আর তার পর, আরো ভয়াবহ ধারণা খেলে গেল ডেভ বোম্যানের মাথায়। নাকি পথটা এখন শুধু নষ্ট স্পেসশিপ আর মহাকাশ জঞ্জাল নিয়ে আসে এখানে? আরো অনেক প্রাণীর মতো সেও কি বাতাসের অভাব পড়ার পর এই স্পেস পোডের ভিতর মারা পড়বে?
যাক, আরো আশা করাটা অবান্তর। এরই মধ্যে এমন শত ব্যাপার দেখে ফেলেছে যার যে কোনো একটা দেখার আশায় মানুষ নির্দ্বিধায় প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে। তার মৃত বন্ধুদের কথাও মনে পড়ে। তাদের তুলনায় বোম্যানের আর কিছু চাওয়ার থাকে না।
জীবনের শেষ প্রান্ত নিয়ে ভাবার মুহূর্তেই চোখে পড়ে পোর্টটা এগিয়ে আসছে। তার দিকে, কিন্তু উপরে উঠছে না। একটু পর বিশাল ধাতব গোলক পেছনে পড়ে যায়, সামনে এগিয়ে চলে স্পেস পোড, আর তার ভিতর ডেভ বোম্যান।
যাক, তার ভাগ্যলিপি এখানে ফুরিয়ে যায়নি। বোম্যান ভাবে। এবং দেখতে পায় ভাগ্যলিপির শেষ অধ্যায়।
সেই ছোট্ট দানব সূর্য এবার এগিয়ে আসছে।
অধ্যায় ৪৩. জ্বলন্ত নরক
এখন সামনে শুধু লাল সূর্য। সেটা পুরো আকাশ জুড়ে বসে আছে। সে এত কাছে চলে এসেছে যে এদিক-ওদিক নড়তে থাকা আগুন নদী আর উন্মাতাল গ্যাসের ঝঞ্ঝা স্পষ্ট চোখে পড়ে। আর আগুনের হল্কাগুলো ধীরে উপরে উঠে আসছে। ধীরে? তার চোখে ব্যাপারটা পড়তে হলে ঘণ্টায় লক্ষ মাইলেরও বেশি গতি দরকার…
যে আগুনে নরকে সে পড়তে যাচ্ছে তার আকার নিয়ে সে চিন্তাও করে না। তার চিন্তাভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কেন? একটা সূর্যের বুকে কি কারো পড়া সম্ভব? লক্ষ মাইল দূর থেকেই সে স্রেফ হাওয়া হয়ে যাবে।
বৃহস্পতি আর শনির বিশালত্ব তার উপর টেক্কা মেরেছিল কোনো অজানা গিগামাইল দূরত্বের সৌর জগতে থাকাকালে। কিন্তু বৃহস্পতি এখানে থাকলে লজ্জায় মুখ লুকাতো।
আগুনের সমুদ্র পেছনে ছড়িয়ে পড়ায় তার আতঙ্কিত হওয়ার কথা, কিন্তু অবাক ব্যাপার-সে শুধু নিশ্চিন্ত মনে বসে আছে। তার ভাবনার কিছু নেই, নিরাপত্তা দেয়ার জন্য তার পেছনে কোনো অদৃষ্ট নিয়ন্তা কাজ করছে। সে এখন সূর্যের এত কাছে যে তাপ আসুক চাই না আসুক, শুধু এতক্ষণের তেজস্ক্রিয়তায় জ্বলে পুড়ে তার খাক হয়ে যাবার কথা। কিন্তু কিছু হয়নি। অদৃশ্য কোনো বর্ম যে কে ধরে রেখেছে তা মৃত্যুর আগে জানতে পারলে বেশ হতো। আর এতক্ষণ ধরে যতটুকু ত্বরণ তার শরীর সহ্য করে এসেছে এমনটা সত্যি সত্যি ঘটলে অনু-পরমাণু একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার কথা।
না, মরণ এত এগিয়ে আসেনি। এত কষ্ট তার জন্য করা হয়ে থাকলে সামনে আর কিছু থাক না থাক, আশা থাকে।
পোড এবার সূর্যের সারফেসের সমান্তরালে চলতে চলতে ধীরে নেমে যাচ্ছে। এবার প্রথমবারের মতো সে শব্দ শুনতে পায়। দূর থেকে কে যেন কাগজ ছিঁড়ছে-শব্দটা এমন।
পরিবেশ নিশ্চয়ই প্রচণ্ড প্রতাপে সবকিছুকে একেবারে বিশ্লিষ্ট করে ফেলার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু তারচেও ক্ষমতাবান কেউ নিজের ক্ষমতা দিয়ে বোম্যানকে ঘিরে রেখেছে চতুর্পাশে।
অগ্নি চূড়া তার চারপাশে মাইলের পর মাইল এলাকা জুড়ে উঠছে আর নামছে, এ দৃশ্য শুধু অপার্থিব, অদৃষ্টপূর্বই নয়, সত্যি সত্যি অকল্পনীয়। যেন পোডটা অন্য কোনো মাত্রায়, ভিন্ন কোনো জগতে বাস করে; তাকে ছোঁয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি সূর্যের শক্তিকে।
এবার সে দেখে যে এই নক্ষত্রের ভিতরটা আকৃতিহীন নয়। প্রকৃতিসৃষ্ট সব ধরনের গড়নই এখানে আছে।
প্রথমেই সে ছোট্ট ফোয়ারাগুলো দেখতে থাকে। এগুলো আকৃতিতে এশিয়া আর আফ্রিকার চেয়ে কোনো অংশে ছোট হবে না। সূর্য জুড়ে ছড়িয়ে আছে, দাপড়ে বেড়াচ্ছে পিঁপড়ার মতো। অবাক ব্যাপার, নিচে কোনো সৌরকলঙ্ক চোখে পড়ল না। এটা হয়তো পৃথিবীর সূর্যের কোন ব্যক্তিগত রোগ।
এখানে সেখানে এক আধটু মেঘও দেখা যায়। ধোঁয়াও হতে পারে, কারণ সূর্যটা এত ঠাণ্ডা যে এর বুকে আগুনের শিখা তৈরি হওয়া সম্ভব। সাধারণ সূর্যে আগুনের শিখা বহু দূর-অস্ত বিষয়। সেখানে পদার্থ তার তিন অবস্থাকে পিছনে ফেলে প্লাজমা হয়ে থাকে। এখানে রাসায়নিক যৌগ তৈরি হয়ে আবার প্রাজমায় পরিণত হওয়ার আগে দু-চার সেকেন্ড সময় পেলেও পেতে পারে।
নক্ষত্রের উপরিতল জ্যোতির্ময় হয়ে যাচ্ছে। আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায় বোম্যানের। এখন সে কী করবে? চোখে তো সাদা বামন নক্ষত্র সহ্য করা সম্ভব নয়। ছোট নক্ষত্রটা উঠে আসার সময় চোখ বন্ধ করে রাখে।
সে চোখ মেলে বড় সূর্যের অন্য দিকে তাকিয়ে। আগুনের ঘূর্ণিঝড় উঠেছে নতুন অরুণোদয়ের সাথে সাথে। সে একবার ক্যারিবিয়ানের বুকে জল-ঝড় দেখেছিল। ঘূর্ণিপাকটা ছিল সচল। এই আগুনে ঘূর্ণিও হুবহু এক, শুধু এর গা আগুনের তৈরি আর আকৃতি পৃথিবীর সমান।
এরপর সে ঠিক নিচে এমন একটা কিছু দেখে যা আগে সেখানে থাকলে অবশ্যই চোখে পড়ত। নিচে গ্যাসের একটা বিরাট দল তৈরি হয়েছে এইমাত্র। তারা চারদিকের তাপ সহ্য করতে না পেরে দল বেঁধে উপরদিকে বাঁকা হয়ে সাঁতরে উঠছে-যেমন করে স্যামন মাছ ওঠে।
এমন আরো হাজারটা চোখে পড়ল একটু চেষ্টা করতেই। সেসব অঞ্চল আসলে ফিতার আকারে গ্যাস সাম্রাজ্য। সে ঠিকমতো দেখতে পায় না, তবে বোঝা যায় যে শত শত মাইল লম্বা হবে প্রত্যেকে।
তারা প্লাজমা মেঘও হতে পারে যা কোনো অজানা প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফল। এই হল সবচে সহজ সরল ব্যাখ্যা। কিন্তু আচরণটা ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না সে। সবাই দল বেঁধে সাদা মনের আগুন-স্তম্ভের উপর উঠে পড়ছে এবার।