দুটো দরজা বেশ সাবলীলভাবে খুলে গেল। প্রথমটা দিয়ে বেডরুমে যাওয়া যায়, সেখানকার লাইটগুলো জ্বালানো-নিভানো যাচ্ছে। অন্য দরজা খুলে ভিতরে দেখতে পায় একটা ক্লোজেট। ক্লোজেটে চারটা স্যুট, ডজনখানেক শার্ট, কয়েকটা আন্ডারওয়্যার আরামে ঝুলছে।
একটা স্যুট নামিয়ে এনে চোখের সামনে ধরে সে বুঝতে পারে যে জিনিসটা ফারের নয় বরং উলের মতো কিছু দিয়ে তৈরি। পোশাকটা একটু পুরনোও বলতে হবে, পৃথিবীতে গত চার বছর ধরে কোনো মানুষ সিঙ্গেল ব্রেস্টেড কোট পরে না।
বেডরুমের পর একটা বাথরুম ছিল। সে হাজারো স্বস্তির সাথে অনুভব করে যে তার বাথরুমটা ডামি নয়, কাজ করছে ভালমতো। এর পাশেই একটা পিচ্চি রান্নাঘর। সেখানে ইলেক্ট্রিক কুকার, ফ্রিজ-এসবই আছে। সে এসব দেখা শুরু করেছে শুধু আগ্রহের কারণে নয়, পর্বতপ্রমাণ খিদের জ্বালায়ও।
ফ্রিজের ভেতর পরিচিত অনেক ধরনের ক্যান আর প্যাকেট, ঠাণ্ডার ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে একটু কুয়াশা কুয়াশা ভাব দেখে। প্যাকেটগুলোর লেখা কাছ থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু বোঝানো হচ্ছে যে লেখাটা ইংরেজি।
একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে সে হতাশ হয়-সেখানে ডিম, দুধ, মাছ মাংস বা সজির মতো কোনো রান্নার যোগ্য খাবার নেই। সব প্যাক করা খাবার।
সে কিছু পরিচিত নাস্তার প্যাকেট তুলে নেয়। ভেবে একটু মজা পায়, এসব ফ্রিজে রাখার কথা না। প্যাকেট তোলার সাথে সাথেই বুঝতে পারে সেখানে কর্নফ্লেক্স নেই। জিনিসটা অনেক বেশি ভারি।
প্যাকেট খুলে সে হালকা নীলচে আঠালো এক ধরনের খাবার দেখতে পায়। ওজনে পুডিংয়ের মতো। রঙ-গন্ধের তোয়াক্কা না করে ক্ষুধার কাছে নত হতে হচ্ছে।
হঠাৎ করেই নিজের চুল টেনে তুলে ফেলতে ইচ্ছা করে তার। ব্যাপারটা হাস্যকর হলো না? আমি যদি কোনো বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষায় পড়ে থাকি তো এর মধ্যেই ফেল মেরে বসেছি। এখনো স্পেসস্যুট না খোলা উচিত হয়নি।
সে সাথে সাথে বেডরুমে ফিরে গিয়ে নিজের হেলমেট খোলার কাজে মনোযোগ দেয়। একটু আলগা করেই বাতাস নিয়ে বুঝতে পারে চারপাশে তার বিশুদ্ধ বাতাসের ছড়াছড়ি।
সাথে সাথে হেলমেটটা বিছানায় রেখে ভালমতো স্যুট খুলে ফেলে। তারপর ভদ্রভাবে কয়েকবার বাতাস টেনে নিয়ে ক্লোজেটের অন্য পোশাকের সাথে ঝুলিয়ে দেয়। দেখতে একটু বেখাপ্পা লাগলেও করার কিছু নেই। মানবজাতিকে সুন্দররূপে উপস্থাপন করতে হবে তো! তার উপর তার আছে একজন জ্যোতির্বিদের নিয়মানুবর্তিতা।
বোম্যান রান্নাঘরে ফিরে গিয়ে পরের প্যাকেটগুলো দেখার কাজে মনোযোগ দিল। সেগুলোতেও একই জিনিস। অগত্যা নীলচে আঠালো তরলের গন্ধ নিয়ে খুব একটা খারাপ লাগল না। জিনিসটায় ম্যাকারনির মতো মসলা মসলা ঘ্রাণ আছে। সে সাবধানে পুডিং থেকে একটু ভেঙে হাতে নেয়, তারপর ভাবে, তাকে বিষ দেয়ার কোনো ইচ্ছা নিশ্চয়ই তাদের নেই; কিন্তু বায়োকেমিস্ট্রির মতো একটা ঘোরালো বিষয়ের জন্য একটু ভয় ভয় হচ্ছে।
মুখে দিয়ে প্রথমে সে একটু চুষে দেখেই চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। এর স্বাদ-গন্ধ আমেজ অনন্য। চোখ বন্ধ করে খেলে জিনিসটাকে মাংসও মনে হতে পারে, নরম রুটিও মনে হতে পারে আবার শুকনো ফলও মনে হতে পারে।
এবার একটা ক্যান খুলে সেখানে বিয়ার না পেয়ে সে খানিক হতাশ হয়। একই জিনিস। সুতরাং খাবারগুলো একটু বিরক্তিকর ঠেকবে এক সময়। পানি ছাড়া তরল কিছু নেই।
সে প্রথমে দু-এক ফোঁটা পানি চেখে দেখে, স্বাদটা অপূর্ব। তারপর নিজের সন্দিহান মনের জন্য একটু লজ্জা পেয়েই যেন বাকীটা এক চুমুকে শেষ করে ফেলে।
পানিটা তবু কেমন কেমন মনে হয়। এ হল একেবারে খাঁটি পানি এবং শুধু এইচ টু ও। আর কিছু নেই এই পানির মধ্যে। আতিথেয়তাকারী তার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে এক বিন্দু ঝুঁকি নিতে চায় না মনে হচ্ছে।
গোসলের সময় সাবান না পেয়ে মন যতটা খারাপ হয়েছিল তা পুষিয়ে গেল এয়ার ড্রায়ারে শরীর শুকিয়ে। এবার ক্লোজেট থেকে কাপড় নিয়ে পরার পালা।
শুয়ে শুয়ে দেখার জন্য যথারীতি রুমের সিলিংয়েও একটা হোটেল টাইপ সিলিং টিভি আছে, সেটাও খেলনা হবে তাতে আর সন্দেহ কী?
কিন্তু তার বিছানার পাশে কন্ট্রোল ডিস্কটা দেখে এত বাস্তব মনে হল যে সাথে সাথে সেটার অন বাটন চেপে দেয় বোম্যান।
সাথে সাথে চিত্র ভেসে ওঠে মনিটরে। এ লোক খুবই পরিচিত একজন আফ্রিকান ধারাভাষ্যকার, লোকটা সেই পরিচিত সুরে নিজের দেশের বন্যপ্রাণী বাঁচানোর আন্দোলনের কথা বলছে। সে জানতো না মানুষের কণ্ঠস্বর এত মধুর, এত প্রয়োজনীয়, এত দামী। মুহূর্তে জীবন ফিরে আসে তার মনোজগতে।
এর পর অন্য চ্যানেলে ওয়াল্টনের ভায়োলিন কনসার্তো বা বেহালা কনসার্ট দেখতে পায়। দেখতে পায় আরো কত অনুষ্ঠান কত শত চ্যানেলে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। অনুষ্ঠানগুলো মনকে শুধু সজীব করে তোলেনি, সাথে সাথে তার একটা সন্দেহও প্রকট হয়ে উঠেছে।
এই সবকিছুই মানুষের টি এম এ-ওয়ান আবিষ্কারের পর পর রেকর্ড করা হয়। তার মানে মানুষ যেটুকু ধারণা করেছিল টি এম এ-ওয়ান তারচে অনেক বেশি কাজ করে। সব কিছু সম্প্রচার করেছে অহর্নিশি।
এরপর একটা নাটকে সে তার নিজের লিভিংরুমে বসে থাকা অতি বিখ্যাত এক চিত্রতারকার দৃশ্য দেখে বিমূঢ় হয়ে যায়। সে বেডরুমে ঢুকছে, এমন সময় বোম্যানও সেই দরজার দিকে তাকায়।