ক্লার্কের প্রভাব আর আওতা অনেক দূরে গিয়ে ঠেকে। খ্রিস্টিয় পোপ জন পল তাঁকে পোপের দেশ ভ্যাটিকান সিটিতে ডেকেছেন মহাকাশ যুগে মানুষ কেমন হতে পারে, ধর্মের সম্ভাব্য অবস্থা ও অবস্থান এবং মানুষের মনস্তত্ত্ব সংক্রান্ত আলোচনার জন্য। এ লোকটা মনেপ্রাণে একজন সায়েন্স ফিকশন রাইটার। দীর্ঘ জীবনে তিনি সায়েন্স ফিকশন ছাড়া মাত্র দুটি উপন্যাস লিখেছেন। একটা ছেলেবেলা নিয়ে আর অন্যটা নিজের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন রাডার অফিসারের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা নিয়ে। ওটার নাম ‘গ্লাইড পাথ’। আর যেগুলো এস এফ নয় সেগুলো প্রবন্ধ।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যখন অন্যান্য দেশের মতো তারটিও ব্যস্ত ধ্বংসলীলায়- তখনো বিশ্বের সুবিধা আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে তিনি স্যাটেলাইট সম্পর্কে লিখেছেন। ‘মার্কনি ইন্টারন্যাশনাল ফেলোশীপ’ পান ওটার জন্য।
পেয়েছেন ফ্র্যাঙ্কলিন ইনস্টিটিউট স্বর্ণপদক, উনিশশো পঁচাশি সালে SCIENCE FICTION WRITERS OF AMERICA তাকে গ্র্যান্ড মাস্টার (Grand Master of Science Fiction) খেতাবে ভূষিত করে। উনিশশো ঊননব্বইতে নাইট উপাধিতে ভূষিত হন। বাষট্টি সালে কলিঙ্গ (ব্লদেভু উইথ রামা), উনসত্তর সালে আরেকটি পুরস্কার, র্যাডফোর্ড ওয়ারশার খেতাব, দু-বার হুগো, নেবুলা অ্যাওয়ার্ড, J.w. CAMPBELL খেতাব সহ আরো অনেক পুরস্কার জুটেছে তাঁর এ জীবনে। তবে কথাও থেকে যায়। এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, পুরস্কারদাতারা তাঁকে পুরস্কৃত করে নিজেরাই বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছেন।
যে দু-বার নেবুলা পেয়েছেন:
১৯৭৩ Rendezvous with Rama
১৯৭৯ The Fountains of Paradise
আর হুগো এ্যাওয়ার্ড:
১৯৭৪ Rendezvous with Rama
১৯৮০ The Fountains of Paradise
ক্লার্ক ভবিষ্যতের বেসাতি করেন। তাই বিজ্ঞান কল্প গল্পকারদের জন্যও তাঁর একটা কথা আছে জানানোর মতো। তিনি সায়েন্স ফিকশন লেখার পেছনে সবচে বড় যে উদ্দেশ্যটা খুঁজে পেয়েছেন তা তাঁর কথায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, “এসবের (ধর্ম- দর্শন সংস্কার-সমাজ-মূল্যবোধ) মধ্য দিয়ে নূতনতর জীবনবোধ কেমন দাঁড়াতে পারে, তা অনুসন্ধানের দায়িত্ব সায়েন্স ফিকশন রাইটারের। শুধু বিজ্ঞানকে জাদু হিসেবে উপস্থাপিত করার জন্যে নয়- এ এক প্রচার। প্রচারের উদ্দেশ্য মানুষকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রস্তুত করে তোলা।”
গ্রীক মহাকবি হোমারের ওরাল এপিক বা মুখে রচিত মহাকাব্য ছিল ‘ওডিসি’ (Odyssey)। চব্বিশ অধ্যায়ের মহাকাব্য। আরেক বিশ্বখ্যাত মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ এর পরিশিষ্ট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ইউলিসিস বা অডিসিউস ট্রয়ের যুদ্ধে অংশ নেন। তাঁর স্বদেশ যাত্রা নিয়ে রচিত এই মহাকাব্য খ্রীষ্টপূর্ব নবম শতকের। ওটাতে সম্রাট ইউলিসিস অতিমানবিক সংগ্রাম করেছে নিজ দেশ তথা লক্ষ্যে পৌঁছুতে। এর পর আরো একটা বইয়ের নামে ওডিসি এসেছে। এটার এ নামকরণের কারণ ওডিসির মতোই লক্ষ্যের দুস্তরতা আরোপ করা। টু থাউজ্যান্ড ওয়ান: এ স্পেস ওডিসি’ (2001: A Space Odyssey)। উনিশশো আটষট্টি সালে বেরুনোর পর আণবিক বোমার চেয়ে কোনো অংশে কম শক্তির বিস্ফোরণ ঘটায়নি সায়েন্স ফিকশন বোদ্ধাদের মনোজগতে। একজন পরিপূর্ণ দার্শনিকের রূপ পরিগ্রহণ করেন ক্লার্ক এতে। বলা হয় এজন্যই সবচে বেশি পরিচিত তিনি।
এটাকে অনেকে বলেন মহাকাশ বিজ্ঞান বিষয়ক সায়েন্স ফিকশনগুলোর-বিশেষ করে মহাকাশ অভিযান বিষয়ক বৈজ্ঞানিক সাহিত্যের কম্পাস হিসেবে। কারণ তিনি এতে মহাকাশ অভিযানের সব দিক তথা প্রযুক্তি আর মানবিকতা-দুইই প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীর মতো। স্টার ট্রেক’ থেকে ‘মার্স অ্যাটাক’ পর্যন্ত এর প্রভাব পড়েছে। এমনকি ক্লার্কের ওডিসি পেন্টালজিকে মহাকাশভিত্তিক সায়েন্স ফিকশনের প্রথম বিস্তৃত মাইল ফলক বলা হয়। এ অসম্ভব সফল বইটির আরেক অংশ লেখেন ‘টু থাউজ্যান্ড টেন: ওডিসি টু’। এরপর ‘টু থাউজ্যান্ড সিক্সটি ওয়ান: ওডিসি থ্রি’। কোনোটি লেখার সময়ই ইচ্ছা ছিলো না আরো একটু প্রলম্বিত করার। কিন্তু পাঠকরা ছাড়েননি ক্লার্ককে। আর কালাতিক্রমী অনন্যসাধারণ ঘটনাচক্র বাধ্য করেছে আরেকটি লিখে ওডিসির পাট চুকিয়ে দিতে। সময় সমাজ আর ভাবনাকে ডিঙিয়ে গিয়ে এ মহাকাব্যের সমাপ্তি টানলেন ‘থ্রি থাউজ্যান্ড ওয়ান: দ্য ফাইনাল ওডিসি’ নামে। এর মাধ্যমেই ওডিসি রহস্যের দুদিকের ভারি দরোজা চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দিতে চান উনিশশো সাতানব্বইতে। কিন্তু বিধি বাম, পাঠক-প্রকাশক সম্পাদকরা তাঁকে অতিষ্ঠ করে তুললে বাধ্য হন ‘ওডিসি ফাইভ’ লিখতে। ক’দিন আগে শেষ করেছেন বইটা। হয়তো বেঁচে থাকলে সব সময়ই তাকে ওডিসি লিখে যেতে হবে মানুষের চাপে পড়ে।
এর রহস্যঘেরা টোটেম, কু, হাল-ন হাজার কম্পিউটার, মানবিক দ্বন্দ্ব-কোনোটার চেয়ে কোনোটা কম যায় না। এক্সপেডিশন অফ আর্থ’ (১৯৫৩) এর বিশেষ একটা ছোটগল্প ‘দ্য সেন্টিনেল’। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ‘দ্য সেন্টিনেল কে পরে ওডিসির সিনেমা স্ক্রিপ্টে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন এবং তা মানিয়েও গেছে। এ নিয়ে লেখা চিত্রনাট্য ওই বছরের সেরার মর্যাদা কেড়ে আনে। একাডেমিক অ্যাওয়ার্ড ফর স্পেশাল ভিজুয়্যাল ইফেক্টস’ এবং ব্রিটিশ ফিল্ম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস ফর বেস্ট সিনেমেটোগ্রাফি, বেস্ট সাউন্ড, বেস্ট আর্ট ডিরেকশন’ পায়। অস্কার অ্যাওয়ার্ডের মনোনয়নও পেয়েছে ওটা। সবচে বড় কথা, ‘অল টাইম বেস্ট সায়েন্স ফিকশন মুভি’, ‘মোস্ট ওয়াইডলি ডিসকাসড এস এফ মুভি অব অল টাইম উপাধি পায় ওটি।