আরামদায়ক উষ্ণতাতেও সেই শিশু ভয় পেয়ে বুঝতে পারে যে সেসব পদার্থের তার প্রয়োজন আছে। নাহলে কিসের দিকে সে তার ক্ষমতা আর দৃষ্টিশক্তিকে তাক করবে? তার ধ্বংসাতীত শরীরটা তার নিজের মনের বর্তমান প্রতিচ্ছবি ছাড়া আর কিছু নয়। এবং এতসব থাকা সত্ত্বেও, সে জানে, সে এক শিশু, মাত্র একটা শিশু।
তাই এখনো বুঝে উঠতে পারছে না যে তার আর পদার্থের প্রয়োজন নেই, নিজের ক্ষমতা প্রয়োগের সবচে ভাল ক্ষেত্র হচ্ছে শক্তি।
এবং সময় এসেছে যাবার। অবশ্য এক অর্থে সে কখনোই জন্মস্থান ছেড়ে যাবে না, কারণ জন্মের সময় তার অস্তিত্বের একটা অংশ মিশে গেছে দ্বৈত নক্ষত্রের চির দ্বৈরথের সাথে। কোন্ এক অজানা, অকল্পনীয় উদ্দেশ্য যেন মিশে আছে সেখানে। তার লক্ষ্য এখন সে জানে। কিন্তু যাবার জন্য সেই প্রাচীন পথ ধরতে হবে না। সে ত্রিশ লাখ বছরেরও বেশি সময়ের অভিজ্ঞতায় বুঝেছে, সৃষ্টি জগতের পেছন দিয়ে যাওয়া ছাড়াও যাতায়াতের আরো সহজ সহজ রাস্তা ছড়িয়ে আছে চারপাশে। নক্ষত্র দুয়ারের মান্ধাতা প্রযুক্তি তার যথেষ্ট সেবা করেছে, কিন্তু আর কখনো সেসবের প্রয়োজন নাও পড়তে পারে।
সেই আভাময় চতুষ্কোণ, যেটাকে প্রথমে সামান্য এক স্ফটিক মনে হয়েছিল তা এখনো তার সামনে ভাসছে। এর ভিতরে সময় আর স্থানের কত অযুত নিযুত রহস্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু এখন সে অন্তত একটা ব্যাপারে কর্তৃত্ব খাটাতে পারে। কী অপরিহার্য, কী প্রয়োজনীয় এই ১:৪:৯ অনুপাত! কী দুঃখজনক ব্যাপার, এই সিরিজ মাত্র তিন মাত্রাতেই ফুরিয়ে গেছে।
সে তার মনকে এই জ্যামিতিক সারল্যের দিকে তাক করানোর সাথে সাথে এর ভিতর মহাকাশ-রাজ্যের কালিগোলা অন্ধকার প্রবেশ করে। নিভে যায় লালচে আগুন-সমুদ্র, প্রবেশ করে কোথায় যেন…এবং অবশেষে, তার সামনে সেই চির নিশীথের রঙের উপর ফুটে ওঠে এক জ্যোতির্ময় ঘূর্ণিপাক। মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি।
মনে হতে পারে প্লাস্টিকের উপর একটা মডেল, কিন্তু এই হল পুরো গ্যালাক্সির রূপ, রস, গন্ধ। এবং এই শিশুর তালুবন্দী। সে চাইলেই এই পুরোটার দশ সহস্র কোটি নক্ষত্রের যে কোনোটায় মনোনিবেশ করতে পারে। সে চাইলে এরচে বেশি কিছু করতে পারে।
এখন সে এই সৌর-নদীতে ভেসে যাচ্ছে। এখন সে গ্যালাক্টিক কোরের মাঝপথে। সেখানে ঝলমল করে অযুত নক্ষত্র, আর পেছনে, প্রান্তসীমায় একা একা পাহারা দেয় কিছু নিঃসঙ্গ তারার দল।
সে জানে, সামনের এই আকৃতিহীন এলাকায় এখনো জোয়ার আসেনি, এখনো বিবর্তনের প্রাথমিক উপাদান গড়ে ওঠেনি, এখানে সময় বলতে কিছু নেই। এই শূন্যতায় আলো নেই, আলোর সৃষ্টি উপাদানও নেই। এখানে আলো জ্বলবে, কায়া তৈরি হবে, সময় তৈরি হবে, তারপর জীবনের অপার স্রোত ভাসিয়ে দেবে দশ দিগন্ত, ঝলমলিয়ে উঠবে চারদিক। বিলিয়ন বিলিয়ন বছর পরে।
সে খেয়াল না করে এমন একটা এলাকা পেরিয়েছিল, এবার সচেতনভাবেই সেখানে প্রবেশ করে। শিউরে ওঠে একাকিত্বের প্রকৃতি দেখে।
এই গ্যালাক্টিক মহাসাগর তাকে শীতল করে দেবে সেই ভয় নেই। সৃষ্টিহীনতার বিষাদ তার মর্মে মর্মে ধ্বনিত হচ্ছে। এবার সে বুঝতে পারে কেন ত্রিশ লাখ বছর ধরে ওরা শুধু ফুল ফোঁটানোর সাধনারত। কিন্তু তার একাকিত্ব তবু একটুও ঘোচে না।
এরপর হঠাৎ করেই বুঝতে পারে যে সে কখনোই একা হবে না। সাথে সাথে সৃষ্টি জগতের স্ফটিক-স্বচ্ছ রূপ তার মুঠোয় ধরা দেয়; পুরোপুরি তার নিজের ইচ্ছায় নয়, সে বুঝতে পারে।
সে আবার অযুত, নিযুত আলোকবর্ষ উপরে উঠে যায়, যেখানে পুরো মিল্কি ওয়ে একটা বিন্দু, তারপর নামতে শুরু করে। চারপাশে ছিটকে বেরোয় তারকারাজি, নেবুলা, গ্রহ, নক্ষত্রপুঞ্জ। নক্ষত্রগুলোর ভিতর দিয়ে, সব বস্তুকে ভেদ করে সে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগোয়। কসমিক ধুলোবালির দিকে প্রায় চোখই পড়ে না।
নক্ষত্রগুলো ছোট হয়ে হয়ে হারিয়ে যাচ্ছিল। কালো আকাশে হারিয়ে যাচ্ছিল মিল্কি ওয়ে।
এবং অবশেষে সে হাজির হয়েছিল সেখানে, যেখানে তার যাবার ইচ্ছা, যেখানে সে আগে ছিল, যেখানটাকে মানুষ বলে-বাস্তব।
অধ্যায় ৪৭. শতদল-দল খুলে যাবে থরে থরে, লুকানো রবে না মধু চিরদিন তরে …
এখানে, ওর ঠিক সামনে এক বিশাল খেলনা ভেসে বেড়াচ্ছে, কোনো নক্ষত্র জাতক একে প্রতিহত করতে পারবে না। পৃথিবী নামক গ্রহটি তার স-ব মানুষ নিয়ে ভেসে চলেছে কোন্ অজানার উদ্দেশে!
সে ফিরেছে সময়মতো। হয়তো অনেক নিচে, জনবহুল নগরীগুলোয় রাডার স্ক্রিন জুড়ে দাপড়ে বেড়াচ্ছে অ্যালার্মের লাল আলো। আকাশ ছত্রখান করে ফেলছে দানবীয় টেলিস্কোপগুলো। এবং মানুষ যে ইতিহাস জানে হয়তো তার যবনিকাপাত হবে এ যাত্রায়।
হাজার মাইল নিচে একটা মৃত্যু-দৃত জেগে উঠেছে…সে বুঝতে পারে। সেই কার্গোটা উঠে আসছে নিজের অর্বিটে। তার কাছে এর ভিতরের অস্থির অসীম শক্তির কোনো মানেই নেই, কিন্তু সে আরো পরিষ্কার এক আকাশ আশা করেছিল। নিজের ইচ্ছাটাকে সামনে বাড়ায়, ঘুরন্ত মেগাটনের জিনিসটা এক নীরব বিস্ফোরণে কৃত্রিম সূর্যোদয় নিয়ে আসে ঘুমন্ত অর্ধ ধরিত্রী জুড়ে। আণবিক মেঘ ঝরে পড়ে কুমারী বনভূমির সবুজ-সুন্দরের বুকে।
এরপর সে প্রতীক্ষা করে, নিজের সবটুকু চিন্তার উপর আধিপত্য বিস্তার করে। বোঝার চেষ্টা করে নিজের আজো অচেনা শক্তিকে।