একি কোনো জোরপূর্বক দখল, নাকি আলোর দিকে আলো কণার যাত্রা? যাই হোক, সে আন্তঃনাক্ষত্রিক অভিবাসন দেখতে পেল এইমাত্র। বড় সূর্য থেকে ছোটটার দিকে এই যে আগুনের সেতু বেয়ে অসীম পদার্থের গ্যাস হয়ে চলে যাওয়া তা আদৌ প্রাকৃতিক নাকি কোনো অদৃশ্য হাতের খেলা তা সে বুঝে উঠতে পারে না।
সে এক নতুন সৃষ্টির খেলা দেখছে, এ খেলার কথা ভাবার মতো, ফুরসৎ মিলবে না মানবজাতির। কিন্তু এর সবই সে বুঝতে পারবে এমন বোকামির আশা করাটাও বোকামি।
অধ্যায় ৪৪. অভ্যর্থনা
আগুনের সিঁড়ির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ডেভ বোম্যান বুঝতে পারে তার চারপাশে একটা কিছু ঘটছে। তরল পানির মতো আগুনে দুনিয়া যেন প্রবাহিত হচ্ছে। আলো কমে আসছে। দ্বিতীয় কোনো সূর্যাস্তের সময় চলে এসেছে। এরপর হঠাৎ করেই উপলব্ধি করে যে এখানে আলোর উৎস সূর্যটা নয়, বরং নিচের পৃথিবী।
মনে হচ্ছে ধোয়ার দেয়াল গজিয়ে উঠেছে তার চারপাশে, লাল জ্যোতিকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে অচেনা পরিবেশে নেয়ার জন্য। আস্তে আস্তে ঘন হয়, সাথে সাথে সৌর ঝড়ের মৃদু গর্জনও হারিয়ে যায় আড়ালে। এখন পোডটা একেবারে কালিগোলা অন্ধকারে ঠায় ভেসে আছে; একটু পর সামান্য ঝাঁকিতে বোঝা গেল কোনো শক্ত সারফেসে এবার স্পেস পোডটা বসার সুযোগ পেয়েছে।
কিন্তু কিসের উপর? আলো ফিরে আসার সাথে সাথে চারপাশে যা দেখল তাতে তার নিজেকে পাগল ভাবতে আর বাকী নেই।
সে যে কোনো কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল, প্রস্তুত ছিল না শুধু পরিচিত কিছু দেখার জন্য।
পোডটা এক চমৎকার পালিশ করা ঝকঝকে হোটেল স্যুটের মেঝেতে অবতরণ করেছে। এ অত্যন্ত দামী কামরা শুধু পৃথিবীর বিরাট বিরাট শহরের পাঁচ তারা হোটেলগুলোতেই দেখা যেতে পারে। এ হল স্যুটের থাকার ঘর। লিভিংরুমটায় একটা কফি টেবিল, ডিভান, এক ডজন চেয়ার, রাইটিং ডেস্ক, নানা ধরনের টেবিল ল্যাম্প, আধ ভর্তি বুককেস আর বেশ কিছু ম্যাগাজিন, এমনকি এক স্থানে সাজানো তাজা ফুলও চোখে পড়ে। ভ্যান গগের ব্রিজ এট আর্লস শোভা পাচ্ছে এক দেয়ালে, অন্যটায় ইয়েথের ক্রিস্টিনা’স ওয়ার্ল্ড। সে নিশ্চিত, ডেস্কের ড্রয়ার খুললেই একটা বাইবেল পাবে সেখানে…
ডেভ বোম্যান আসলেই পাগল হয়ে গিয়ে থাকলে তার ডিলুশনগুলো বেশ সুন্দরভাবেই সাজানো হয়েছে তো! সব ঠিকঠাক আছে, পেছনে ঘোরার পর কিছুই হারিয়ে যায়নি। আসলে সে যতটা চাপ সহ্য করেছে একজন মানুষের পক্ষে তার হাজার ভাগের এক ভাগও সহ্য করা সম্ভব নয়। সুতরাং মানসিক বিকৃতি আসা তেমন অস্বাভাবিক নয়। পুরো দৃশ্যে বেমানান যে অংশ চোখে পড়ে তা হল তার স্পেস পোড।
জিনিসটাকে এত বাস্তব দেখাচ্ছে যে সেটাই এক বিস্ময়কর ব্যাপার। সম্ভবত তার মনকে যাচাই করা হচ্ছে দৃষ্টিবিভ্রমের সাহায্যে। নাকি সেই ক্ষমতাবানের দল তাকে স্বর্গ-নরক দেখিয়ে এবার মর্তে নামিয়ে দিয়েছে? বলছে, যাও, গিয়ে সবাইকে বলো আমাদের কথা। আমরা আছি, তোমাদের পাশে পাশেই সর্বশক্তি নিয়ে আছি…
ভাবনাটা তাকে কাঁপিয়ে দেয়। পোডের দরজা খোলার সাথে সাথে মৃদু শব্দ ওঠে চাপ সমতাকরণের জন্য।
সে পোডের বাইরে পা রাখে। স্থানটা একেবারে কঠিন…অবশ্যই, নাহলে স্পেসপোড থাকে কী করে?
কিন্তু বাতাসের ভয়তো কেটে যায়নি। সে নিশ্চিত ঘরটা হয় ভ্যাকুয়াম, নয়তো দূষিত বায়ুর বস্তা। কেউ এতকিছুর পরে এমন নিখুঁতভাবে খুতখুতে ভাব দেখাবে না, কিন্তু সে আলাদা বলেই এ পর্যন্ত টিকে আছে। তার আগে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা চাই। জীবন খোয়াতে আপত্তি ছিল না, আবার বিনা চেষ্টায় কখনো জীবন দিতেও রাজি নয়। তার ব্যক্তিত্ব এমন, তার উপর ট্রেনিং তাকে আরো বেশি বাস্তববাদী করে তুলেছে। দেখেশুনে যুক্তরাষ্ট্রের কোথাও এমন হোটেল আছে বলে মনে হচ্ছে।
হাত উপরে তুলে ছেড়ে দিতেই সেটা ধপাস করে নেমে এল। তার মানে মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর মতো। সব কেমন গোলমেলে লাগছে। হিসাব করে প্রতিটি সেকেন্ড চলতে হবে।
সে দেয়ালের পাশে যায়, ছুঁয়ে দেখে, যায় কফি টেবিলের পাশে। এর মধ্যে বেয়ারা ডাকার বেলও আছে। একটা ভিশন ফোন আর তার পাশে স্থানীয় ফোন ডাইরেক্টরিও পড়ে আছে। সে স্পেসস্যুট পরা হাতে তুলে নেয় বইটাকে।
জীবনে হাজারবার এমন নামের টেলিফোন বই হাতে নিয়েছে বোম্যান। ওয়াশিংটন ডি.সি.।
এবার সে ভালমতো লক্ষ্য করে বুঝতে পারে যে এ সব সত্যি হতে পারে, কিন্তু সে সম্ভবত পৃথিবীতে নেই।
এলাকার নামটার পর বাকী লেখাগুলো বোঝা যাচ্ছে না। সেগুলো দারুণ ঝাপসা। ব্যাপার বোঝার জন্য পাতা উল্টে নিয়ে দেখতে পেল সব ফাঁকা, কোনো লেখা নেই। এমনকি কাগজের জিনিসটাও ঠিক কাগজ নয়, কেমন যেন কোঁচকানো সাদা জিনিসে গড়া। দেখতে অবশ্য খুব বেশি এদিক-সেদিক নয়।
সে টেলিফোন তুলে নিয়ে ডায়াল করে; যা ভেবেছিল তাই। কোনো শব্দ নেই।
সুতরাং, এ এক নিখুঁত ভাওতাবাজী। কিন্তু এই ভাওতাবাজী নিশ্চয়ই তাকে একটু শান্ত করার জন্যে, সান্ত্বনা দেয়ার জন্য। যাই হোক, সে আর স্পেসস্যুট খুলছে না।
চেয়ারগুলো দুনিয়ার ওজন নিয়ে বসে আছে, টেবিলের কোনো ড্রয়ার খুলছে না। বইগুলো দেখেও হতাশ হতে হল। গত তিন বছরের সেরা সেরা হাজার রকমের বই এখানে। বুকসেলফ থেকে তোলারও উপায় নেই।