কিন্তু কেউ প্রবেশ করে না। ওদিকে ছবিতে সেই লোক এরিমধ্যে বিছানায় উঠে বসেছে।
তার মানে এই পরিবেশ সেই ছায়াচিত্রের নকল। এজন্যেই টেলিফোন বুকের বড় লেখা পড়া গেলেও ছোটগুলো পড়া যায়নি।
নিজের আঙুলগুলো মাথার পেছনে চালিয়ে দিয়ে টিভি বন্ধ করে স্থির দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে থেকে এবার সে ভাবে-কী করব এখন?
শারীরিক আর মানসিক-দু-দিকদিয়েই একেবারে ক্লান্ত ডেভ বোম্যান। কিন্তু এ পরিবেশে ঘুমানোর কথা চিন্তাও করা যায় না।
কিন্তু শরীর, মন আর আরামদায়ক বিছানা তার বিপক্ষে চলে যাচ্ছে।
ক্লান্তি টের পেয়ে কোনোমতে লাইট নিভিয়েই সে অসাড় হয়ে যায়। এবার সে স্বপ্ন রাজ্যের চেয়েও দূরে কোথাও চলে গেছে।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাকাশচারী জ্যোতির্বিদ ডেভিড বোম্যান শেষবারের মতো ঢলে পড়েছে ঘুমের কোলে।
অধ্যায় ৪৫. পরিণতি
আর কোনো প্রয়োজন না থাকায় পুরো হোটেল স্যুটটাই এর স্রষ্টার মনে বিলীন হয়ে গেল। শুধু আছে সেই খাট, খাটের বাইরে প্রতিরক্ষা শিল্ড আর খাটের উপর স্বপ্নহীন অপূর্ণ নিদ্রারত আধা-সচেতন ডেভ বোম্যান। বাইরে আগুনের হল্কা, ভিতরে নিরুদ্বিগ্ন ডেভিড, আশপাশে অবোধ্য অনুভূতি। নেই ভয়, শঙ্কা, আশা, হতাশা; কিছুই নেই।
সে যেন কোন্ অজানার দেশে ভেসে আছে, চারপাশে আদিগন্ত কালো সুতোর রেখা নানা ক্ষেত্র গড়ছে, ভাসছে অজস্র ছোট ছোট আলো-কোনটা স্থির, কোনোটা অকল্পনীয় গতিতে চলমান।
সে একবার মানুষের ব্রেনের এক ছোট্ট টুকরোকে মাইক্রোস্কোপের নিচে ধরেছিল। সেই হাজারো সুতোর গোলকধাঁধা ছিল মৃত, কিন্তু চারপাশের অজস্র বিস্তৃতির পুরোটাই যেন জীবন্ত।
সে জানে, অথবা মনে করার চেষ্টা করে যে জানে এই রহস্যের সমাধান। সে এক দুনিয়াজোড়া মাথার কাজের ধারার ভিতরে বসে আছে। জীবন্ত মস্তিষ্ক। সেখানে অকল্পনীয় বিস্তৃত সব কাজ চলছে অবিরত, কিন্তু দেখা যায় না। শুধু অনুভব করা যায় নিজের অপরিমেয় ক্ষুদ্রতা।
এই দৃশ্য, অথবা দৃষ্টিভ্রম চলে যায় এক মুহূর্ত পরেই। সেই স্ফটিকীকৃত জগৎ, সেই আলোর গোলকধাঁধা, সেই অকল্পনীয় অবস্থা কাটার পর পরই সে একটা সচেতনতার ভুবনে ভাসতে শুরু করে।
প্রথমে মনে হল স্বয়ং সময় পেছনে চলে যাচ্ছে। সে ব্যাপারটাকে মেনেও নেয় আসল সত্যি জানার আগ পর্যন্ত।
পুরনো অনুভূতি, দৃশ্য, মনোভাব, স্বাদ, তৃপ্তি-সব ফিরে আসছে, চলে যাচ্ছে। হোটেল রুম-জ্বলন্ত লাল নক্ষত্র- স্টেশন- প্রবেশদ্বার- জ্যাপেটাস- ডিসকভারি শনি- বৃহস্পতি- চাঁদ- পৃথিবী- ট্রেনিং… সব, সব ফিরে আসছে। ক্রমবর্ধমান গতিতে যেন তার স্মৃতির ফিতা পেছনে টানে কেউ একজন। কিছুই হারায়নি, কিন্তু মানুষের মন কি এত নিখুঁতভাবে সব সংরক্ষণ করে রাখে?
এগিয়ে আসছে সহজ-সরল পৃথিবী, আনন্দময় অতীত, বেদনায় নীল হয়ে যাওয়া সব মুহূর্ত। প্রিয়মুখ, প্রিয় কাজ, কৈশোর, শিশুত্বও এক সময় কেটে গেল।
এখন স্মৃতির মহা সুড়ঙ্গ শুকিয়ে আসছে। সময় বইছে অতি, অতি ধীরে। পরের চক্র শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত পেন্ডুলামের মতো দুলছে মহাকাল; এদিক-ওদিক।
সময়হীন মুহূর্ত কেটে গেল, পেন্ডুলামের দোলনের দিক গেল বদলে। থেমে গেল সবকিছু। সব, সবকিছুর উল্টোরথ শুরু হয়েছে আবার।
এক দ্বৈত নাক্ষত্রিক এলাকায়, পৃথিবী থেকে বিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে এক শিশু তার চোখ খুলে প্রথমবারের মতো কেঁদে ওঠা শুরু করবে এখন।
অধ্যায় ৪৬. এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর, হে সুন্দর
এক সময় সে নিরব হয়ে যায়, কারণ এখন আর সে একা নয়।
এক ভৌতিক ঝকঝকে চতুষ্কোণ আকাশে উদিত হয়েছে। সেটা এক ক্রিস্টাল ট্যাবলেটে পরিণত হয়ে এক সময় স্বচ্ছতা হারায়। এর ভিতর দুধসাদা আবহ।
অস্পৃশ্য, ভৌতিক কিছু শরীর ঘোরাফেরা করে তার উপরিতলে, ভেতরে। তারা জোড়ায় জোড়ায় একত্র হয়, তারপর কাঠির মতো সরু হয়ে যায় প্রত্যেকে, তারপর ঘুরতে থাকে; আলোর বৃত্ত তৈরি করে। যেন পুরো মহাকাশ জুড়ে রয়েছে তার ব্যাপ্তি।
এ আলোকসামান্য দৃশ্য যে কোনো শিশুর, যে কোনো বন মানুষের মনোযোগ আটকে রাখতে জানে। কিন্তু এ দৃশ্য ত্রিশ লাখ বছর ধরে সত্যিকার কাজের কাজ কিছুই করেনি। সে শুধুই মনোযোগ আটকে রাখে। বাকী আসল কাজটা হয় মনের গহীনে।
এবার কাজের ধারা অতি দ্রুত এগিয়ে চলে, কারণ নতুন পদ্ধতি বেরিয়েছে।
শিশু তার চোখ তুলে ক্রিস্টালের গভীরে তাকায়। এ চোখ মানুষের চোখ নয়। সে দেখতে পায় ঘুমিয়ে থাকা রহস্যলোকের দরজাকে, কিন্তু এখনো ঠিক বুঝতে পারে না। সে জানে এখন সে সবচে নিরাপদ অবস্থায় আছে, কারণ এখানে লাখো প্রাণীর জন্ম হয়েছে। কিন্তু সে এখনো জানে না সামনে সবচে অদ্ভুত জন্মটা এখনো বাকী।
এবার, স্বচ্ছ মনোলিথ তার আলোর খেলা বন্ধ করে দেয়; হারিয়ে যায় নিজের আলোরই মতো; তারপর শূন্য থেকে উঠে আসা প্রতিরক্ষা বর্ম মিলিয়ে যায় শূন্যে; এবং, এক বিশাল দানব লাল নক্ষত্র তার এলাকার অহেতুক বর্মটা মিলিয়ে যাবার সাথে সাথে সেটুকু দখল করে নেয়।
সেই স্পেস পোডের ধাতু আর প্লাস্টিক, এক সময় যে লোকটা নিজেকে ডেভিড বোম্যান বলে পরিচয় দিত তার সমস্ত পোশাক আর তার সাথে যা ছিল সব সাথে সাথে প্লাজমার অকল্পনীয় উত্তাপে লীন হয়ে যায় সূর্যের সাথে।