঁর আরেক চরিত্র রামা’। লিখেছেন গার্ডেন অব রামা’, ‘রামা দ্য সেকেন্ড, ‘রামা রিভিড সায়েন্স ফিকশনের উপন্যাসগুলো। মজার ব্যাপার হলো, অনেক বোদ্ধা মনে করেন ক্লার্কের শ্রেষ্ঠ কাজ ওডিসির সিরিজ নয় বরং রামার সিরিজ। এটা পুরস্কারও পেয়েছে বড় বড়। কিন্তু প্রভাব ফেলতে পারেনি ওডিসির মতো।
‘চাইল্ডহুডস এন্ড’ বিখ্যাত বই। লিখেছেন ‘দ্য লাইট অব দ্য আদার ডে’জ’। বহু নন ফিকশনও লিখেছেন তিনি। লেখার ক্ষেত্রের বিস্তৃতি ছিল সেই মহাকাশ ভ্রমণ, সমুদ্রগর্ভের অতলে হারিয়ে যাওয়ার আলোচনার আশেপাশেই।
সায়েন্স ফিকশন ও ভবিষ্যৎ জীবনে মানুষকে যে সমস্যাটার মোকাবিলা করতে হয় তা হল ভয়। সম্ভবত মানবের আদিমতম শত্রু এবং অসহায়ত্বের প্রথম প্রতীক। তিনি তাঁর রচনায় প্রাধান্য দিয়েছেন পাঁচটা বিষয়ে যা সাহিত্যগুণকে মহিমান্বিত করেছে। এক, ভয়; দুই. মানবিকতা বিশ্লেষণ; তিন, মানসিকতা বিশ্লেষণ; চার. অনিশ্চয়তায় ভরা কাহিনীর ধারা আর গঠনগত দিকেও অনিশ্চয়তা; পাঁচ, কাহিনীর বক।
বিজ্ঞানের দিক দিয়ে কখন কী প্রাধান্য দিয়েছেন তা কোনো ছকে ফেলে দেয়া সম্ভব না; তবে সাধারণত যা উঠে আসে তা হচ্ছে, ১.স্পেস ট্রাভেল কেন্দ্র করে অনেক কাহিনীই ঘুরেছে, তিনি মূলত একজন মহাকাশবিদ্যার এস এফ লেখক; ২.সরাসরি সংযোগে না এসেও সবচে বড় প্রভাবটা ফেলে এলিয়েনই; ৩.স্বাভাবিকভাবেই নতুন গ্রহ বা উপগ্রহের উপর কাহিনী ঘুরপাক খায় প্রচণ্ড গতিতে; ৪. মহাকাশ বসত বা মহাকাশ যুগে মানব বসতি বিষয়ে অহরহ উঠে আসে ঘটনা। এক কথায়, তিনি অনন্ত নক্ষত্রবীথির কথক।
তাঁর লেখা যে মহাকাশ অভিযান, মহাকাশ টেকনোলজি নিয়ে আবর্তিত হয়, তা বেশ কয়েকবার বিভিন্ন লেখক বলেছেন। বিচারটা অনেক বেশি স্কুল হয়ে গেলেও করার কিছু নেই। তাঁর মতো লেখক বিজ্ঞানের কোনো দিক নিয়ে কাজ করছেন তা বিশ্লেষণ করাটা প্রায় অসম্ভব যেখানে বিজ্ঞানের ভোলা মাঠের পুরোটাতেই তিনি ম্যারাডোনা। তার আরেক ব্যাপার ভাল লাগে, আর সব ইংরেজ বা আমেরিকান লেখকের মতো শুধু ইংরেজ চরিত্র রাখেন না লেখাগুলোয়। বরং আফ্রিকান, ভারতীয়, চৈনিক, রাশিয়ান চরিত্র অনেক। কারণ তিনি কোনো জাতি বা দেশের প্রতিনিধি নন, প্রতিনিধি এ বিশ্বের মানুষের।
আর সাইবার পাঙ্ক হিসেবে তাঁকে কোনো শ্রেণীতে ফেলে দেয়া কঠিন। কারণ সাইবার পাঙ্ক শ্রেণীর জন্মের বহু আগ থেকেই তিনি নক্ষত্র। তবে লেখায় কাব্যধর্মীতা, উপমাশ্রয়, লম্বা বাক্য লেখার প্রবণতা, বক্র বচন, একটা বিষয় নিয়ে বেশি ঘাটানো আর বহু তুলনা করার স্টাইল থাকার কারণে অবশ্যই তাঁকে সাইবার পাঙ্ক লেখক বলা যায় না। কারণ তার সেসব বৈশিষ্ট্য ষাট-সতুর দশকে আন্তর্জাতিক সাহিত্যের। এসব বৈশিষ্ট্য অনেকটাই বিরক্ত করে পাঠককে, কিন্তু তিনি সেসময় সে স্টাইলেইতো লিখবেন, এটাই স্বাভাবিক। আর সাইবার পাঙ্ক হল আশির শেষার্ধে শুরু হওয়া একটা ধারা যা সাহিত্যকে গোয় ধরে না।
রাশিয়ায় ইউটোপিয়ান ফিকশন (utopian fiction) বা স্বপ্ন রাজ্যের গল্প নামে একটা ধারা বেশ পুরনো আমল থেকেই প্রচলিত। এর গোড়া অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝিতে দেবে আছে। একে অনেকে কম্যুনিস্ট ফিকশনও বলেন। এক মতে, ইউটোপিয়ার অর্থ দাঁড়ায় ভবিষ্যতের স্থানিক রূপ বা ভবিষ্যৎকে একটি সুন্দর স্থান হিসেবে কল্পনা করা। আরেক মতানুসারে, এর অর্থ ‘স্বপ্নীল জগৎ’। সত্যি বলতে গেলে, ক্লার্কের গোটা লেখার কোথাও এই স্বপ্ন রাজ্যের পেছনে দৌড়ানো দেখা যায়নি। তবে ভিতরে এমন একটা প্রবাহ দেখা যায়। আবার তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান ওডিসি পেন্টালজিতে এই ‘স্টার চাইল্ড’ এর পেছনে ধাওয়া করাটাই দেখানো হয়েছে যা আসলে ইউটোপিয়ান। কিন্তু ক্লার্ক কোন শ্রেণীর? আমার মনে হয় ক্লার্ককে সেমি সাইবারপাঙ্ক আর টেকনো ইউটোপিয়ান বলা যায়। কারণ প্রাযুক্তিক ইউটোপিয়া বা টেকননা ইউটোপিয়ান প্রভাবই তাঁর লেখায় বেশি।