আজ সে জগদীশ্বর হলেও ঠিক ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কী করতে হবে এরপর।
কিন্তু সে হয়তো কিছু না করার কথা ভেবে রেখেছে।
***
আর্থার সি ক্লার্ক
সাহিত্যচর্চার একটা পরিবেশের জন্য অনেকেই অনেক কিছু করেছেন। এক্ষেত্রে কতটা নিবেদিতপ্রাণ হলে একজন মানুষ অধুনা সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু ব্রিটেন ছেড়ে টগবগে যৌবন থেকে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত থাকেন শ্রীলংকার মতো দ্বীপদেশে-অর্ধশতাব্দীরও বেশি কাল ধরে, আসলেই তা বিবেচ্য বিষয় সেই লেখক, তাঁর লেখা, লেখনীর বৈশিষ্ট্য-সর্বোপরি লেখকের জীবন আর মানব জীবন সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী আলোকপাত করার ক্ষেত্রে। তিনি ক্লার্ক, আর্থার চার্লস ক্লার্ক। বড় মাপের একজন লেখকই নন, লেখকের মাপকাঠি হিসেবেও বিবেচিত। তিনিই সর্বকালের সফলতম এস এফ ছায়াছবির চিত্রনাট্যকার, আজ পর্যন্ত একটা সায়েন্স ফিকশন লিখে তাঁরচে বেশি টাকা কেউ পায়নি। সোজা কথায় জীবিতদের মধ্যে তিনিই এস এফ জগতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। আর সর্বকালের হিসেবে দ্বিতীয়।
‘আর্থারকে, যিনি চাঁদে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন আমি পা রাখার আগেই’ কথাটা লিখেছিলেন অলড্রিন। চন্দ্রবিজয়ী। আর্থার সি ক্লার্কের ড্রয়িংরুমের দেয়ালে ঝোলানো ছিল একটা টি শার্ট। ওতে লেখা এই অসাধারণ উক্তিটি- যা দেয় ক্লার্কের কাজ আর জীবনের স্বীকৃতি।
আর্থার সি ক্লার্ক অ্যাপোলো এগারো, বারো ও পনের মিশনের ধারাভাষ্যকার ছিলেন। পৃথিবীবাসীর কানে তাঁর কণ্ঠ থেকে ভেসে আসা বিবরণেই পৌঁছে গেছে। চাঁদে গমনকারী অভিযাত্রীদের অভিযানের কথা- ধারাবাহিক কর্মকাণ্ডের চিত্র। বাস্তব জীবনে সম্পৃক্ততা ছিল বিজ্ঞানের সাথে। সায়েন্স ফিকশন জগতে শক্তিময় লেখনীর জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন আর্থার সি ক্লার্ক। প্রথম যেদিন ভূ-স্থির কৃত্রিম উপগ্রহ সম্পর্কে লেখেন, সেদিনও হয়তো তাঁর মতো অতি কল্পনাবিলাসী বিজ্ঞানবিদ ভাবেননি যে, জীবিতাবস্থায় তাঁরই লেখা তুলে আনবে বাস্তব সোনার ফসল। ভাবেননি, কোটি কোটি মানুষ তাঁরই কল্পনার বদৌলতে শত শত স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলে তথ্য প্রবাহের স্রোতে-বিনোদনের জগতে গা ভাসাবে। তিনি কি জানতেন যে, পৃথিবীর আবহাওয়া বিজ্ঞান, সমরনীতি, গোয়েন্দাগিরি, তথ্য প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অকল্পনীয় হারে ব্যবহৃত হবে তাঁরই মাথা থেকে আসা আইডিয়া? লেখাটি প্রকাশিত হয় হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের এক সপ্তাহ আগে। ‘ওয়ার্লেস ওয়ার্ল্ড’ নামক বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকায়।
স্যাটেলাইট বিজ্ঞানের জনক তিনি।
সচেতন জীবনের শুরু থেকে বিজ্ঞান তাঁকে নাড়া দিয়েছিল বেশ জোরেসোরেই। ছেলেবেলায় বাসায় বানানো টেলিস্কোপে চাঁদ ছত্রখান করার চেষ্টা করতেন। মামুলি দৃষ্টি দিয়েই। উনিশশো ছত্রিশে লন্ডন এসে ব্রিটিশ ইন্টার প্ল্যানেটারি সোসাইটিতে যোগ দেন। ব্রিটেনের রয়্যাল এয়ার ফোর্সে রাডার ইস্ট্রাক্টর ছিলেন একচল্লিশ থেকে ছিচল্লিশ পর্যন্ত। এর পর লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে পদার্থ আর অঙ্কে ফার্স্টক্লাস সহ গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন। তিনি ‘দ্য রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি, ‘অ্যাকাডেমি অব অস্ট্রোনটিক্স’ সহ আরো বহু প্রতিষ্ঠানের অনারারি মেম্বার।
‘যা একবার পৃথিবীতে ঘটতে পারে তা লক্ষ লক্ষবার মহাবিশ্বে ঘটেছে বলে আশা করা যায়।’- এ কালান্তরী বিশ্বাসই তাঁকে দাঁড় করিয়েছে সায়েন্স ফিকশনের সামনে। তাঁর লেখার বয়সই অর্ধশতাব্দী পেরিয়েছে। শতাধিক বই লিখেছেন। গল্পের শব্দ গাঁথুনীতে বিজ্ঞানমনস্কতা ফুটিয়ে তুলতে পারদর্শী। বার্ধক্যের বানে জর্জরিত তিনি নিরন্তর বিজ্ঞান সাধনা করে যাচ্ছেন আজও। শ্রীলংকার যে জায়গাটায় ক্লার্ক থাকেন, ওখানকার নাম হয়েছে তাঁর নামে। একজন ক্যাব বা বেবিট্যাক্সি ওয়ালাকে ‘ক্লার্ক পয়েন্টে যেতে বলতে হয় না। ক্লার্ক শব্দটা উচ্চারণ করলেই হয়। এই আজো এ মানুষটা সারাটা দিন কাটান স্টাডি রুমে। তাঁর সার্বক্ষণিক সহকারী একজন শ্রীলংকান সায়েন্স ফিকশন রাইটার। তিনি মনে করেন ক্লার্কের কাছাকাছি আসতে পারাটাই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওনা। শ্রীলংকার মানুষের চোখে তিনি “দ্য অনারারি রেসিডেন্ট”।
উনিশশো সতেরতে ইংল্যান্ডের মাইনহেডে জন্মগ্রহণ করেন ক্লার্ক। উনিশশো ছিচল্লিশ সালে, বেশ খানিকটা দেরিতেই লেখালেখির দরজায় পা রাখেন ‘রেসকিউ পার্টির মাধ্যমে। “প্রিয়ডিক্যাল অ্যাসফাউন্ডিং সায়েন্স’ পত্রিকাতে। তাঁর সাড়া জাগানো টেকনিক্যাল ব্যাপার ভিত্তিক উপন্যাস হচ্ছে ‘চাইল্ডহুডস এন্ড’ (১৯৫৩), ‘দ্য সিটি অব দ্য স্টার্স’ (১৯৫৬), এঁদেভু উইথ রামা’ (১৯৭৩), আর দ্য ফাউন্টেইনস অব প্যারাডাইস’ (১৯৭৯)। বিখ্যাত গ্রেট বেরিয়ার রীফ আর সিংহলের সাগরে ডুব দিয়ে কেটেছে সারাটা যৌবন। বৈজ্ঞানিক কাহিনী ভিত্তিক ছায়াছবিও করেছেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিজ্ঞান আর বৈজ্ঞানিক কল্পকথাভিত্তিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
‘থ্রি থাউজ্যান্ড ওয়ান: দ্য ফাইনাল ওডিসি’র জন্য তিনি সাত অঙ্কের ডলার পেয়েছেন বলে মনে করা হয়। সংখ্যাটা না কি দু-এক মিলিয়ন নয়। এর মানে হল, টাকার হিসাব আঠার কোটির উপর। আর এটা শুধু ইংরেজির জন্য। আরো পঁয়ত্রিশ ভাষার কথা হিসাবে না নিলেও চলবে। তাঁর অর্ধশত বই শুধু ইংরেজিতেই দু কোটির উপর কপিতে বেরিয়েছে।